বাংলাদেশি শ্রমিকদের সমুদ্রপথে বৈধভাবে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ নেই। দেশের আইন অনুযায়ী তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছাড়া তাদের আর কোনো বহির্গমন পথ নেই। প্রতারকচক্র সবকিছু জেনেও সাধারণ মানুষকে উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে সমুদ্রপথে পাঠানোর নামে ঠেলে দিচ্ছে মৃত্যুর মুখে।
অবৈধভাবে সমুদ্রপথে যাত্রা করে স্বপ্নের দেশে নোঙ্গর করে না অনেক সমুদ্রযান। দালালদের খপ্পরে পড়ে অনেক মানুষের জীবন হয় বিপন্ন। টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিয়ে মাঝপথেই প্রতারকরা পালিয়ে গেছে, এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে।
প্রায়ই সংবাদ শিরোনাম হয় দালালের হাত ধরে ইতালি ও স্পেন প্রবেশের চেষ্টায় ভূমধ্যসাগরে ডুবে শত শত অভিবাসনপ্রত্যাশীর মৃত্যু। খবর আসে, আমেরিকায় যাওয়ার পথে বনে-জঙ্গলে দালালের অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তারা। ইউরোপে ঢোকার আশায় বলকানের বরফঢাকা জঙ্গলে হাজারো মানুষ মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে অপেক্ষায় থাকার সংবাদও আসে।
উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে তরুণদের অবৈধ পথে ইউরোপ যেতে রাজি করান দালালেরা। ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রাপথে প্রাণ হারাচ্ছেন অনেকে।
প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে জানা যায়, গত ২৫ জানুয়ারি ২০২২ লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালির ল্যাম্পেদুসা দ্বীপে যেতে নৌকায় চেপে বসেন ২৮৭ জন অভিবাসনপ্রত্যাশী। তাদের মধ্যে ২৭৩ জনই বাংলাদেশি। পথে প্রচণ্ড ঠান্ডায় জমে মারা যান বাংলাদেশি সাতজন। তাদের একজন সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জের মাহমুদপুর গ্রামের সাজ্জাদ আহমদ (২৫)।
এ বছরেরই ২ ফেব্রুয়ারি তুরস্ক-গ্রিস সীমান্তে হাড়কাঁপানো শীতে ১২ জন অভিবাসনপ্রত্যাশীর মৃত্যুর খবর আসে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। তাদের মধ্যে ছিলেন সুনামগঞ্জের জনি সরদার (৩৪), জুনেদ আহমদ (২২) ও আকাশ রায় (২৫)।
নিহত ওই চারজনই স্থানীয় দালালের মাধ্যমে অবৈধভাবে ইউরোপ যেতে দেশ ছেড়েছিলেন। তাদের মতো বহু তরুণ উন্নত জীবনের আশায় ইউরোপের মাটিতে পা রাখতে গিয়ে প্রাণ হারাচ্ছেন। সেই সঙ্গে দালালদের হাতে লাখ লাখ টাকা তুলে দিয়ে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলো আর্থিকভাবে নিঃস্ব হচ্ছে।
গণমাধ্যমের খবর ও স্থানীয় একাধিক সূত্র অনুযায়ী, ২০১৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত সিলেট বিভাগের চার জেলা—সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট ও হবিগঞ্জের ৩৬ জন ইউরোপ যাওয়ার পথে প্রাণ হারিয়েছেন। নিখোঁজ রয়েছেন অন্তত ২০ জন।
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, এমন মানব পাচারে সিলেট বিভাগে শতাধিক দালাল জড়িত। এর মধ্যে সিলেট জেলায় আছেন অর্ধশতাধিক দালাল। তারা অবৈধ ট্রাভেল ব্যবসায়ী ও বিদেশে থাকা পাচারকারীদের হয়ে কাজ করেন। এই দালালদের ফাঁদে পড়ছেন তরুণেরা।
অনেক ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা মামলা করেন না। স্থানীয় প্রশাসনকে তথ্যও দেন না। ফলে দোষীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন বলে জানা গেছে।
অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব) সিলেট শাখা সূত্র জানায়, বিভাগের চার জেলায় নিবন্ধিত ট্রাভেল এজেন্সি ২৫০টি। এর বাইরে চার থেকে পাঁচ শ অবৈধ ট্রাভেল এজেন্সি আছে। মূলত এসব অনিবন্ধিত এজেন্সিই মানব পাচারে জড়িত। ২০১৮ সালের ২ এপ্রিল আটাবের পক্ষ থেকে ৭৪টি অবৈধ ট্রাভেল এজেন্সির তালিকা জেলা প্রশাসনকে দেওয়া হয়েছিল।
অবৈধ ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে প্রশাসনের অভিযান চালানো উচিত বলে মনে করেন আটাব সিলেট অঞ্চলের চেয়ারম্যান মোতাহার হোসেন।
সিলেটের পুলিশ কমিশনার মো. নিশারুল আরিফ বলেন, আটাবের কাছ থেকে সম্প্রতি ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর একটা তালিকা সংগ্রহ করা হয়েছে। সেটা খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
