সাম্প্রতিক সময়ে গোটা বিশ্বের জন্য আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে নিতান্তই একটি অণুজীব। নিতান্ত শব্দটা যদিও এর ভয়াবহতার অভিজ্ঞতাকে ম্লান করতে পারবে না এতটুকুও। বলছি করোনাভাইরাসের কথা। শাসন করছে গোটা পৃথিবী। টিকা আবিষ্কার হয়েছে ঠিকই। কিন্তু ক্রমাগত মিউটেড হয়ে এই মারণ ভাইরাসটি প্রশ্নবিদ্ধ করছে টিকার কার্যকারিতাকে। তাবড়-তাবড় বিজ্ঞানীদের রেখেছে দাঁতের উপর।
তবে প্রাণঘাতী ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়াদের সঙ্গে লড়াই মানব সভ্যতার ইতিহাসে নতুন নয়। আজ থেকে লক্ষ লক্ষ বছর আগেও পৃথিবীর ছবিটা ছিল একইরকম। এমনকি পঞ্চম গণঅবলুপ্তির মূলেও ছিল অণুজীবরাই। করোনাভাইরাসে ত্রাহি ত্রাহি দশা হলেও এর থেকেও অনেক বেশি প্রাণঘাতী ভাইরাসের উল্লেখ আছে মানব ইতিহাসে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উষ্ণতা বেড়ে যাচ্ছে। এতে অ্যান্টার্কটিকাসহ অনেক এলাকার বরফ গলে প্রাচীন সব প্রাণীর অস্তিত্বের প্রমাণ বেরিয়ে আসছে। সম্প্রতি ১৫ হাজার বছর আগের কয়েকটি ভাইরাসের সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। সূত্র: সায়েন্স অ্যালার্ট
তিব্বতের বরফঢাকা একটি পর্বতশৃঙ্গে পাওয়া গেছে এসব ভাইরাস। সেখান থেকে সংগ্রহ করা বরফখণ্ডে যে ভাইরাসগুলোর অস্তিত্ব মিলেছে, সেগুলো বিজ্ঞানীদের কাছে একেবারেই অপরিচিত।
এর আগে বরফের নিচ থেকে প্রায় ৪০ হাজার বছর আগের নেকড়ের মাথা এবং সাড়ে সাত লাখ বছর আগের ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির জলবায়ু ও অণুজীববিজ্ঞানীদের একটি দল গবেষণার কাজে পশ্চিম চীনের গুলিয়া আইস ক্যাপে গিয়েছিল। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এই পর্বতশৃঙ্গের উচ্চতা ২২ হাজার ফুট। ২০১৫ সালের ওই অভিযানে তারা সেখান থেকে কিছু বরফখণ্ড নিয়ে আসেন। পর্যবেক্ষণের পর সেসব বরফখণ্ডে মিলেছে এই প্রাচীন ভাইরাসগুলোর উপস্থিতি।
অণুজীববিজ্ঞানী ঝিপিং ঝং জানান, প্রায় এক হাজার ১৭ ফুট গভীর থেকে বরফখণ্ডগুলো তুলে আনা হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ৩৩টি ভাইরাস পাওয়া যায়। এর মধ্যে ২৮টি একেবারেই অপরিচিত।
সিএনএন জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির জলবায়ু ও অণুজীববিজ্ঞানীদের একটি দল গবেষণার কাজে পশ্চিম চীনের গুলিয়া আইস ক্যাপে গিয়েছিলেন। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এখানকার উচ্চতা ২২ হাজার ফুট। ২০১৫ সালের ওই অভিযানে তারা সেখান থেকে কিছু বরফখণ্ড নিয়ে আসেন। পর্যবেক্ষণের পর সেসব বরফখণ্ডে মিলেছে প্রাচীন ভাইরাসের অস্তিত্ব।
এ–সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিবেদন মাইক্রোবায়োম সাময়িকীতে প্রকাশ হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এখন পর্যন্ত শনাক্ত হওয়া ভাইরাসগুলো বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করে নথিভুক্ত করে রেখেছেন। তবে বরফখণ্ড থেকে সম্প্রতি সন্ধান পাওয়া ভাইরাস আগে থেকে নথিভুক্ত ছিল না।
