আরেকটা শ্রীলঙ্কা হওয়ার পথে কি বাংলাদেশ? এই প্রশ্ন এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। যদিও আওয়ামীলীগ পন্থিরা তা মানতে নারাজ। বরং যারা এমন প্রশ্ন তুলছে, তাদের কোনপ্রকার চিন্তাভাবনা বাদেই দেশদ্রোহী, দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী বা বিএনপি ঘরানায় ফেলে দেওয়া হচ্ছে। তবে এই প্রশ্নের পালে নিত্য নতুন হাওয়া লেগেই আছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, টাকার মান পড়ে যাওয়া, শেয়ারবাজারে অস্থিরতা, মুদ্রাস্ফীতি, ভোজ্য ও জ্বালানি তেল নিয়ে জনগণের নাভিশ্বাস, ঋণ পরিশোধে ইয়োলো জোন – এমন অসংখ্য পরিস্থিতি আমাদের ঠেলে দিচ্ছে একটাই প্রশ্নের দিকে। আর সেটা হলো-আরেকটা শ্রীলঙ্কা হওয়ার পথে কি বাংলাদেশ?
এরই মধ্যে এবার বিদ্যুতের দাম পাইকারি পর্যায়ে গড়ে প্রায় ৫৮ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) গঠিত কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি। এই সুপারিশ ও গণশুনানির ভিত্তিতে কমিশন দাম বাড়ানোর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।
বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ানো হয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) জন্য। পিডিবি গ্রাহক পর্যায়ে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই দামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। কারিগরি কমিটি তাদের সুপারিশে বলেছে, ভোক্তা পর্যায়ে দাম না বাড়ালে পাইকারি মূল্যহার কার্যকর করা সম্ভব হবে না।
বিইআরসির কারিগরি কমিটি যে ৫৮ শতাংশ দাম বাড়ানোর সুপারিশ করেছে, তা জানানো হয় গতকাল বুধবার কমিশন আয়োজিত গণশুনানিতে। এর আগে পিডিবি বিদ্যুতের পাইকারি দাম ৬৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ বাড়াতে বিইআরসির কাছে প্রস্তাব দিয়েছিল। তবে গতকালের গণশুনানিতে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব ও সুপারিশ তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়ে।
উল্লেখ্য, গত ১২ বছরে দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। এ সময় পাইকারি পর্যায়ে ১১৮ শতাংশ ও গ্রাহক পর্যায়ে ৯০ শতাংশ বেড়েছে বিদ্যুতের দাম।
দাম বাড়ানোর কারণ
পিডিবি প্রস্তাবে তাদের বলেছে, উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে বিক্রি করায় গত অর্থবছরে (২০২০-২১) তাদের ১১ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। উৎপাদন ব্যয়ের কমে বিদ্যুৎ বিক্রি করায় চলতি অর্থবছরে তাদের লোকসান হতে পারে ৪০ হাজার কোটি টাকা। তবে চলতি অর্থবছরে এপ্রিল পর্যন্ত পিডিবি সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি পেয়েছে ১০ হাজার ৭১০ কোটি টাকা। বিইআরসির কারিগরি কমিটি যে ৫৮ শতাংশ দাম বাড়ানোর সুপারিশ করেছে, যা ভর্তুকি ছাড়া।
পিডিবি আরও বলছে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। গত জুন থেকে ফার্নেস অয়েলে সরকার ঘোষিত
আমদানি শুল্ক–কর কার্যকর হয়েছে। এতে খরচ বেড়েছে ৩৪ শতাংশ। গত জুলাই থেকে কয়লার ওপর ৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) আরোপ করা হয়েছে। কয়লার দামও বিশ্ববাজারে বেড়েছে। গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে। লোকসানের বোঝা কমাতেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানো দরকার।
অপরিকল্পিত উন্নয়ন জনগণের বোঝা
পিডিবির বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাড়তি ব্যয় নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে। একটি প্রশ্ন হলো, বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা বিপুলভাবে বাড়িয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসিয়ে রাখা ও ভাড়া দেওয়া নিয়ে।
সরকারের সংস্থা পাওয়ার সেলের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা ২৫ হাজার ৫৬৬ মেগাওয়াট (ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্যসহ)। বিপরীতে সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট (গত ১৬ এপ্রিল)। চুক্তি এমন যে, বেসরকারি খাতের বেশির ভাগ বিদ্যুৎকেন্দ্রকে উৎপাদন না করলেও ভাড়া (ক্যাপাসিটি চার্জ) দিতে হয়। গত এক দশকে ৭০ হাজার কোটি টাকার বেশি গেছে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়ায়।
কেউ কেউ বলছেন, অনুসন্ধান ও উৎপাদনে জোর না দিয়ে চড়া দামের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করা হচ্ছে। বাড়তি খরচের এ বোঝা চাপছে গ্রাহকের ওপর।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) গত মার্চে এক পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলেছে, সরকারি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র আনতে না পারায় বেসরকারি খাতের স্বল্প মেয়াদের ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র মেয়াদ শেষেও চালু রাখতে হয়েছে। ৯২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার এমন ১২টি স্বল্পমেয়াদি বিদ্যুৎকেন্দ্র এখনো চালু আছে।
হিসাবের গোঁজামিল
