বাংলাদেশ ধান ও মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পন্ন হয়েছে। তারপরও দেশের মানুষ তিন মাত্রার অপুষ্টির ঝুঁকিতে আছে। দেশের পাঁচ বছরের কম বয়সী ২৮ শতাংশ শিশুর উচ্চতা বয়সের তুলনায় কম ও ৮ শতাংশ শিশু কৃশ বা তীব্র অপুষ্টির শিকার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট এবং স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের যৌথ গবেষণায় দেশের মানুষের স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কেনার সামর্থ্যের বিষয়টি উঠে এসেছে। শিগগিরই গবেষণা প্রতিবেদনটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে বলে পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। খবর প্রথম আলো
এই গবেষণায় আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং বাংলাদেশ সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাস পর্যালোচনা করে পুষ্টির ঘাটতি চিহ্নিত করা ও সেই ঘটতি পূরণে সুপারিশ তৈরি করার জন্য এই গবেষণাটি করা হয়েছে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, ৪০ শতাংশ নারী রক্তস্বল্পতায় ভুগছে অর্থাৎ তারা অণুপুষ্টিকণার ঘাটতির শিকার। অন্যদিকে প্রাপ্তবয়স্ক ১৬ শতাংশ পুরুষ ও ১৮ শতাংশ নারীর ওজন বেশি। ওজন বেশি এমন নারী–পুরুষের মধ্যে স্থূলতা বাড়ছে। এসব অপুষ্টির একটি কারণ পুষ্টিজ্ঞানের ঘাটতি।
গবেষকেরা দেখেছেন, বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যতালিকায় আছে আট শ্রেণির খাদ্য: শস্য (চাল, গম), ডাল, সবজি (পাতাসহ সবজি ও পাতাবিহীন সবজি), ফল, মাংস–মাছ–ডিম, দুধ ও দুগ্ধজাত, তেল এবং মিষ্টি (গুড়, চিনি, মধু)। স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যে আট শ্রেণির খাদ্য থাকাই যথেষ্ট নয়, তাতে প্রয়োজনীয় ক্যালরি ও অত্যাবশ্যকীয় অণুপুষ্টিকণাও থাকতে হবে। বাংলাদেশের বাজারের খাদ্যের দাম হিসাব করে গবেষকেরা দেখেছেন, একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির স্বাস্থ্যকর খাবারের জন্য দৈনিক ৮৩ টাকা প্রয়োজন। এই হিসাব ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসের দ্রব্যমূল্যের ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছে।
গবেষকেরা বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাস ও পুষ্টির তথ্য নিয়েছেন নিউট্রিশন সার্ভে অব বাংলাদেশ (২০১৭–১৮) এবং বাংলাদেশ ইন্টিগ্রেটেড হাউসহোল্ড সার্ভে (২০১৫) থেকে। মানুষের ব্যয়ক্ষমতার তথ্য নিয়েছেন হাউসহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (২০১৬) থেকে।
৪০ শতাংশ নারী রক্তস্বল্পতায় ভুগছে অর্থাৎ তারা অণুপুষ্টিকণার ঘাটতির শিকার। অন্যদিকে প্রাপ্তবয়স্ক ১৬ শতাংশ পুরুষ ও ১৮ শতাংশ নারীর ওজন বেশি। ওজন বেশি এমন নারী–পুরুষের মধ্যে স্থূলতা বাড়ছে। এসব অপুষ্টির একটি কারণ পুষ্টিজ্ঞানের ঘাটতি।
প্রতিবেদনের শুরুতে বলা হয়েছে, দেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছিল। ২০১৬ সালে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল। ২০৯১ সালে ওই হার কমে দাঁড়ায় ২০ দশমিক ৫ শতাংশে। করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালের জুনে দেখা যায়, পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে এবং জনসংখ্যার ২৯ দশমিক ৫ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় এই সময়ের তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে।
পরিমাণ ও পুষ্টিগুণ বিবেচনায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিত ‘স্বাস্থ্যকর’ খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে খেতে পায় না দেশের ৪১ শতাংশ মানুষ। অর্থাৎ শক্তিবর্ধক, পুষ্টিকর ও ভিটামিনসমৃদ্ধ খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে খেতে পারছে না তারা। অঞ্চল হিসেবে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি খুলনা বিভাগে, আর কম চট্টগ্রামে। শহরের তুলনায় গ্রামে ঘাটতি বেশি।
