জাকির হোসেন
ধর্মান্ধরা প্রায়ই বলে থাকে যে, ধর্মগ্রন্থ থেকেই বিজ্ঞানের জন্ম হয়েছে! আসলেই কি ধর্মগ্রন্থ হতে বিজ্ঞান আসেছে ?
যারা বলে থাকেন ধর্মগ্রন্থ থেকে বিজ্ঞানের জন্ম হয়েছে তাদের জানা উচিত কোনটা আগে হয়েছে? ধর্ম না বিজ্ঞান?
প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের ভিত্তিতে বলা যায়, মানুষের উদ্ভাবনী ক্ষমতা ৩ লক্ষ বছর আগেই বিকাশ লাভ করেছিলো। যখন মানুষ প্রথম মৃতের কবর দেওয়া শুরু করে এবং প্রথম হাতিয়ারগুলো আবিষ্কার করে।
আর বর্তমানের টিকে থাকা ধর্মগুলোর বয়স মাত্র সাড়ে তিন হাজার বছর! অথচ মানুষের উদ্ভাবনী ক্ষমতা ৩ লাখ বছরের পুরনো! তারপর মানুষ আরো উদ্ভাবনী ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে এবং যার প্রকাশ দেখা যায় ২.৬ লক্ষ বছর আগে। যখন মানুষের প্রথম দিককার আবিষ্কারগুলোর মধ্যে ছিল হাতুড়ি, পাথরের কোর এবং ধারালো পাথরের ফ্লেক্স।
এই আবিষ্কারগুলো কখনো কোন ধর্মগ্রন্থ হতে আসেনি। কেননা, তখন কোন ধর্মেরই জন্ম হয়নি।
আমরা প্রত্নতাত্ত্বিক রেকর্ড থেকে বলতে পারি, মানুষের সৃজনশীলতা প্রায় ৪০,০০০ বছর আগে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বিকশিত হয়েছিল। যা পরবর্তী ১০ -১৫,০০০ বছর ধরে বিশ্বজুড়ে স্বাধীনভাবে চর্চা হতে থাকে। এটি ছিল উচ্চ প্যালিওলিথিক যুগের ‘সৃজনশীল বিস্ফোরণ’।
আর ৩০০০ থেকে ১২০০ BCE-এর মধ্যে প্রাচীন মিশর এবং মেসোপটেমিয়ায় বিজ্ঞানের প্রথম দিকের আবিষ্কারগুলো খুঁজে পাওয়া যায়। গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা এবং ঔষধে তাদের অবদানগুলি গ্রীক প্রাকৃতিক দর্শনের শাস্ত্রীয় প্রাচীনতায় প্রবেশ করে এবং এদের আকৃতি দেয়, যার মাধ্যমে প্রাকৃতিক কারণগুলির উপর ভিত্তি করে ভৌত জগতের ঘটনার ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য আনুষ্ঠানিক প্রচেষ্টা শুরু হয়। ধর্ম আসে অনেক পরে।
মানুষের প্রথম দিককার আবিষ্কার সমুহ…
“সময় জ্ঞান” মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন আবিস্কার ! যা কোন ধর্ম গ্রন্থ হতে আসেনি।
এটি অনুমান করা যুক্তিসঙ্গত যে, আদি হোমিনিডরা দিন এবং রাতগুলি লক্ষ্য করতে শুরু করেছিল। প্রাচীনকালে দিন, তারিখ গণনার জন্য আকাশের তারা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তারা “তারা” পর্যবেক্ষণ করত। তারা চাঁদের পর্যায়গুলি এবং সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর আবর্তনে ঋতুর পরিবর্তন আলাদা করে লিপিবদ্ধ করা শুরু করে। কোন ঋতুতে কোন উদ্ভিদে কি ফল হয় এবং কোন ফসলটি কোন ঋতুতে ওঠে সেই অনুযায়ী ফসল তোলা এবং বীজ বপন করার সময়সূচী আবিষ্কার করে।
