ধানের জমিতে সেচের পানি সরবরাহে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) দীর্ঘদিনের অনিয়ম-দুর্নীতির জেরেই ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর দুই কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। শুধু আত্মহত্যার বিচারেই এ সমস্যার সমাধান হবে না। কৃষকদের সেচের পানি সরবরাহের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধেও যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।
জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে বৃহস্পতিবার এসব কথা বলেছেন বেসরকারি কয়েকটি সংগঠনের নেতারা। এ সংবাদ সম্মেলনে অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি), বেলা, ব্লাস্ট, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, আরডিসি, রুলফাওসহ এসব সংগঠন একটি অনুসন্ধান প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সংগঠনটির সহকারী প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর রফিক আহমেদ সিরাজী।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গোদাগাড়ীর দেওপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের নিমঘুটু গ্রামের অভিনাথ মারান্ডি ও তার চাচাতো ভাই রবি মারান্ডি বোরো ধানের জমিতে পানি না পাওয়ায় আত্মহত্যা করেন। পানি দেয়ার জন্য পাশের গ্রামের বিএমডিএর একটি গভীর নলকূপের ওপর এলাকাবাসীকে নির্ভর করতে হয়। ১০-১২ দিন ঘুরেও তারা পানি না পেয়ে পাম্প অপারেটর সাখাওয়াতকে বলেছিলেন, তারা আত্মহত্যা করবেন।
সাখাওয়াত উল্টো বলেছিল, আত্মহত্যা কর তার পর পানি দেবো। এ দিকে ধানক্ষেতে পানি না পেয়ে চারাগুলো হলুদ হয়ে যাচ্ছিল। ধারদেনা করে ওই ক্ষেত করেছিলেন তারা। রাগে ক্ষোভে ২৩ মার্চ তারা বিষপান করে আত্মহত্যা করেন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), রুলফাও, পরিবর্তন, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম ও আদিবাসী বিষয়ক সংসদসীয় কমিটির যৌথ উদ্যোগে এ অনুসন্ধান করা হয়। অনুসন্ধান দলটি ১১ -১২ এপ্রিল এলাকা পরিদর্শন করেন। এ সময় মৃতদের পরিবার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সাথে তারা কথা বলেন। অনুসন্ধানে দলটি জানতে পারে দুই কৃষক বিষপানে আত্মহত্যা করলেও বিষয়টি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে একটি পক্ষ বিষয়টি চোলাই মদপানে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করেন।
গত ২৩ মার্চ রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার নিমঘটু গ্রামের কৃষক অভিনাথ মারান্ডি ও তাঁর চাচাতো ভাই রবি মারান্ডি বিষ পান করেন। এতে দুজনেরই মৃত্যু হয়। পরিবারের অভিযোগ, স্থানীয় গভীর নলকূপের অপারেটর সাখাওয়াত হোসেন তাঁদের পানি না দিয়ে ১২ দিন ধরে ঘোরাচ্ছিলেন। চোখের সামনে বোরো ধানের খেত ফেটে চৌচির হতে দেখে তারা বিষ পান করেন।
দুই কৃষক বিষপানে আত্মহত্যা করলেও বিষয়টি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে একটি পক্ষ বিষয়টি চোলাই মদপানে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করেন।
কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনায় ১১ ও ১২ এপ্রিল বিভিন্ন সংগঠনের ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে।
সে সময় এ দলের কাছে বক্তব্য দেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী। বিএমডিএকে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেন, বিএমডিএ’র জন্ম কৃষকদের সহযোগিতা করার জন্য হলেও তারা পানি নিয়ে বাণিজ্য ও সন্ত্রাস করছে। পানি বণ্টনের ক্ষেত্রে বিএমডিএ’র পাম্প অপারেটরদের মধ্যে স্বেচ্ছাচারিতা ও স্বজনপ্রীতি রয়েছে। সংশ্লিষ্ট পাম্প অপারেটরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছিল। এরপরও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সময়মতো ব্যবস্থা নিলে হয়তো গোদাগাড়ীতে ঘটে যাওয়া ঘটনা এড়ানো যেত।
সেচের পানি না পেয়ে দুই কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনা দুঃখজনক উল্লেখ করে এই সাংসদ বলেন, ‘আমি মনে করি, এই বিষয়ে বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বিচার হাওয়া উচিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিএমডিএ বরেন্দ্র এলাকায় ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করার কারণে পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। এবার তাদের থামা উচিত। এ এলাকায় গভীর নলকূপ ও সেমি-গভীর নলকূপ বসানো ও পানি বণ্টনের ক্ষেত্রে একটি নীতিমালা হওয়া দরকার।’
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, দুই কৃষকের আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া কেবল অনিয়ম আর দুর্নীতির দৃষ্টান্ত নয়। এটা হচ্ছে একটা সুস্পষ্ট বঞ্চনার দৃষ্টান্ত। যে ব্যবস্থা চালু আছে, সেটাকে বিশ্লেষণ করে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে।
