ট্রায়াসিক যুগের শেষ দিকে অর্থাৎ প্রায় ২৩ কোটি বছর আগে, পৃথিবী দাপিয়ে বেড়িয়েছে ডাইনোসরেরা। আর ওদের শাসনকাল চলে সুদূর ক্রিটেশিয়াস যুগের শেষ পর্যন্ত। অর্থাৎ প্রায় ১৬০ মিলিয়ন বা ষোল কোটি বছর যাবত এদের রাজত্ব ছিল পৃথিবীর বুকে।
এরপর ৬৫ মিলিয়ন বছর পূর্বে ক্রিটেশিয়াস-টারশিয়ারি যুগে পৃথিবীর বিভিন্ন ভৌগলিক পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক কারণে এদের বেশীরভাগ প্রজাতিরই বিলুপ্তি ঘটে।
ক্রিটেসিয়াস-টারশিয়ারি গণবিলুপ্তিতে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেয় তখনকার প্রাণীজগতের ৭৫ ভাগ প্রজাতি, যার মধ্যে ডাইনোসরও ছিল। ধারণা করা হয় এক প্রচণ্ড উল্কাপাত কিংবা গ্রহাণুর পতনেই সূচনা হয় এ মহাবিলুপ্তির।
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ঘর্ষণে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হওয়া বিশাল বিশাল উল্কা কিংবা গ্রহাণুগুলো একদিকে যেমন জলজ প্রাণীদের হত্যা করেছে, অন্যদিকে স্থলভাগের প্রাণীও হত্যা করেছে।
বিস্ফোরণ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকা প্রাণীরাও রক্ষা পায়নি। কেননা, প্রচণ্ড সব বিস্ফোরণে প্রাণীকূলের আয়ত্তে থাকা বায়ুমণ্ডল ট্রফোস্ফিয়ার ধূলিকণা আর বিষাক্ত গ্যাসে ভরে যায়। ফলে মৃত্যু হয় অধিকাংশ প্রাণীর।
১৯৫৬ সালে রাশিয়ান জ্যোতির্বিজ্ঞানী জোসেফ স্কলভস্কি জানান, ডাইনোসরের বিলুপ্তি ঘটেছিল একটিমাত্র প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে। আর এর জন্য দায়ী ছিল একটি সুপারনোভা।
এর বিস্ফোরণে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়া রেডিয়েশনে ডাইনোসরদের বিলুপ্তি ঘটে। যদিও এটা থিওরি হিসেবেই ছিল বহুকাল।
এরপর লুইস আলভারেজ, নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী এবং তার ছেলে ভূবিজ্ঞানী ওয়াল্টার আলভারেজ ইটালিতে এক গবেষণায় প্রায় এক সেন্টিমিটার পুরু ইরিডিয়ামের আস্তরণ খুঁজে পায়।
ইরিডিয়াম পৃথিবীতে খুবই বিরল। মহাকাশে যদিও প্রচুর আছে। ১৯৮১ সালে তাদের গবেষণা প্রকাশিত হয় যে এই ইরিডিয়ামের উৎস কোন গ্রহাণু, যা আঘাত হেনেছিল পৃথিবীতে। আর এর কারণেই হতে পারে ডাইনোসরদের বিলুপ্তি।
এরপর বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ইরিডিয়ামের আস্তরণ খুঁজে পায়, যা আলভারেজের থিওরিকে গ্রহণযোগ্য করে তোলে। অতঃপর ১৯৯১ সালে মেক্সিকান পেনিনসুলায় ১১০ মাইল ব্যাসের একটি গর্তের সন্ধান পায় বিজ্ঞানীরা, যা উল্কাপিন্ডের আঘাতে সৃষ্ট।
তবে এবার এই ঘটনার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেলেন গবেষকরা। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটায় সন্ধান মিলল বেশ কিছু ডাইনোসরের জীবাশ্মের। যাদের মৃত্যু হয়েছিল সেই অভিশপ্ত দিনটিতেই।
নর্থ ডাকোটার ট্যানিস ফসিল সাইট থেকে ডাইনোসরের জীবাশ্মটি উদ্ধার করেছেন ম্যাঞ্চেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্ত্বিকরা। কিন্তু কীভাবে তারা নিশ্চিত হচ্ছেন এই ডাইনোসরটির মৃত্যু হয়েছিল গ্রহাণুর আঘাতে?
