বাংলাদেশে মাঝে-মধ্যেই পোশাকের কারণে নারীদের বিব্রত হবার ঘটনার খবর গণমাধ্যমে আসে। এমনকি নির্যাতনের শিকার হওয়া নারীকে উল্টো তার পোশাকের জন্য দায়ী করার প্রবণতাও দেখা যায়। সম্প্রতি কপালে টিপ পরা নিয়ে এক পুলিশ সদস্য একজন শিক্ষিকাকে হেনস্থা করার অভিযোগ নিয়েও তুমুল শোরগোল হয়েছিলো। এবার ঢাকা যাওয়ার পথে আধুনিক পোশাক পরায় এক তরুণীকে হয়রানি ও মারধরের অভিযোগ উঠেছে।
বুধবার (১৮ মে) নরসিংদী রেল স্টেশনে এ হামলার ঘটনা ঘটে। ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা।
তবে ঘটনার দুদিন অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত ভুক্তভোগীর পক্ষ থেকে কোনও অভিযোগ দায়ের হয়নি বলে জানা গেছে।
জানা যায়, আধুনিক পোশাক পরার কারণে ভুক্তভোগী তরুণীর সঙ্গে এক নারী যাত্রী বাগবিতণ্ডায় লিপ্ত হন। একপর্যায়ে তরুণী ও তার দুই বন্ধু অন্য যাত্রীদের হামলার শিকার হন। পরে তারা স্টেশন মাস্টারের কক্ষে আশ্রয় নেন।
স্থানীয়রা জানান, গত বুধবার রেলওয়ে স্টেশনের ১ নং প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী ঢাকা মেইল ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন এক তরুণী ও তার দুই বন্ধু। এ সময় স্টেশনে অবস্থানরত মাঝবয়সী এক নারী তাদের দেখে বাজে মন্তব্য করে। ওই তরুণী সেটার জবাব দিলে ওই নারীর সঙ্গে তর্ক হয়। এক পর্যায়ে ওই নারী তরুণীর গায়ে হাত তুলতে গেলে তার দুই বন্ধু প্রতিবাদ করেন। তখন স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন বখাটে তরুণীর দুই বন্ধুর সঙ্গে তর্কে জড়ায় এবং তাদের মারতে যায়। এক পর্যায়ে তারা তিনজন স্টেশন মাস্টারের কক্ষে গিয়ে রক্ষা পান।
এ ঘটনার একটি ভিডিও ওইদিনই ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। পরে রেলওয়ে স্টেশনের ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার ফুটেজ দেখে নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশন এলাকা থেকে একজনকে আটক করে পুলিশ। আটক ওই যুবকের নাম মো. ইসমাইল ইসলাম (৩৫)। তিনি নরসিংদী সদর উপজেলার নজরপুর ইউনিয়নের বুদিয়ামারা এলাকার মৃত বাদল মিয়ার ছেলে।
তবে ঘটনার সময় ইসমাইল ইসলামের ভূমিকা কি ছিল, সে সম্পর্কে পুলিশ কিছু জানায়নি।
ভুক্তভোগীরা ঢাকা থেকে নরসিংদী বেড়াতে এসেছিলেন বলে ধারণা পুলিশের। তবে এখনও পর্যন্ত তাদের বিস্তারিত পরিচয় জানতে পারেনি পুলিশ।
নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশন সূত্রে জানা যায়, বুধবার ভোর সোয়া পাঁচটার দিকে নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশনে আসেন ওই তরুণী ও দুই তরুণ। সকাল পৌনে ছয়টা পর্যন্ত স্টেশনটির ১ নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে তাঁরা ঢাকাগামী ঢাকা মেইল ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এ সময় স্টেশনে মধ্যবয়সী এক নারী ওই তরুণীকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘এটা কী পোশাক পরেছো তুমি’। তরুণীও পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘আপনার তাতে কী সমস্যা হচ্ছে?’ এ নিয়ে তাদের মধ্যে বাগবিতণ্ডা শুরু হয়। এর মধ্যে সেই বিতর্কে যোগ দেন স্টেশনে অবস্থানরত অন্য কয়েকজন ব্যক্তি।
ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটিতে দেখা যায়, ওই তরুণীকে ঘিরে রেখেছে একদল ব্যক্তি। এর মধ্যেই এক নারী উত্তেজিত অবস্থায় তার সঙ্গে কথা বলছেন। বয়স্ক এক ব্যক্তিও তার পোশাক নিয়ে কথা বলছেন। একপর্যায়ে ওই তরুণী সেখান থেকে চলে যেতে উদ্যত হলে ওই নারী দৌড়ে তাকে ধরে ফেলেন। এ সময় অশ্লীল গালিগালাজ করতে করতে তার পোশাক ধরে টান দেন ওই নারী। কোনোরকমে নিজেকে সামলে দৌড়ে স্টেশনমাস্টারের কক্ষে চলে যান তরুণী।