সরকারকে পানি ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনার দাবি তুলে রিজওয়ানা হাসান বলেন, প্রয়োজনে বরেন্দ্র অঞ্চলকে পানি সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করতে হবে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে জনগণের কোনো সম্পর্ক নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
পরিদর্শন দলের সুপারিশ
ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর এক প্রতিবেদনে ৯টি সুপারিশ করেছে প্রতিনিধি দলটি।
পরিদর্শন দলের সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে, বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষের দুর্নীতির সুষ্ঠু তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া; সেচকাজে অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের জন্য বিএমডিএর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া, পাম্প তথা পানি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িতদের সবার জবাবদিহি নিশ্চিত করা; পাম্পের নির্ধারিত সীমানার বাইরে নতুন কোনো জমি পাম্পের সেচ ব্যবস্থাপনার আওতায় না আনা; সেচ পাম্পের আওতায় জমি তালিকাভুক্তির জন্য বিএমডিএর জমি তালিকাভুক্তি নীতিমালা কঠোরভাবে অনুসরণ করা, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য কমপক্ষে বীজতলা তৈরি ও চারা রোপণের সময় বিনামূল্যে সেচের পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে বিএমডিএর সঙ্গে আলোচনা করা।
সুপারিশে আরও বলা হয়, প্রান্তিক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী ও সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকার পাম্পের অপারেটর হিসেবে এসব সম্প্রদায়ের মানুষকে নিয়োগ দেওয়া, যাতে তারা প্রতারণার শিকার না হন; ধার্য করা পানির দামের অতিরিক্ত টাকা কৃষকদের কাছ থেকে আদায় না করা; ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, সংখ্যালঘু ও নারী কৃষকদের বিনা মূল্যে সেচের পানির সরবরাহ করা; দুই কৃষকের আত্মহত্যার প্ররোচনার মামলাটির একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত করা, যাতে ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রভাবিত না করা যায়।
বিএমডিএর যথেচ্ছভাবে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের ফলে বরেন্দ্র অঞ্চলের পরিস্থিতি আরও সংকটাপন্ন হচ্ছে। ফলে এ অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির পরিবর্তে ভূমির ওপরের পানির ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দিতে হবে বলে সুপারিশে উল্লেখ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের কোনো শ্রেণি-পেশার মানুষই এখন ভালো নেই। বিশেষ করে সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থায় আছে কৃষক সমাজ। কারণ তারা ফসলের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। কিছুদিন আগে কৃষকরা ফসলের দাম না পেয়ে নিজের উৎপাদিত ফসলে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।
এটি একটি বিরল ঘটনা। সবশেষ ফাঁসির মঞ্চ বানিয়ে একজন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। ঘটনাটি সারাদেশ নাড়িয়ে দিয়েছে, আমাদের স্তম্ভিত করেছে। শুধু কৃষক নয়, দেশে অন্যান্য মানুষেরও আত্মাহুতির ঘটনা বেড়েছে।
তারা বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও আমরা একটি সমন্বিত ও আধুনিক কৃষিপণ্য বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারিনি। ফলে একদিকে উৎপাদিত ফসল ও পণ্যদ্রব্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন কৃষক, অন্যদিকে সেসব পণ্য উচ্চমূল্যে কিনতে হয় ভোক্তা তথা ক্রেতাসাধারণকে। যদি ধান ও চালের দাম বাড়ে, তাহলে নিম্ন আয়ের মানুষের কষ্ট হয়। আবার ধানের দাম কমে গেলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হন। উন্নত দেশে কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের সবটাই কিনে নেয়। পরে আবার সেটা কম দামে বিক্রি করে।
সর্বত্রই কৃষি আর কৃষকের জয়গান, অথচ ঠিকঠাক একটি কৃষিনীতি আজ পর্যন্ত হল না। দরকার বিশেষজ্ঞের পরামর্শ, যাতে বাজারের চাহিদা আর জোগানে কৃষকের নির্দিষ্ট কিছু ভূমিকা থাকে। সরকারি ঋণ ব্যবস্থাকেও কৃষকের দরজায় পৌঁছতে হবে। এখনও ফসল বিপণনে সরকারের ভূমিকা গৌণ। মধ্যস্বত্বভোগীদের ভূমিকাই প্রধান। সরকারের ভূমিকা প্রধান হয়ে না উঠলে কৃষকের জন্য অন্য কোনও পথ নেই বাঁচার। সরকার যদি সত্যিই কৃষিকে বাঁচাতে চায়, তা হলে সেই ব্যবস্থা কার্যকর করার চেষ্টা সরকারকেই করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪২৩
আপনার মতামত জানানঃ