মূলত এই জীবাশ্মের আকৃতিই বলে দিচ্ছে সেই দিনটির ইতিহাস। কারণ, একটি নির্দিষ্ট স্থানে পাওয়া যায়নি ডাইনোসরটির সম্পূর্ণ দেহের জীবাশ্ম। বেশ খানিকটা অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে ছিল তার পা, মস্তিষ্ক এবং দেহের অন্যান্য অংশ।
এর আগেও এই ধরনের ছিন্নভিন্ন হওয়া ডাইনোসর দেহের জীবাশ্মের সন্ধান পেয়েছিলেন গবেষকরা। তবে প্রতিক্ষেত্রেই পাওয়া গিয়েছিল অন্তর্দ্বন্দ্বের হদিশ। অর্থাৎ, অন্য কোনো বৃহদাকার ডাইনোসরের সঙ্গে সংঘর্ষে মৃত্যু হয়েছিল তাদের।
তবে এক্ষেত্রে হাড়ের সঙ্গে অক্ষত অবস্থায় চামড়া সংরক্ষিত হওয়ায়, সেই ধরনের কোনো কামড়ের দাগ বা আঘাতের চিহ্ন লক্ষ করা যায়নি। যা বেশ আশ্চর্যজনক ঘটনা।
প্রত্নতাত্ত্বিক স্যার ডেভিড অ্যাটেনবার্গের অভিমত, এই ঘটনাই নিশ্চিতভাবে ইঙ্গিত দেয় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেই মৃত্যু হয়েছিল ডাইনোসরটির। আর সেটিই যে গ্রহাণুর আঘাত, তা নিশ্চিত করে আরও বেশ কয়েকটি ঘটনা।
থিসেলোসোরাস প্রজাতির ডাইনোসরটির জীবাশ্মের সঙ্গেই সন্ধান মিলেছে একাধিক ক্ষুদ্রায়তন স্তন্যপায়ী প্রাণীর ক্ষতবিক্ষত দেহের। সেইসঙ্গে বেশ কিছু মাছ এবং জলচর কচ্ছপের মৃতদেহের জীবাশ্মও খুঁজে পেয়েছেন গবেষকরা।
স্থলচর ডাইনোসর এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীদের সঙ্গে জলচর প্রাণীগুলির জীবাশ্মের সহাবস্থানই আরও ভাবিয়ে তুলছে গবেষকরা। প্রচণ্ড ভূমিকম্প কিংবা আঘাতে নিকটবর্তী জলাশয় থেকে সেগুলি ছিটকে ডাঙায় চলে এসেছিল বলেই অভিমত তাদের। যা গ্রহাণুর আঘাতেরই প্রত্যক্ষ প্রমাণ। এছাড়াও একাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ চিহ্নিত করেছেন গবেষকরা।
উল্লেখ্য, গবেষকরা এই প্রথম খুঁজে পেলেন এই ধরনের জীবাশ্মের প্রমাণ। যা পৃথিবীর প্রাচীন ডুমস ডে-র হদিশ দিল মানুষকে। বহু অজানা রহস্যের সমাধানও খুঁজে দিল এই গবেষণা, এমনই বিশ্বাস বিজ্ঞানীদের।
অবশ্য এখনও পর্যন্ত সমস্ত তথ্য প্রকাশ্যে আনেননি গবেষকরা। বিবিসি-র সঙ্গে যৌথভাবেই একটি বিশেষ তথ্যচিত্র তৈরির কাজ করছে ম্যাঞ্চেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়।
আগামী কিছুদিনের মধ্যেই প্রকাশ্যে আসবে সেই তথ্যচিত্র। অভিশপ্ত দিনটিতে আদৌ গ্রহাণু নাকি আস্ত ধূমকেতু খসে পড়েছিল পৃথিবীর বুকে, সেই বিতর্কেরও ইতি টানতে পারে এই আবিষ্কার। এমনই ইঙ্গিত দিচ্ছেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯৫২
আপনার মতামত জানানঃ