একটি দিনের অংশগুলির মতো ছোট ছোট সময়গুলি প্রথমে অনুমান করা হয়েছিল – সকাল, বিকাল এবং সন্ধ্যা -। কিন্তু তারপরে সূর্যালোক এবং জল ঘড়িগুলি আসে। এতে তাদের অসুবিধা ছিল যে, মেঘলা দিন হলে সূর্যের ছায়া কাজ করে না, এবং বরফ পড়লে জলঘড়ি কাজ করে না। ঘন্টা, মোমবাতি ব্যবহার করা যেতে পারে, কিন্তু তা ছিল ব্যয়বহুল। এই কারণেই মানুষ যান্ত্রিক ঘড়ি আবিষ্কারে প্রয়াসী হয়।
তারার পর্যবেক্ষণ থেকে মিশরীয়রা প্রথম বার্ষিক সময়কাল গণনা শুরু করে এবং ঋতুর উপর ভিত্তি করে সময়ের ১২টি উপবিভাগ তৈরি করে। গ্রীক ইতিহাসবিদ এবং ভূগোলবিদ হেরোডোটাস খ্রিস্টপূর্ব ৩ সালে মিশরের এই “টাইম মাস্টারদের” দক্ষতার বিবরণ দেন। তখন কোন ধর্ম গ্রন্থের উদ্ভব হয় নি। যা থেকে মানুষের এই সময়জ্ঞানের ধারণা হবে।
চাইনিজ ক্যালেন্ডারের উৎপত্তি হয় খ্রিস্টপূর্ব ১৪তম শতাব্দীতে। এটা বিশ্বাস করা হয় যে, সম্রাট হুয়াংদি (হুয়াং টি বা হুয়াং ডি) ৩০০০ এবং ২৬০০ BCE বা প্রায় ২৬৩৭ BCE-এর মধ্যে ক্যালেন্ডারটি [বর্তমান রূপ] প্রবর্তন করেছিলেন।
তাই এটি প্রায় ৪৬৫৫ বছরে পুরনো। যা তাদের ধর্মগ্রন্থ থেকে তৈরি হয়নি।
হিব্রু ক্যালেন্ডারটি বেশ পুরানো। আজ থেকে ৫,৭৭৮ বছর আগের। যদিও এটি সুমেরীয়দের কাছ থেকে পাওয়া।
বিভিন্ন ইউরোপীয় মেগালিথ গ্রীষ্মের মাঝামাঝি এবং মধ্য শীতের সঠিক দিনগুলি পরিমাপ করার জন্য “সময় মান মন্দির” বা স্টোনহেঞ্জ নির্মাণ করে। আমরা জানি না তারা কী বিশ্বাস করেছিল, তবে তারা এর মাধ্যমে বছরের পর বছর গণনা করতে পারত।
অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহরের কাছে একটি আদিম নিদর্শন রয়েছে যা কমপক্ষে ১১,০০০ বছর পুরানো। Wurdi Youang সাইট, পাথরের একটি বিন্যাস হল প্রাচীনতম পরিচিত জ্যোতির্বিদ্যা পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র। এটি সফলভাবে অয়নকালের দিনগুলি নির্দেশ করে, কার্যকরী পরিমাপ করে এবং বছর গণনা করে।
এই বিষয়গুলি এমন এক সময়ে করা হয় যখন বিশ্বের প্রচলিত কোন ধর্মেরই জন্ম হয়নি।
নব্য প্রস্তর যুগে মানুষ সময় গণনার দিন, তারিখ, মাস, সময়, ঘন্টার জটিল বিষয়গুলো সনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল। যখন কোন ধর্মের জন্ম হয়নি।
সভ্যতার প্রথম দিকে আমাদের সারা বিশ্বে বিভিন্ন ক্যালেন্ডার ছিল। তাদের উৎপত্তি বাস্তব এবং পৌরাণিক উভয়ই মহান ঘটনা দিয়ে শুরু হয়। তাও এগুলো প্রচলিত ধর্মগুলো জন্মের ৬০০০+ বছর আগের।
প্রাচীনকালে বন জঙ্গলে বসবাসকারী এবং বিচরণকারী উপজাতিরা “তারা”র নিদর্শন বিশ্লেষণ করেছিল এবং তারিখ এবং সময়ের ট্র্যাক রাখার উপায় খুঁজে পেয়েছিল।
তাদের বিভিন্ন সময়ে ঋতু, এবং সূর্যের উচ্চতা সম্পর্কে ধারণা ছিল। এর মাধ্যমে তারা বন্যা এবং বর্ষার পূর্বাভাস দিতে পেরেছিল।