বেশিরভাগ ভাইরাসই ব্যাকটেরিওফেজ গোত্রের। এরা মিথাইলোব্যাকটেরিয়ামের সংক্রমণ ঘটায়। বরফের ভেতর মিথেন চক্রের জন্য মিথাইলোব্যাকটেরিয়াম গুরুত্বপূর্ণ।
ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির মৃত্তিকাবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও প্রতিষ্ঠানটির বেয়ার্ড পোলার রিসার্চ সেন্টারের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী লোন্নিয়ে থম্পসন বলেন, বরফ ভাইরাসগুলোর চমৎকার সংরক্ষণাগার হিসেবে কাজ করেছে।
তবে প্রাকৃতিকভাবে বরফখণ্ডে সংরক্ষিত এসব ভাইরাস সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা জানেন না বললেই চলে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে। এর জেরে মেরু অঞ্চলের বরফ গলতে শুরু করায় বিষয়টি বিজ্ঞানীদের মনোযোগ কেড়েছে। এই বিষয়ে থম্পসন আরও বলেন, কোভিড–১৯ মহামারি বিজ্ঞানীদের আগের চেয়ে সচেতন করেছে। তারা ভাইরাস, অণুজীব নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছেন।
ওহাইয়ো স্টেট ইউনিভার্সিটির মাইক্রোবায়োলজিস্ট ম্যাথিউ সালিভান বলেন, ‘এ ভাইরাসগুলো চরম প্রতিকূল পরিবেশেও থাকতে পারে।’
পরিচিত ভাইরাসের ডাটাবেজের সঙ্গে ১৫ হাজার বছর আগের ভাইরাসের জেনেটিক সিকোয়েন্স তুলনা করেন গবেষক দল।
এতে দেখা যায়, বেশিরভাগ ভাইরাসই ব্যাকটেরিওফেজ গোত্রের। এরা মিথাইলোব্যাকটেরিয়ামের সংক্রমণ ঘটায়। বরফের ভেতর মিথেন চক্রের জন্য মিথাইলোব্যাকটেরিয়াম গুরুত্বপূর্ণ।
আর্থ সায়েন্টিস্ট থম্পসন বলেন, ‘প্রচণ্ড শীতল পরিবেশে থাকা ভাইরাস ও মাইক্রোবস সম্পর্কে আমরা খুব কমই জানি।
‘জলবায়ু পরিবর্তনে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস কেমন প্রতিক্রিয়া দেখায় বা বরফ যুগ থেকে এখনকার উষ্ণ পরিবেশের যাত্রার সময় কী হয়েছিল, এসব এখনও অজানা।’
ক্রমাগত পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়িয়ে চলেছে গ্রিন-হাউস গ্যাসগুলি। আর তার সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ছে মেরু অঞ্চলে। বিগত ৩ দশক ধরেই এই নিয়ে চিন্তিত বিজ্ঞানীরা। তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এল আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। উত্তর মেরু অঞ্চলের বরফ গলনের যে হার বিজ্ঞানীরা আন্দাজ করেছিলেন, বাস্তব হার তার প্রায় দ্বিগুণ। এমনকি, এভাবে চলতে থাকলে ২০৪০ সালের মধ্যে উত্তর-মেরু সাগরের উপর বরফের কোনো আস্তরণ থাকবেই না।
উত্তর এবং দক্ষিণ মেরু পৃথিবীর উষ্ণতা নিয়ামক নামে পরিচিত। তার কারণ এই দুই অংশে বরফের স্তর। সূর্যের রশ্মি সরাসরি সমুদ্রের জলকে উত্তপ্ত তো করতে পারে না, বরং বরফে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে যায় মহাশূন্যে। এই বরফের স্তর হারিয়ে গেলে সারা পৃথিবীর উষ্ণতাই বাড়তে থাকবে। আর মেরু অঞ্চলের এস্কিমোদের মতো উপজাতিরা তো সমস্যায় পড়বেনই, বিপন্ন হবে মানব সভ্যতা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫১২
আপনার মতামত জানানঃ