একটা সময় ছিল যখন নারীদের শিক্ষা দীক্ষায় আগ্রহ দেখাতেন না অভিভাবকেরা। সেই কুসংস্কার ক্রমশ ম্লান হয়ে এখন দেশের অধিকাংশ নারীরাই শিক্ষার আওতায় চলে আসছেন। তবে নারীদের শিক্ষায় দীক্ষায় অভিভাবকেরা যে এখনো পরিপূর্ণ সচেতন এ দাবি জোর দিয়ে করা যাচ্ছে না। অনেক নারীই এখনো শিক্ষার বাইরে থাকেন। সমাজ এবং ধর্মের যাঁতাকলে পড়ে নারীরা শিক্ষা দীক্ষায় পিছিয়ে থাকলেও নারীদের সম্ভ্রম রক্ষার বিষয়টি সবার আগে সামনে আসে। কেননা দেশে এখনো নারীরা নিরাপদ নয়। এখনো স্বাচ্ছন্দ্যে ভ্রমণের বিষয়ে নারীদের রয়েছে বিস্তর প্রতিবন্ধকতা। এসব উপেক্ষা করেও যেসব অভিভাবক কন্যাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠান তাদের মনে দেখা দিয়েছে নতুন এক আতঙ্ক। রাস্তার বখাটেদের মতো এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরাও ছাত্রীদের যৌন নিপীড়ন করে থাকেন। তেমনি নিজ বিভাগের এক ছাত্রীকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ এখন আলোচনায়।
এদিকে ঢাবি ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি এবং ২০১৯ সালে একুশে পদকপ্রাপ্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ ঘোষের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে ঢাবি বাংলা বিভাগের একাডেমিক কমিটি।
গত মার্চে ঢাবি’র বাংলা বিভাগের ২য় বর্ষের এক ছাত্রী তার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ আনলে, ২৯ মার্চ বাংলা বিভাগের একাডেমিক কমিটি ঘটনার সত্যতা প্রমাণসাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে।
গত ২৯ মার্চ অনুষ্ঠিত বিভাগের একাডেমিক কমিটির সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও সম্প্রতি এটি প্রকাশ পায়। ওই সভার কার্যবিবরণী থেকে জানা যায়, বিশ্বজিৎ ঘোষের বিরুদ্ধে সর্বসম্মতিক্রমে আরও বেশ কয়েকটি শাস্তির সিদ্ধান্ত সভায় গৃহীত হয়।
সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়, অভিযুক্ত অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ ওই সভায় উপস্থিত হয়ে তার ভুল হয়েছে বলে স্বীকার করেন। তিনি সবার কাছে ক্ষমা চান এবং করুণা ভিক্ষা করেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ভবিষ্যতেও বিশ্বজিৎ ঘোষকে কোনো একাডেমিক কার্যক্রমে যুক্ত করা হবে না, সিঅ্যান্ডডি ও একাডেমিক কমিটির সভায় তাকে ডাকা হবে না, তার নামে বরাদ্দকৃত বিভাগীয় কক্ষ বাতিল করা হবে এবং বিশ্বজিৎ ঘোষের বিরুদ্ধে আরও বৃহত্তর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে উপস্থাপন করা হবে কি না সেটি অভিযোগকারীর সম্মতি সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে সভায় জানানো হয়। কার্যবিবরণীতে বলা হয়, তদন্তকালীন সময়েও একাডেমিক কমিটির এ সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে।
একাডেমিক কার্যক্রমের মধ্যে পড়বে সব ধরনের ক্লাস নেওয়া, পরীক্ষায় প্রত্যবেক্ষণ, উত্তরপত্র মূল্যায়ন, এমফিল-পিএইচডি গবেষণা তত্ত্বাবধায়ন, পরীক্ষা কমিটির কাজে অংশগ্রহণ প্রভৃতি।
গত মাসে অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ আনেন একই বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রী।
বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গত মাসে অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ আনেন একই বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রী। পরে ওই ছাত্রী বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক সৈয়দ আজিজুল হক বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন। এ নিয়ে গত ২৯ মার্চ দুপুর ১২টায় বিভাগের একাডেমিক কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক সৈয়দ আজিজুল হক বিশ্বজিৎ ঘোষের বিরুদ্ধে আসা যৌন-নিপীড়নের লিখিত অভিযোগটি উপস্থাপন করেন। এ সময় তিনি লিখিত অভিযোগপত্রটি পড়ে শোনান। এরপর কমিটির সদস্যরা এটি নিয়ে অনেকক্ষণ আলোচনা করেন। পরে সবাই শাস্তিমূলক ব্যবস্থার পক্ষে মতামত দেন।
সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়, অভিযুক্ত অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ ওই সভায় উপস্থিত হয়ে তার ভুল হয়েছে বলে জানান। তিনি সবার কাছে ক্ষমা চান এবং করুণা ভিক্ষা করেন। তবে একাডেমিক কমিটির সদস্যরা তার দ্বারা সংঘটিত অতীতের বিভিন্ন যৌন নির্যাতনের ঘটনার কথা উল্লেখ করে তার এই প্রার্থনা গ্রহণ করেননি।
তবে অভিযোগটি মিথ্যা দাবি করে তিনি গণমাধ্যমকে বলেছেন, আমার সাফল্য এবং সুনামে ঈর্ষান্বিত হয়ে ওই শিক্ষার্থীর মাধ্যমে কোনো মহল এ কাজ করিয়েছে বলে আমি মনে করি। বিষয়টি সম্পুর্ণ মিথ্যা। অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। সার্বিক বিষয়ে জানতে বাংলা বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. সৈয়দ আজিজুল হককে ফোনে একাধিকবার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।
এদিকে ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ ওঠা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বাংলা বিভাগের অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষের স্থায়ী বহিষ্কারের দাবিতে সমাবেশ করেছে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের নেতাকর্মীরা।
বৃহস্পতিবার (১৪ এপ্রিল) দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে সংগঠনটির বিশ্ববিদ্যালয় শাখা এ সমাবেশ করে।
সমাবেশে বক্তারা বলেন, অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরও অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষকে শুধুমাত্র একাডেমিক কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। বিভাগীয় ব্যবস্থা ছাড়া কোনো শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। প্রশাসনের এমন আচরণে স্পষ্ট- সমাজে নারীর বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের ঘটনাকে কতটা হালকাভাবে দেখা হয়।
তারা আরও বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ। সেখানে এত বড় একটি ঘটনার পরও সবাই চুপ। যেখানে দেশের মানুষ নীতি-নৈতিকতার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। ছাত্র ফ্রন্ট সবসময়ই এ ধরনের নৈতিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে লড়েছে এবং লড়ে যাবে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, অভিযুক্ত শিক্ষকদের কেবল একাডেমিক কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেওয়া নয়, তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। শিক্ষকদের যৌন লালসার শিকার হয়ে ছাত্রীরা এখন বিদ্যালয়ে পা মাড়াতে ভয় পায়। শিক্ষকদের সাথে ছাত্রছাত্রীদের স্বাভাবিক সম্পর্ক ব্যবহত হলে শিক্ষা ক্ষেত্রে যেসব অগ্রগতি সামনে রেখে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। শিক্ষকদের এমন যৌন লালসার কারণে একদিকে যেমন শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে অন্যদিকে নারীদের শিক্ষার প্রতি আগ্রহে ভাটা পড়ছে বলে মনে করেন তারা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ রক্ষার্থে প্রতিষ্ঠানে সবধরনের যৌন হয়রানি বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০৩০
আপনার মতামত জানানঃ