অর্থাৎ এখানে দেখা যাচ্ছে মানুষের দৈনন্দিন কাজকর্মের প্রয়োজনীয়তার কারণে, কৃষি অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও পশু পালনের সুবিধার্থে মানুষ দিন, তারিখ, সময়, ঘন্টার হিসাব পদ্ধতি বের করেছিল। যেখানে ধর্মের কোনো ভূমিকা নাই। ধর্মের প্রয়োজনে এগুলো আবিষ্কার হয়নি।
বরঞ্চ মানুষের এই সময় গণনার পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে মোল্লা, পুরোহিতেরা তাদের ধর্মপালনের সময়সূচী ঠিক করে।
যখন কোন ধর্মেরই জন্ম হয়নি তখন মানুষ পাথরের অস্ত্র, তীর চালনা, আগুণের আবিস্কার করে। যার মুল কারণ ছিলো টিকে থাকার সংগ্রাম। এই টিকে থাকার সংগ্রামই মানুষকে আগামী ভবিষ্যৎ নির্মাণে স্বাচ্ছন্দ দিয়েছে। এগুলির কোনোটিই কোন ধর্মের ঈশ্বরের বাণী হতে আসেনি। তখন মানুষের ঈশ্বরের ধারণা তৈরি হয়নি।
ধর্মসৃষ্টির পূর্বে মানুষের মৌলিক আবিস্কারগুলো…
আগুনের আবিষ্কার : ১.৭ থেকে ২.০ মিলিয়ন বছর আগে মানুষ আগুন আবিষ্কার করেছে।
প্রায় ১ মিলিয়ন বছর আগে শুরু হওয়া হোমো ইরেক্টাস দ্বারা আগুনের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার হিসাবে “কাঠের ছাইয়ের মাইক্রোস্কোপিক ট্রেস” এর প্রমাণ বহন করে।
– এর সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক নাই।
সভ্যতা বদলে দেওয়া আগুন যা, মানবজাতির ইতিহাসকে বদলে দেয়, তা কোন ধর্ম হতে সৃষ্টি হয়নি। বরং এটি মানুষের প্রয়োজনেই মানুষ আবিষ্কার করে।
তীর চালনা : যদিও তীরন্দাজ সম্ভবত প্রস্তর যুগ থেকে শুরু হয়েছিল – প্রায় ২০,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে।
প্রথম দিকের লোকেরা নিয়মিতভাবে ধনুক এবং তীর ব্যবহার করত।
প্রাচীন মিশরীয়রা, যারা শিকার এবং যুদ্ধের জন্য ৩,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তীরন্দাজ গ্রহণ করেছিল।
চীনে, শ্যাং রাজবংশের তীরন্দাজের প্রথম প্রমাণ – ১৭৬৬-১০২৭ বিসি।
অর্থাৎ, দুই লাখ বছর আগে মানুষ তীর-ধনুকের ব্যবহার করত। তখন ধর্ম তো দূরের কথা, কোন ধর্মগ্রন্থ তো দূরের কথা, সৃষ্টিকর্তারও ধারণা জন্মেনি। বরং বিকারগ্রস্থ ধার্মিকরা নিজেদের প্রভাব বিস্তার করার জন্য প্রস্তর যুগের এই আবিষ্কারকে সহিংসতার কাজে ব্যবহার করে। এর পিছনে তাদের ধর্ম নয় বরং তাদের ক্ষমতা, প্রতিপত্তি ও নারী লোভ কাজ করেছিল।
অর্থাৎ আত্মরক্ষার যন্ত্রপাতি মানুষের প্রয়োজনেই মানুষ সৃষ্টি করেছে। এর সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক নাই।
কাপড় আবিষ্কার : মানুষ কাপড় আবিস্কার করে ৪০ হাজার বছর আগে। পায়ের জুতা আবিষ্কার করে ৪০ হাজার বছর আগে। ২০ হাজার বছর আগে মানুষ সিরামিক পাত্রে খাবার খেতে শুরু করে। ১১ হাজার বছর আগে মানুষ কৃষির বিপ্লব ঘটায়।
চিন্তা করতে পারেন, সভ্যতার এই মৌলিক আবিষ্কারগুলো প্রচলিত কোন ধর্মগ্রন্থ হতে আসে নাই। প্রচলিত ধর্মগুলোর সাথে কোন সম্পর্কও নাই। বরং ধর্ম সৃষ্টির বহু আগেই মানুষ এগুলো আবিষ্কার করেছে!