কারিগরি কমিটির মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বেশ কিছু অসংগতি চিহ্নিত করে গতকাল গণশুনানিতে দাম বাড়ানো নিয়ে প্রশ্ন তোলে ক্যাব। তারা বলছে, গ্যাসের দাম এখনো বাড়ানো হয়নি। অথচ গ্যাসের দাম সাড়ে ২২ শতাংশ বাড়তি ধরে পিডিবির খরচ হিসাব করা হয়েছে।
এর আগে দাম বাড়ানোর সময় কুইক রেন্টালের মেয়াদ না বাড়ানোর নির্দেশনা ছিল কমিশনের। সেটি না মেনে সম্প্রতি পাঁচটি কুইক রেন্টালের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এসব কেন্দ্রের খরচ হিসাব করেছে কারিগরি কমিটি।
ক্যাব ফার্নেস অয়েলে শুল্ক ও কর অব্যাহতি সুবিধা প্রত্যাহার এবং কয়লায় ভ্যাট আরোপকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয় বাড়ার কারণ হিসেবে তুলে ধরে। সংগঠনটি আরও বলেছে, বিদেশ থেকে কয়লা দিয়ে উৎপাদিত বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে প্রতি ইউনিট ৬ টাকা ৬০ পয়সায়। আর দেশে কয়লা থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের খরচ পড়ছে ৮ টাকা ৭১ পয়সা। ভোলায় পিডিবির বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো হচ্ছে মাত্র ৩৮ শতাংশ ‘প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরে’। এতে উৎপাদন ব্যয় দ্বিগুণ পড়ছে।
বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে রাখার বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে পিজিসিবির সংস্থা ন্যাশনাল লোড ডেসপ্যাচ সেন্টার (এনএলডিসি)। এদের বিরুদ্ধে ক্যাবের অভিযোগ, তারা কম দক্ষতার কেন্দ্র চালিয়ে উৎপাদন খরচ বাড়াচ্ছে। এ বিষয়ে পিজিসিবির প্রতিনিধি শুনানিতে বলেন, পিডিবির পাঠানো তালিকা অনুসারে বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে রাখা হয়। জ্বালানিসংকট হলে তালিকায় এদিক-ওদিক হয়। পিডিবিকে জানিয়ে করা হয়। তবে পিডিবির প্রতিনিধি বলেন, তাদের জানানো হয় না।
বিকল্প প্রস্তাব
দাম না বাড়িয়ে পিডিবির ঘাটতি মোকাবিলার কিছু উপায় জানিয়েছে ক্যাব। তারা হিসাব দিয়ে দেখিয়েছে, পাইকারি পর্যায়ে ৪০ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি সমন্বয় করেও ৩ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত রাখা সম্ভব।
এর জন্য কয়েকটি খাতে ব্যয় সাশ্রয়ের পথ দেখানো হয়েছে, যা হলো উৎসে কর আরোপ না করা, তেলে শুল্ক-কর অব্যাহতি সুবিধা ফিরিয়ে দেওয়া, কয়লার ভ্যাট প্রত্যাহার, বেসরকারি খাতের বদলে সরকারিভাবে তেল আমদানি করা, ‘অবৈধ’ভাবে বাড়ানো জ্বালানি তেলের দাম বাতিল করা, কুইক রেন্টাল থেকে ‘অবৈধ’ভাবে কেনা বিদ্যুতের মূল্য হিসাব না করা, অধিক দক্ষতার কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্র বেশি প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরে চালানো, সরাসরি গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ নেওয়া সব গ্রাহকের মূল্যহার অভিন্ন করা এবং পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির পাইকারি মূল্যহার যৌক্তিক করা।
ক্যাবের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম শামসুল আলম বলেন, ভর্তুকি প্রদান না করে এবং খরচ কমানোর যথাযথ পদক্ষেপ না নিয়ে অন্যায়, অযৌক্তিক ও লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। ক্যাবের প্রস্তাব বিবেচনা করলে দাম বাড়ানো লাগবে না। গ্রামে এখনো লোডশেডিং হচ্ছে। প্রয়োজনে পরিকল্পিতভাবে লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
সংশ্লিষ্টদের মতামত
গণশুনানিতে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংগঠনের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী। দেশের সাড়ে তিন কোটি ব্যবসায়ীর পক্ষ থেকে মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব গ্রহণ না করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, এটি সরকারকে অজনপ্রিয় করার চেষ্টা।
এফবিসিসিআইয়ের লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, বিদ্যুতের দক্ষ ব্যবহার, সেবার মান, জ্বালানি পরিচালনা, আন্তর্জাতিক মান ও কৌশল অনুসরণে পিডিবি ব্যর্থ। জ্বালানির ওপর আরোপিত করভার ভোক্তাসহ দেশের উৎপাদনশীল কাজের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা বিধ্বংসী ও আত্মঘাতী। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব কোনোভাবেই বিবেচনাযোগ্য নয়। বিদ্যুতের দাম বাড়লে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পণ্যের দাম বাড়াতে বাধ্য হবে। এতে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে।
এমসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি নিহাদ কবির বলেন, করোনার পর রাশিয়া-ইউক্রেন পরিস্থিতি মিলে খাদ্যমূল্যস্ফীতি এখন বড় সমস্যা। এ সংকটের সময় দাম বাড়ানোর প্রস্তাবটি যৌক্তিক নয়।
শুনাতিতে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ইজাজ হোসেন। তিনি বলেন, কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ঠিক সময়ে এলে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিতে হতো না।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬১০
আপনার মতামত জানানঃ