গত তিন বছরে সিলেট বিভাগে মানব পাচারসংক্রান্ত ৭৩টি মামলা হয়েছে। পুলিশের সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি কার্যালয় সূত্র জানায়, এই ৭৩টি মামলার মধ্যে ৩২টি হয়েছে সিলেট মহানগরে। এসব মামলায় ২৬৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন ১২৭ জন।
তবে অনেক ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা মামলা করেন না। স্থানীয় প্রশাসনকে তথ্যও দেন না। ফলে দোষীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন বলে জানা গেছে।
পুলিশের সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি মফিজ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, এ–সংক্রান্ত যেকোনো ঘটনা ঘটলে পুলিশ নিয়মিত মামলা করার পাশাপাশি আসামি গ্রেপ্তার করে।
ভালো পারিশ্রমিকের আশায় কয়েক বছর ধরে পাচারকারীদের সহায়তায় লিবিয়া যাচ্ছেন বাংলাদেশিরা। সেখান থেকেই ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করে নৌকাডুবিতে প্রাণ হারাচ্ছেন অনেক বাংলাদেশি। এরপরও ঝুঁকিপূর্ণ এ প্রবণতা বন্ধ হয়নি। এ ছাড়া প্রতারণার শিকার হয়ে লিবিয়ায় মানবপাচারকারীদের হাতে বহু বাংলাদেশি আছেন আটক অবস্থায়।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর’র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশের তালিকায় শীর্ষে আছে বাংলাদেশ।
মানব পাচারের দিক থেকে আন্তজার্তিক সংস্থার তালিকাতে কেন বাংলাদেশ শীর্ষে? আমরা যদি এর কারণ খুঁজি তাহলে সর্বপ্রথম যে কারণটি আসবে তা হলো বেকারত্ব। দেশের বিপুল পরিমাণ বেকার ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ধারণা, বিদেশে গেলে তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরবে। পারিবারিক সচ্ছলতা আসবে এই বিশ্বাস নিয়ে অবৈধ পথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে পাড়ি দেয় তারা। তাদের এই বিশ্বাসকে পুঁজি করে স্বার্থ হাসিল করে পাচারকারীরা।
বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের সূত্র মতে কক্সবাজার ও টেকনাফের ৮০টি পয়েন্ট দিয়ে মানব পাচার হয়। বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতার জন্য জন্য মানব পাচার কমানো যাচ্ছে না। মানব পাচারকারী চক্রের সাথে পুলিশ, সীমান্ত রক্ষীবাহিনী, প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলের নেতাসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার হাত আছে বলে মনে করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, মানব পাচারের আরো একটি কারণ হলো অসচেতনতা। পাচার হওয়া ভিক্টিম যারা ফিরে আসে তাদের নিয়ে বিভিন্ন প্রোগ্রাম বা ভিক্টিমদের বক্তব্য, তাদের দুর্দশার কথাগুলো প্রত্যন্ত অঞ্চলের সহজ সরল মানুষের মাঝে তুলে ধরার মাধ্যমে সচেতনতা তৈরি করা যেতে পারে। যে এলাকা থেকে মানব পাচার বেশি হচ্ছে সেই এলাকা চিহ্নিত করে সচেতন করা। বেকারত্ব কমাতে যুবক ও মহিলাদের কারিগরি শিক্ষা বৃদ্ধি করে নিজ দেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। জনশক্তি রপ্তানিতে সরকারি কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে উন্নত দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক বাড়ানো। এছাড়া উপকূল ও সীমান্ত এলাকাতে পর্যাপ্ত কোস্ট গার্ড ও সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর সংখ্যা বাড়াতে হবে। তাদের প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করতে হবে। সমুদ্রসীমা সুরক্ষার জন্য আধুনিক পদ্ধতি অবলম্বন দরকার বলে মনে করেন তারা।
তারা বলেন, সমুদ্র পথে টহল বাড়াতে হবে। টেকনাফসহ সীমান্ত এলাকাগুলিতে ওয়াচ-টাওয়ার করে মানুষদের সার্বক্ষণিক চলাচল পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে। মানব পাচারের এই চক্র ভেঙে দিতে রিসিভিং কান্ট্রির অনেক ভূমিকা পালন করতে হবে। এই বিষয়ে সরকারের আরো বেশি সচেতন হওয়া এবং সুনজর দেওয়া উচিত। এছাড়া জল, স্থল ও আকাশ পথে নজরদারি বাড়াতে হবে। ২১ শতক, সভ্য এক ধরণীতে দাস প্রথা বড়ই বেমানান। মানব পাচার জঘন্যতম একটি ব্যবসা। এটি নির্মূলের মাধ্যমে আমরা আধুনিক দাস প্রথা থেকে মুক্তি পেতে পারি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪০১
আপনার মতামত জানানঃ