চাকা : সভ্যতার মৌলিক আবিষ্কার চাকা এবং চাকার রথ। এগুলো যানবাহন যা ৫,৫০০ বছর আগে প্রাচীন ইরাকের মেসোপটেমিয়ায় আবিষ্কৃত হয়।
আর সাড়ে তিন হাজার বছর আগে জন্ম নেওয়া কিছু ধর্মে আমরা এই চাকাওয়ালা ঘোড়ার রথের যুদ্ধ দেখতে পাই! যা মানুষের উদ্ভাবনী আবিষ্কারের বহু পরের ঘটনা।
চকলেট আবিষ্কার করে ৪,০০০ বছর আগে। চুল কাটা ও সেভের মাধ্যমে মানুষ প্রথম বনমানুষ হতে আধুনিক মানুষে পরিণত হয়! – এ এক নতুন চমক! মানুষের এই নতুন লুক কোন ধর্ম থেকে আসেনি। কেননা, তখন মানুষের এই ধর্মগুলি ছিলনা।
৩০,০০০ BC : প্রাচীন গুহাচিত্রগুলি প্রায়শই দাড়িবিহীন পুরুষদের চিত্রিত করে। চকমকি পাথরের ব্লেড চিমটার সাথে যুক্ত করে মানুষ চুল, দাড়ি কমাতো এবং ক্লামশেল দিয়ে অবাঞ্ছিত লোম কামাতো।
প্রাগৈতিহাসিক কালে কোন ধর্মগ্রন্থ ছিলনা? মানুষ চুল কাটা দাড়ি কাটার উপকরণ আবিষ্কার করে নিজে স্বস্তি পাওয়ার জন্য। যা মানুষকে গুহা মানব হতে আধুনিক মানুষের পরিণত করে! এর সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক নাই।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, শরীরে অত্যধিক ময়লা জমা এবং উকুনের প্রাদুর্ভাব থেকে বাঁচার জন্য প্রথম মানুষ চুল কাটা এবং সেভের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এর সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক নাই। ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভারত ও মিশরে তামার রেজার এসে।
মদ : PNAS-এ প্রদর্শিত একটি বিস্ময়কর গবেষণা অনুসারে, আধুনিক মানব প্রজাতি উদ্ভবের অনেক আগে, অর্থাৎ ৭ থেকে ২১ লক্ষ বছর আগে আমাদের আদিম পূর্বপুরুষদের মধ্যে অ্যালকোহল বিপাক দেখা দিয়েছিল। যখন প্রাথমিক প্রাইমেটরা মাঝে মাঝে ইথানল সমৃদ্ধ গাঁজানো ফল খেত। আর মানুষ ওয়াইন খাওয়া শুরু করে ৯ হাজার বছর আগে।
নেশাজাতীয় দ্রব্য ধর্ম সৃষ্টির লক্ষ লক্ষ বছর আগেই মানুষ গ্রহণ করত। এবং এর সাথে হারাম-হালাল কিংবা কোন ধর্মের সম্পর্ক নাই। বরং প্রচলিত ধর্মগুলোর স্বর্গে মানুষ মদ এবং ওয়াইনের কথাগুলো ধর্মীয় ভাষায় লিপিবদ্ধ করে!
