প্রথমে বাবরি, পরে জ্ঞানবাপী আর এখন আগ্রা জামে মসজিদ। ভারতে একটার পর একটা ঐতিহাসিক মসজিদ টার্গেট করা হচ্ছে। ভারতের উত্তর প্রদেশের বারাণসিতে একটি মসজিদকে কেন্দ্র করে আদালতে মামলা চলছে। হিন্দুত্ববাদী একটি নারীগ্রুপ দীর্ঘদিন ধরে ওই মসজিদ চত্বরে প্রার্থনা করার দাবি জানিয়ে আসছেন।
এ নিয়ে মামলার এক পর্যায়ে জ্ঞানবাপী মসজিদ চত্বরে তিনদিনের জন্য ভিডিওগ্রাফি সার্ভের জন্য অনুমোদন দেয় কোর্ট। এ নিয়ে পরবর্তী শুনানির একদিন আগে জরিপ সম্পন্ন হয়। এতে হিন্দুত্ববাদী আবেদনকারীরা বিস্ময়কর এক দাবি করেন। তারা বলেন, ওই মসজিদ চত্বরে যে পুকুর আছে সেখানে একটি শিবলিঙ্গ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতায় বারানসির আদালত ওই এলাকা জনগণের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে। এ খবর দিয়েছে ভারতের অনলাইন এনডিটিভি।
বেনারসের কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের সংলগ্ন জ্ঞানবাপী মসজিদ নিয়ে বহুদিন ধরে নানা তর্ক বিতর্ক চলছে। এই নিয়ে কমিটি গড়া হয়েছিল। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়।
হিন্দুত্ববাদী নারী গ্রুপটির পক্ষে আইনজীবী সুভাষ নন্দন চতুর্বেদী আদালতকে সোমবার সকালে জানিয়েছেন যে, মসজিদ চত্বরে অবস্থিত পুকিরের পানি সেচে ফেলে দেয়ার পর তাতে একটি শিবলিঙ্গ পাওয়া গেছে।
মসজিদের মুসল্লিরা ওজু করার জন্য এই পুকুরের পানি ব্যবহার করতেন। সেখানে শিবলিঙ্গ পাওয়ার পর পুকুরটি সিল করে দিতে বা বন্ধ করে দিতে আদালতের কাছে অনুরোধ করেন আবেদনকারীরা
মসজিদের মুসল্লিরা ওজু করার জন্য এই পুকুরের পানি ব্যবহার করতেন। সেখানে শিবলিঙ্গ পাওয়ার পর পুকুরটি সিল করে দিতে বা বন্ধ করে দিতে আদালতের কাছে অনুরোধ করেন আবেদনকারীরা
বারানসি ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট সেই আবেদন গ্রহণ করে ওই পুকুরটি যাতে কেউ এখন আর ব্যবহার করতে না পারেন, তা নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছেন। আদালত আরও বলে, সিল করে দেয়া এলাকায় কেউ যাতে প্রবেশ করতে না পারেন, তা নিশ্চিত করবেন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ প্রধান এবং সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্সের শীর্ষ স্থানীয় কর্মকর্তারা।
তবে এর আগে মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলেন বারানসি ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট কৌশাল রাজ শর্মা। সে সময় ওই মসজিদ কমপ্লেক্সে শিবলিঙ্গ পাওয়ার বিষয় নিশ্চিত করেননি তিনি। বলেন, এ বিষয়ে যে কমিশন গঠন করা হয়েছিল তার কোনো সদস্যই জ্ঞানবাপী মসজিদে জরিপের বিস্তারিত প্রকাশ করেননি। জরিপের বিষয়ে কাস্টডিয়ান হলো আদালত। রোববার কয়েক মিনিটের জন্য কমিশন থেকে একজন সদস্যকে বাদ দেয়া হয়েছিল। পরে কমিশন এটা স্বীকার করে।
ঐতিহ্যবাহী কাশি বিশ্বনাথ মন্দিরের কাছেই অবস্থিত জ্ঞানবাপী মসজিদ। সেখানে বিভিন্ন স্থানে দৃশ্যমান ও অদৃশ্য যেসব দেবদেবীর প্রতিকৃতি আছে তাদের সামনে প্রতিদিন প্রার্থনা করার অনুমতি চেয়ে আবেদন করেন ৫ হিন্দু নারী। স্থাপনাটি বর্তমানে বছরে একবারের জন্য প্রার্থনার জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়। আবেদনের প্রেক্ষিতে বারাণসি সিভিল কোর্ট তিনটি ডোম, আন্ডারগ্রাউন্ড বেজমেন্ট এবং পুকুরে ভিডিও জরিপ চালানোর নির্দেশ দেয়। এ জন্য তারা একটি কমিশন গঠন করে দেয়।