গবেষণায় দেখা গেছে, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কেনার ক্ষমতা সবচেয়ে কম খুলনা বিভাগের মানুষের। খুলনা বিভাগের ৬৬ শতাংশ পরিবারের স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কেনার সামর্থ্য নেই। সেই সামর্থ্য আছে মাত্র ৩৪ শতাংশ পরিবারের। তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থা চট্টগ্রাম বিভাগে। এই বিভাগের ৭৫ শতাংশ পরিবারের স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কেনার সামর্থ্য আছে।
৬৪ জেলার মধ্যে সামর্থ্যের দিক দিয়ে দেশের সবচেয়ে ভালো অবস্থানে কক্সবাজার জেলা। এ জেলার ৯১ শতাংশ পরিবারের স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কেনার সামর্থ্য আছে। অন্যদিকে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি মেহেরপুরে। দেশের দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চরের এই জেলার ৭৬ শতাংশ পরিবারের স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কেনার সামর্থ্য নেই।
শহর ও গ্রামের পরিবারগুলোর মধ্যে সামর্থ্যের তারতম্য আছে। শহরের ৩৯ শতাংশ পরিবারের স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কেনার সামর্থ্য নেই। গ্রামে সামর্থ্য নেই ৪২ শতাংশ পরিবারের। গবেষকেরা বলছেন, গ্রামের পরিবারগুলোর সামর্থ্য কম থাকার কারণ হয়তো এই যে, গ্রামের মানুষের আয়–উপার্জন তুলনামূলকভাবে কম এবং তাদের ক্রয়ক্ষমতাও কম।
দেশের মানুষ খাদ্যের জন্য যে ব্যয় করে তার ৩৮ শতাংশ চলে যায় শ্বেতসার বা কার্বোহাইড্রেটজাতীয় খাদ্যের পেছনে। অর্থাৎ মূলত চালের পেছনে এই খরচটা হয়। ৩৫ শতাংশ ব্যয় হয় আমিষজাতীয় খাদ্যের পেছনে। দুধ ও ফলের জন্য ব্যয় হয় যথাক্রমে ৩ ও ৪ শতাংশ। তেল ও চর্বিজাতীয় খাদ্যে ব্যয় হয় ৬ শতাংশ। বাকি ১৪ শতাংশ ব্যয় হয় সবজির খাতে। এর মধ্যে ২ শতাংশ পাতাওয়ালা সবজির জন্য।
একই পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাওয়া সম্ভব বলে গবেষকেরা জানিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, চাল, তেল ও পাতাবিহীন সবজিতে খরচ কমাতে হবে। বেঁচে যাওয়া অর্থ আমিষ, দুধ, ফল ও পাতাওয়ালা সবজিতে ব্যয় করতে হবে।
সুপারিশে গবেষকেরা বলছেন, খাদ্যাভ্যাসের কারণে অণুপুষ্টিকণার ঘাটতি দূর করতে চাল বা শ্বেতসারজাতীয় খাদ্যের জন্য ব্যয় কমাতে হবে। এ জন্য মানুষকে তথ্য দেওয়া এবং মানুষের আচরণ পরিবর্তনে জোর দেওয়া প্রয়োজন।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, অর্থনীতি, খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টিতে বাংলাদেশ আগের তুলনায় উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। তবে এর উল্টোপিঠে অপুষ্টির প্রসার, অনুপুষ্টির ঘাটতি এখনো আছে। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে অপুষ্টি দূর এবং খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জন করা জরুরি। এর জন্য স্থিতিস্থাপক খাদ্যব্যবস্থা তৈরি করা দরকার।
তারা বলেন, সরকারের উচিত খাদ্যের পুষ্টির ঘনত্ব বিবেচনা করা এবং খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য নীতি ধরে কাজ করা। ’
আরও বলেন, শুধু পুষ্টিকর খাদ্যের সহজলভ্যতাই নয়, সহজলভ্য শাকসবজি ও দেশীয় মৌসুমি ফল খাওয়ার ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করতে হবে। যেমন—একজন মানুষের দৈনিক শাকসবজি খাওয়ার প্রয়োজন ৪০০ গ্রাম। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষই খাচ্ছে ২০০ গ্রাম।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৪০
আপনার মতামত জানানঃ