প্রথম বাদ্যযন্ত্র ও বাঁশি বাজানো শুরু করে ৩৭ থেকে ৬৭ হাজার বছর আগে, এবং অসংখ্য তারের যন্ত্র, যেমন রাভানাহাথা, সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক খনন থেকে পাওয়া গিয়েছে।
বিনোদন মানুষের মৌলিক চাহিদা। মানুষ তার জীবনের আবেগ অনুভূতিকে শৈল্পিকভাবে উপস্থাপনের জন্য হাজার হাজার বছর আগেই উন্নত মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট আবিষ্কার করে। এর সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক নাই।
পৃথিবীর প্রথম ধর্মের লিখিত টেক্সট পাওয়া যায় প্রাচীন সুমেরের কেশ মন্দিরের স্তোত্রে। এটি খোদাই করা হয় মাটির ট্যাবলেট এ। যা ২৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। এটি প্রাচীন মিশরের ফারাওদের ধর্মের চেয়ে প্রাচীন। তাই, যেসব ধর্মগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে সেগুলোর হিসেব ধরে নিলেও সংগঠিত ধর্মগুলোর বয়স মাত্র ৪৬০০ বছর!
আর বর্তমানে টিকে থাকা ধর্মগুলির বয়স মাত্র ৩৫০০ বছর! অন্যদিকে মানুষের উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও বিজ্ঞানের আবিষ্কার তিন লক্ষ বছরের পুরোনো।
টিকে আছে এমন কতগুলো ধর্ম …
হিন্দুধর্মের জন্ম হয় খ্রিস্টপূর্ব ১৫-৫ম শতাব্দীতে। জরথুস্ট্রবাদ ১০ম – ৫ম খ্রিস্টপূর্বাব্দ, ইহুদি ধর্ম (৯ম – ৫ম খ্রিস্টপূর্ব, জৈন ধর্ম ৮ম – ২য় খ্রিস্টপূর্ব, কনফুসিয়ানিজম ৬ষ্ঠ-৫ম খ্রিস্টপূর্ব, বৌদ্ধধর্ম ৬ষ্ঠ-৫ম খ্রিস্টপূর্ব, তাওবাদ ৬ষ্ঠ – ৪র্থ খ্রিস্টপূর্ব, শিন্টোইজম ৩য় – ৮ম খ্রিস্টপূর্ব, খ্রিস্টধর্ম ১ম শতাব্দি এবং ইসলাম ৭ম শতাব্দি।
অর্থাৎ, এখানে দেখা যাচ্ছে প্রচলিত ধর্মগুলোর জন্ম মাত্র ১৪০০ হতে ৩৫০০ বছর মাত্র। আর মানুষের আবিষ্কারগুলির বয়স ৩ লক্ষ বছর!
অতএব, এটা বলা যেতে পারে যে, ধর্ম জন্মের বহু লক্ষ বছর আগেই মানুষের উদ্ভাবনী ক্ষমতা, বিজ্ঞানের জন্ম হয়েছে।
প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার প্রয়োজনেই মানুষ তার আশ্রয়, অবকাঠামো, কৃষি, খাদ্যসংরক্ষণ ও সম্পদ বৃদ্ধি উদ্ভাবন করেছিলো। – এর সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক নাই।
১২ হাজার বছর আগে প্রাগৈতিহাসিক গার্হস্থ্য জীবনের আবিষ্কার…
যখন কোন ধর্মের উদ্ভব হয় নি…, তখন মানুষের খাদ্য সঞ্চয় এবং সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা থেকে কৃষি ব্যবস্থার উদ্ভাবন ঘটায়। যা ধর্ম থেকে নয়।
প্যালিওলিথিক যুগের শেষের দিকে, মানুষ গুহাচিত্র, রক আর্ট এবং গয়না তৈরির মতো শিল্পকর্ম তৈরি করতে শুরু করে এবং কবর ও আচার-অনুষ্ঠানের মতো ধর্মীয় আচরণে জড়িত হতে শুরু করে।
কুকুর ছিল প্রথম গৃহপালিত প্রজাতি, এবং এটি ইউরেশিয়া জুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্লাইস্টোসিন যুগের শেষের দিকে, চাষের আগে এবং অন্যান্য প্রাণীদের গৃহপালিত হওয়ার আগে।