এই জরিপ শুরু হয় ৬ই মে। কিন্তু মসজিদের ভিতরে ভিডিও ধারণ করা নিয়ে বিরোধে তা থমকে যায়। মসজিদ কমিটির দাবি, মসজিদের ভিতরে ভিডিও ধারণ করার নির্দেশ দেয়নি আদালত। আদালতের এই ভিডিও ধারণের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয় এলাহাবাদ হাইকোর্টে। এই আদালত এপ্রিলে মামলাটি খারিজ করে দেয়। কিন্তু হাইকোর্টের এই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয় সুপ্রিম কোর্টে। সুপ্রিম কোর্ট ভিডিও ধারণ বন্ধ করতে অস্বীকৃতি জানায়। মসজিদ কমপ্লেক্সের ভিতরে জরিপে যেসব জিনিস পাওয়া যায় তা বিবেচনায় নিতে সম্মত হয়।
প্রসঙ্গত, হিন্দুত্ববাদীদের দাবি, জ্ঞানবাপী মসজিদ যে জমিতে গড়ে উঠেছে, তা আদতে হিন্দুদের। সুতরাং সেই জমি হিন্দুদের ফিরিয়ে দেওয়া হোক। মুঘল সম্রাট অওরঙ্গজেব দু’হাজার বছরের পুরনো কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের একাংশ ধ্বংস করে সেখানে মসজিদ গড়ে তোলেন দাবি তুলে সেখানে ‘হিন্দুত্বের ছাপ’ খুঁজতে প্রত্নতাত্ত্বিক সমীক্ষার দাবি জানানো হয় আদালতে।
অন্য দিকে, জ্ঞানবাপী মসজিদ চত্বরে ‘দেবদেবীর মূর্তি’ আছে দাবি করে সেগুলি পুজো করার অনুমতি চেয়ে ২০২১-এ আদালতে একটি পৃথক আবেদন আবেদন করেন পাঁচ মহিলা। তারই জেরে গত বৃহস্পতিবার বারাণসীর জেলা আদালত জ্ঞানবাপী মসজিদের প্রত্নতাত্ত্বিক সমীক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছিল ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ (আর্কিওলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া)-কে। সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানানো হয়েছিল। কিন্তু তা খারিজ হয়ে যায়।
ভারতের সুপ্রাচীন শহর বারাণসী বা কাশী, যা এখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সংসদীয় কেন্দ্রও বটে, সেখানে হিন্দুদের কাশী বিশ্বনাথ মন্দির ও মুসলিমদের জ্ঞানবাপী মসজিদ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে বেশ কয়েকশো বছর ধরে।
দুই ধর্মের এই দুটি উপাসনালয়ের মাঝে অভিন্ন দেওয়াল পর্যন্ত আছে।
হিন্দুরা অনেকে বিশ্বাস করেন, মুঘল বাদশাহ আওরঙ্গজেবের হুকুমেই দুহাজার বছরের প্রাচীন কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের একটা অংশ ভেঙে ফেলে মসজিদ নিমির্ত হয়েছিল।
সেই জমি হিন্দুদের ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতেই বছরদেড়েক আগে আদালতে পিটিশন দাখিল করেন আইনজীবী বিজয়শঙ্কর রাস্তোগি।
রাস্তোগি বলছেন, ‘পুরো জ্ঞানবাপী পরিসর জুড়েই আগে স্বয়ম্ভূ বিশ্বেশ্বর শিবের জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির ছিল’।
‘ধর্মীয় বিদ্বেষের কারণে ১৬৬৯ সালে বাদশাহ আওরঙ্গজেব সেই মন্দির ভেঙে ফেলার ফরমান জারি করেন, তবে সেই ফরমানেও কোথাও মসজিদ গড়ার কথা বলা ছিল না’।
ভারতে রামমন্দির আন্দোলনের সময় হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলোর খুব জনপ্রিয় স্লোগান ছিল, ‘ইয়ে তো সির্ফ ঝাঁকি হ্যায়, কাশী-মথুরা বাকি হ্যায়’!
যাতে প্রচ্ছন্ন হুঙ্কার ছিল, অযোধ্যায় মসজিদ ভেঙে রামমন্দির গড়ার পর তারা কাশী-মথুরাতেও মসজিদ দখলের অভিযানে নামবে।
জ্ঞানবাপী মসজিদের ভেতরে সার্ভের নির্দেশে সেই হুমকি বাস্তবায়নেরই চেষ্টা দেখতে পাচ্ছেন অনেক পর্যবেক্ষক।
তারা বলছেন, ভারতে অযোধ্যা বিতর্কের আর পুনরাবৃত্তি হবে না, সেই আশাতেও জল ঢেলে দিয়ে দেশের ভবিষ্যতের অগ্রযাত্রাকে অনিশ্চিত করে তুলতে পারে জ্ঞানবাপী মসজিদ নিয়ে বিতর্কিত ঘটনা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৫৫
আপনার মতামত জানানঃ