গায়ে হাত তোলা তো দূরের কথা, অপমান করার অধিকারও সংবিধান কাউকে দেয়নি। তালিবান শাসনের মতো করে নারীদের দেখার প্রবণতা বাড়ছে।
এ সময় তার সঙ্গে থাকা দুই তরুণকেও মারধর করতে দেখা যায় ঘটনাস্থলে থাকা কয়েকজন ব্যক্তিকে। পরে তারাও দৌড়ে স্টেশনমাস্টারের কক্ষে চলে যান। পরে ভুক্তভোগী তরুণী জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯-এ ফোন দিলে নরসিংদী মডেল থানার পুলিশ রেলস্টেশনে এসে তাঁদের ঢাকার ট্রেনে উঠিয়ে দেয়।
স্টেশন মাস্টার নাইয়ুম মিয়া সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ঘটনার সময় আমি নিজ রুমে কাজে ব্যস্ত ছিলাম। সে সময় স্টেশনে হইচই শুনে দরজায় গিয়ে দেখি হামলার শিকার ওই তরুণী ও তার সঙ্গী আরও দুই তরুণ দৌড়ে আমার রুমের দিকে আসছে। পরে তাদের আমার রুমে আশ্রয় দেই। খবর দিলে তাৎক্ষণিকভাবে জিআরপির লোকজন এসে তাদের ঢাকাগামী মেইল ট্রেনে উঠিয়ে দেন।
নরসিংদী রেলওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই ইমায়েদুল জাহেদী বলেন, ‘ভুক্তভোগী তরুণী ও তার সঙ্গে থাকা তরুণদের নাম-ঠিকানা জানা যায়নি। তবে তারা চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী ট্রেনের যাত্রী ছিলেন। নরসিংদী রেল স্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষায় ছিলেন তারা। এরই মধ্যে জিন্স ও টপস পরা নিয়ে স্টেশনে অপেক্ষারত এক নারীর সঙ্গে তরুণীর বাগবিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে তরুণীকে হেনস্তা করেন ওই নারী। তরুণীর সঙ্গে থাকা দুই তরুণ প্রতিবাদ করলে পাশ থেকে কয়েকজন যুবক এসে তাদের মারধর করেন। মারধরকারীদেরও নাম-ঠিকানা জানা যায়নি। পরে স্টেশন মাস্টারের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। এরপর তাদের ঢাকাগামী ট্রেনে উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তেলের কালোবাজারি নয়, ব্যাংক লুটের মহাজন নয়, মানুষ-মারা খুনি নয়; তারা মেরেছে এমন একটা মেয়েকে, যার পোশাক তাদের পছন্দ হয়নি। আসল কথা হলো, সবলের দ্বারা দুর্বলের ওপর অত্যাচার। মেয়েটি ক্ষমতাবান পরিবারের কেউ হলে হামলাকারীরা নির্ঘাত উদাস হয়ে যেত।
তারা বলেন, সবার রুচি এক নয়। তা হওয়ার দরকারও নেই। আলাদা রুচির লোক দেখলে যদি আমাদের অনুভূতি আহত হয়, যদি তাকে মারার ইচ্ছা হয়, তাহলে আমরা যখন চিকিৎসা নিতে ভারতে যাই, বেড়াতে যাই নেপালে, কিংবা কাজের সন্ধানে ইউরোপে গিয়ে হাজির হই; তখন কোথায় থাকে সেই রুচির অহংকার, অনুভূতি সুরক্ষার দাপট?
তারা বলেন, গায়ে হাত তোলা তো দূরের কথা, অপমান করার অধিকারও সংবিধান কাউকে দেয়নি। তালিবান শাসনের মতো করে নারীদের দেখার প্রবণতা বাড়ছে।
তারা আরও বলেন, কেউ কেউ বলছেন, ঘটনাটা সাজানো হয়ে থাকতে পারে। সামনে যখন নির্বাচনপূর্ব কালবৈশাখী সময়, তখন অনেক কিছুই হতে পারে। সন্দেহ করা সত্য জানার শর্ত। শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে ছাত্রদের উসকানির পেছনে ধর্মীয় কারণ যত না, তার চেয়ে বেশি দেখা গেছে অন্য কিছু শিক্ষকের পেশাগত ঈর্ষা। তাই নিরপেক্ষ তদন্ত জরুরি।
নরসিংদী স্টেশনে কে উসকানি দিয়েছিল, কারা মারার জন্য তৈরি হয়েছিল; সেটা বের করা দরকার। তাদের শাস্তি না হলে এ রকম ঘটনা ঘটার হার বেড়ে যাবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫৫
আপনার মতামত জানানঃ