প্রত্নতাত্ত্বিক এবং জেনেটিক তথ্য থেকে জানা যায়, গাধা, ঘোড়া, উট, ছাগল, ভেড়া এবং শূকর সহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী মানুষের প্রথম পোষ মানা গৃহপালিত পশু।
পাখিদের মধ্যে, প্রধান গৃহপালিত প্রজাতি হল মুরগি, মাংস এবং ডিমের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, যদিও অর্থনৈতিকভাবে মূল্যবান মুরগির মধ্যে রয়েছে টার্কি, গিনিফাউল এবং অন্যান্য অনেক প্রজাতি। যা মানুষের খাদ্য সঞ্চয় ও সংরক্ষণ বিদ্যার প্রাথমিক চর্চা। এদের সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক নাই।
তখন গানের পাখি তোতা থেকে ঈগল পর্যন্ত পাখিদের পোষ মানানো হয়। দীর্ঘতম প্রতিষ্ঠিত অমেরুদণ্ডী গৃহপালিত প্রাণী হল মধু মৌমাছি এবং রেশম পোকা।
তখন শামুককে খাবারের জন্য উঠানো হয়। তখনকার মানুষ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীকে সংরক্ষণ করতো, পর্যবেক্ষণ করতো এবং প্রজননের মাধ্যমে নিজেদের সম্পদ বৃদ্ধি করতো। এগুলোর সাথে জড়িত গার্হস্থ্য অর্থনীতি, ধর্ম নয়। বরং ধর্মের শেকড়গুলি উদ্ভূত হয়েছে গার্হস্থ্য এবং কৃষি অর্থনীতি বিকাশের বহু পরে।
প্রথম বৃক্ষরোপণ অন্তত ১২,০০০ বছর আগে, মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়াল বৃক্ষ এবং এশিয়ায় বোতল করলা বৃক্ষ দিয়ে শুরু হয়েছিল। বিশ্বজুড়ে অন্তত ১১টি ভিন্ন কেন্দ্রে কৃষির বিকাশ ঘটেছে, বিভিন্ন শস্য ও পশুপালন করা হয়েছে।
ছাগল ছিল সম্ভবত প্রথম পশু যারা গৃহপালিত হয়েছিল, তার পরে ভেড়া।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, প্রায় ১০,০০০ বছর আগে মুরগিও গৃহপালিত হয়েছিল। পরে, লোকেরা লাঙ্গল চাষ এবং পরিবহনের জন্য গরু বা ঘোড়ার মতো বড় প্রাণী পালন করতে শুরু করে।
মানুষের টিকে থাকার এই সংগ্রামে ধর্ম কিংবা ধর্মের পুরোহিত মানুষকে কোন সাহায্য করেনি। কেননা, তখন কোন ধর্মেরই জন্ম হয়নি। এগুলোর সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক নাই। ধর্মগ্রন্থ হতে এ ধরনের কোন তথ্যই মানুষ পাইনি। যারা বলে ধর্মগ্রন্থ হতে বিজ্ঞানের জন্ম হয়েছে তারা মূর্খ। তাদের সাথে ইতিহাস, বিজ্ঞান ও গণিতের কোন সম্পর্ক নাই। বরং কৃষি অর্থনীতি প্রতিষ্ঠাতার পর মোল্লা পুরোহিতরা একটি পরগাছা প্রজাতি হিসেবে আবির্ভূত হয়।
প্রাচীন মানুষের প্রযুক্তি আবিষ্কার, যার সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক নাই…
ওয়েজ এবং আঁকানো সমতল (র্যাম্প) যা প্রাগৈতিহাসিক আমল থেকেই পরিচিত ছিল। চাকা এবং এক্সেল মেকানিজমসহ মেসোপটেমিয়া (আধুনিক ইরাক) ৫ম সহস্রাব্দ বিসি-তে আবিষ্কৃত হয়েছিল। লিভার মেকানিজম প্রথম প্রায় ৫,০০০ বছর আগে কাছাকাছি পূর্বে আবির্ভূত হয়েছিল, যেখানে এটি একটি সাধারণ ভারসাম্য স্কেলে এবং প্রাচীন মিশরীয় প্রযুক্তিতে বড় বস্তুগুলিকে সরানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল।
লিভারটি শ্যাডুফ ওয়াটার-লিফটিং ডিভাইসেও ব্যবহার করা হয়েছিল, প্রথম ক্রেন মেশিন, যা মেসোপটেমিয়া আনুমানিক ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এবং তারপরে প্রাচীন মিশরীয় প্রযুক্তিতে ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আবির্ভূত হয়েছিল। পুলির প্রাচীনতম প্রমাণ মেসোপটেমিয়ায় ২য় সহস্রাব্দের শুরুর দিকে, এবং দ্বাদশ রাজবংশের সময় (১৯৯১-১৮০২খ্রিস্টপূর্ব) প্রাচীন মিশরে। স্ক্রু, উদ্ভাবিত হয়েছিল মেসোপটেমিয়ায় নব্য-অ্যাসিরিয়ান যুগে (৯১১-৬০৯) খ্রিস্টপূর্বাব্দে।
গিজার গ্রেট পিরামিডের মতো কাঠামো তৈরি করতে মিশরীয়রা তিনটি প্রযুক্তি ব্যবহার করে। সেগুলো হলো- ঝুঁকে থাকা সমতল, ওয়েজ এবং লিভার। এই তিনটি প্রযুক্তি প্রাচীন ৬টি বিস্ময়কর প্রযুক্তির মধ্যে অন্যতম ছিল।
অ্যাসিরিয়ানরা তাদের ধাতুবিদ্যার ব্যবহার এবং লোহার অস্ত্র তৈরিতে পারদর্শী ছিল। তাদের অনেক অগ্রগতি ছিল সামরিক সরঞ্জাম উদ্ভাবনে। তারা চাকা এবং রথের উন্নতি করেছিল। তারা তাদের ওয়াগনগুলিতে পিভট-সক্ষম অ্যাক্সেল ব্যবহার করেছিল, যা সহজে বাঁক নেওয়ার সুবিধা ছিল। তারা ছিল প্রথম সৈন্যদের মধ্যে একটি, যা নড়াচড়া করতে সক্ষম সিজ টাওয়ার এবং ব্যাটারিং রাম ব্যবহারে দক্ষ।
এই প্রযুক্তিগুলো আবিষ্কার হয়েছিল প্রচলিত ধর্ম কিংবা ধর্ম গ্রন্থগুলি লেখার বহু আগে। যার সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক ছিল না। তবে এর সম্পর্ক ছিল উন্নত নগরায়ন ও সভ্যতার বিকাশের ক্ষেত্রে।
প্রাচীন যান্ত্রিক প্রকৌশলের বিবরণ বিভিন্ন প্রাচীন চিত্রলিপির বিবরণের দেখা যায়। যেখানে কোন যন্ত্রের আবিষ্কার কোন ধর্মগ্রন্থ হতে হয়েছে এ সম্পর্কে কোন তথ্য নেই! যেমন-
পুলি ১,৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মেসোপটেমিয়ায় আবির্ভূত হয়েছিল, যা জল পরিবহনের উন্নতি করেছিল। জার্মান প্রত্নতাত্ত্বিক রবার্ট কোলডেউই খুঁজে পেয়েছেন যে ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যানগুলি সম্ভবত ছাদের বাগানে জল পরিবহনের জন্য এই পুলি দ্বারা চালিত একটি যান্ত্রিক পাম্প ব্যবহার করেছে৷
মেসোপটেমিয়ানরা ১২,০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে “অন্তরন্ত গতির জন্য অবিরাম প্রতিস্থাপন এবং পিছনে-আগামী গতির জন্য ঘূর্ণন” প্রতিস্থাপন করে আরও এগিয়ে যাবে।
সাকিয়া : খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দীতে কুশ রাজ্যে গড়ে উঠেছিল। এটি শ্রম ও সময় কম খরচ করে ৩ থেকে ৮ মিটার পানি উত্তোলন করেছে। প্রাচীন কুশে জল সঞ্চয় এবং সেচ বৃদ্ধির জন্য হাফির আকারে জলাধার তৈরি করা হয়েছিল।
প্রাচীন মেরোতে খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে ব্লুমরি এবং ব্লাস্ট ফার্নেস তৈরি করা হয়েছিল। উন্নত ত্রিকোণমিতির আকারে কুশিটে সানডিয়াল গণিত প্রয়োগ করে।
প্রাচীন মিশরে, স্ক্রু পাম্প হল জল পরিবহনের দক্ষতা বাড়াতে প্রকৌশল! যদিও মিশরীয়রা প্রাথমিক পিরামিডের মতো বিশাল কাঠামো তৈরি করেছিল, তারা ভারী পাথর উত্তোলনের জন্য পুলি তৈরি করেনি এবং চাকা খুব কম ব্যবহার করেছিল।
প্রাচীনতম ব্যবহারিক পানিচালিত মেশিন, ওয়াটার হুইল এবং ওয়াটারমিল, পার্সিয়ান সাম্রাজ্যে, বর্তমানে ইরাক ও ইরানে, খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দীর প্রথম দিকে দেখা যায়।
চিন্তা করতে পারেন, বর্তমানে প্রচলিত ধর্মগ্রন্থ গুলোর জন্মের বহু আগেই মানুষ আধুনিক যন্ত্রপাতিগুলো আবিষ্কার করেছিল, যার সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক নাই! যারা বলে, ধর্মগ্রন্থ দেখে বিজ্ঞানের আবিষ্কার হয়েছে তারা মূর্খের রাজ্যে বাস করে।
প্রাচীন গ্রীসে, আর্কিমিডিস (২৮৭-২১২ খ্রিস্টপূর্ব) যান্ত্রিক সুবিধা, লিভারের আইন এবং তার নাম অনুসারে, আর্কিমিডিসের আইন সহ যান্ত্রিক প্রকৌশলের ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি মূল তত্ত্ব তৈরি করেছিলেন। টলেম্যাটিক মিশরে, আলেকজান্দ্রিয়ার জাদুঘর পাথর তোলার জন্য ব্লক এবং ট্যাকল সহ ক্রেনের পুলি তৈরি করেছে। এই ক্রেনগুলি মানুষের চাকার চাকা দ্বারা চালিত ছিল এবং এটি পূর্ববর্তী মেসোপটেমিয়ার জল-পুলি সিস্টেমের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছিল।
গ্রীকরা চীনাদের থেকে স্বাধীনভাবে যান্ত্রিক কামান তৈরি করে। এর মধ্যে প্রথমটি ডার্ট ফায়ার। এগুলির অগ্রগতির ফলে শত্রুর দুর্গ, প্রাসাদে বা গঠনে পাথর নিক্ষেপ করে যুদ্ধে জয়ি হওয়া সম্ভব হয়েছিল।
গিয়ারযুক্ত অ্যান্টিকিথেরা মেকানিজম হল প্রাচীন যান্ত্রিক প্রকৌশলের একটি বিস্ময়কর উদাহরণ!
এই যন্ত্রটি আজও রহস্যময়! এমন জটিল যন্ত্রগুলি আবিষ্কার হয়েছে প্রচলিত ধর্মগ্রন্থগুলো জন্মের বহু আগে! যার সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক নাই। তবে এর সাথে মানুষের সম্পর্ক ছিল মানবজাতির ভবিষ্যৎ অগ্রগতির। যা ধর্মের কারণে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিলো।
অতএব, ধর্মগ্রন্থ হতে বিজ্ঞানের জন্ম হয়নি। বরং মানুষের উদ্ভাবনী ক্ষমতা দিয়েই মানুষ বিজ্ঞানের আবিষ্কারগুলো করে।
আরেকটি কথা, মানুষের লোকবিশ্বাস এবং ধর্মগুলিও মানুষের উদ্ভাবনী শক্তি হতে মানুষ তৈরি করে। এর সাথে অলৌকিক কোন শক্তি জড়িত নয়। এগুলো মানুষের উদ্ভাবনী ক্ষমতার অংশ।
আজকাল প্রায়ই শুনি বেদ, বাইবেল, গীতা, কোরআন, ত্রিপিটক থেকে বিজ্ঞান এর জন্ম হয়েছে! কোরআনের তথ্য চুরি করে বিজ্ঞানীরা যন্ত্র আবিষ্কার করেছে! এসব কথা শুনলে বড় হাসি পায়! আফসোস হয়, মানুষ কতটা নির্লজ্জ হলে, মূর্খ হলে এ ধরনের কথা বলতে পারে। আসলে এগুলো মানুষের উদ্ভাবনী ক্ষমতার আবিষ্কার।
পাঠক আপনারাই এখন সিদ্ধান্ত নেন, বিজ্ঞান আগে এসেছে? না ধর্ম আগে এসেছে?
আপনার মতামত জানানঃ