প্রতিটি প্রাণীর জীবন ধারণে পানি অপরিহার্য। ভূগর্ভে এবং ভূপৃষ্ঠে অবস্থান করে পানি। ভূগর্ভস্থ পানি ভূপৃষ্ঠের নিচে সঞ্চিত সম্পদ, যা প্রধানত ভূপৃষ্ঠের পানিতে গঠিত। এই পানি মাটির নিচে গিয়ে সঞ্চিত হয়। পৃথিবীর স্বাদু প্রায় ৩০ শতাংশ পানি আসে ভূগর্ভ থেকে। তবে আহরণযোগ্য ৯৭ শতাংশই আসে ভূগর্ভস্থ পানি থেকে। নদী-জলাশয়ের এ পানির পরিমাণ এক শতাংশেরও কম। এর ৬৯ শতাংশ হিমবাহ আকারে সঞ্চিত আছে।
ভূতাত্ত্বিকভাবে পানিচক্রের অন্যতম উপাদান ভূগর্ভস্থ পানি; যা ভূগর্ভস্থ জলস্তর নামে পরিচিত শিলাস্তরে জমা থাকে। বাংলাদেশে গ্রামের প্রায় শতভাগ মানুষ খাবারের জন্য ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল। শহরাঞ্চলের সরবরাহও প্রধানত ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল। রাজধানী ঢাকায় মোট পানি সরবরাহের ৬৬ শতাংশ আসে ভূগর্ভ থেকে। বাকিটা ভূপৃষ্ঠস্থ পানি শোধনের মাধ্যমে আসে। ভূগর্ভস্থ পানি সেচকাজেও ব্যবহৃত হয়।
ঢাকা শহরে প্রতিনিয়ত বাড়ছে পানির চাহিদা। বাড়ছে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন। বসানো হচ্ছে গভীর নলকূপ। পানি সরবরাহকারী সরকারি সংস্থা ঢাকা ওয়াসা বর্ধিত এ পানির চাহিদা মেটাতে আস্থা রাখছে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর। এখন ওয়াসা দিনে যে পরিমাণ পানি সরবরাহ করছে তার ৬৬ শতাংশই মাটির নিচের। এক যুগে গভীর নলকূপের সংখ্যাও বেড়ে হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। তারপরও পানির চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে সংস্থাটি।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূ-উপরিস্থ পানির উৎস থেকে ব্যবহার বাড়াতে না পারলে ভূমিকম্পসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি বাড়বে। এ কারণে ওয়াসাকে মাটির নিচের পানির ওপর চাপ কমাতে হবে। গুরুত্ব দিতে হবে ভূ-উপরিস্থ পানি পরিশোধন করে সরবরাহে। পাশাপাশি বৃষ্টির পানি ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে হবে।
তবে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসীম এ খানের দাবি, রাজধানীতে পানি সরবরাহে ভূ-উপরিস্থ উৎসে জোর দেওয়া হচ্ছে। আগামী দুই বছরের মধ্যে ৭০ শতাংশ ভূ-উপরিস্থ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে।
ওয়াসার কর্মকর্তারা জানান, এক যুগ আগেও ঢাকায় পানি সরবরাহে বেশ ঘাটতি ছিল। তখন দিনে পানি উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১৮৮ কোটি লিটার। পরে পানি সরবরাহ দ্রুত ও বহুমুখী করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয় ওয়াসা। এই পদক্ষেপে তারা গভীর নলকূপ স্থাপনে বেশি গুরুত্ব দেয়। এখন নগরে গভীর নলকূপের সংখ্যা ৯০৬টি। এছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় আরও অন্তত ২০টি নলকূপ স্থাপনের কাজ চলছে।
জানা যায়, ২০১৪ সালে সাভারের ভাকুর্তায় ৫৭২ কোটি টাকা খরচ করে একসঙ্গে ৪৬টি গভীর নলকূপ বসায় ঢাকা ওয়াসা। এ নিয়ে তখন ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এখন ১৫ কোটি লিটার পানি উত্তোলনে সক্ষম এই প্রকল্পের পানি ঢাকার মিরপুরে সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে প্রতিদিন ১৫ কোটি লিটার সরবরাহের কথা বলা হলেও বাস্তবে তা হচ্ছে না। ফলে মিরপুর এলাকায় পানি সংকট তীব্র হয়েছে।
এদিকে মহাখালী, বনানী, গুলশান ঢাকা ওয়াসার জোন-৫ এর আওতাধীন। ২০১৯ সালে এই এলাকাগুলোতে পানির তীব্র সংকট ছিল। তখন এই জোনের বিভিন্ন স্থানে একসঙ্গে আটটি নতুন নলকূপ স্থাপনে অনুমোদন দেয় ওয়াসা। এর মধ্যে মহাখালীর জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (আইপিএইচ) সংলগ্ন মন্দির গলিতে একটি নলকূপ স্থাপন করা হয়। এই কূপ থেকে আড়াই হাজার গ্রাহককে ভূগর্ভস্থ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। কিন্তু দিনে কী পরিমাণ পানি এই পাম্প থেকে ওঠানো হচ্ছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান দিতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) দেশের বিভিন্ন এলাকার এক হাজার ২৭২টি কূপের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানির বাড়া-কমা পর্যবেক্ষণ করে। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, ঢাকায় ১৯৯০ সালে ১৩০টি গভীর নলকূপ দিয়ে পানি উত্তোলন করা হতো। তখন পানি পাওয়া যেত সাড়ে ২২ মিটার নিচ থেকে। ২০০৫ সালে নলকূপের সংখ্যা বেড়ে হয় ৪২৩, পানির স্তর নামে ৫৪ মিটারে। ২০২২ সালে এসে নলকূপের সংখ্যা ৯শ ছাড়িয়ে গেছে। আর পানির স্তর নেমেছে অন্তত ৮০ মিটারে।
ভূর্গভস্থ পানি অফুরন্ত নয় জানিয়ে ওয়াটার এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর হাসিন জাহান গণমাধ্যমকে বলেন, ঢাকা শহরে বিপজ্জনভাবে ভূর্গভস্থ পানি কমে যাচ্ছে। ওয়াসাকে নদীর পানি ব্যবহারের পাশাপাশি বৃষ্টির পানি ব্যবহার বাড়াতে হবে। বৃষ্টির পানি সবচেয়ে বিশুদ্ধ। এটা আমাদের কাজে লাগাতে হবে। তিনি বলেন, এখন কলকারখানার বর্জ্যের কারণে নদী-নালা, খাল-বিল, হ্রদ, পুকুর, ঝরনা, প্রভৃতির পানি (সার্ফেস ওয়াটার) দূষিত হচ্ছে। বিশেষ করে গাজীপুরের কলকারখানা থেকে সার্ফেস ওয়াটারে দূষণ বেশি ছড়ায়। এ দূষণের কারণেও পানি দূষিত হচ্ছে এবং স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে।
এদিকে, মেঘনা নদীর পানি পরিশোধন করে রাজধানীতে সরবরাহ করতে ৯ বছর আগে সোয়া পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছিল ওয়াসা। তিন দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর পরও এখন পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি মাত্র ৪৫ শতাংশ। এখন এই প্রকল্প ব্যয় বেড়ে হয়েছে আট হাজার কোটি টাকা। শোধনাগার ও পানির লাইনের নির্মাণকাজ শেষে কবে নাগাদ মেঘনা নদীর পানি ঢাকাবাসী পাবে সেটি নিয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা।
পদ্মা নদীর পানি রাজধানীতে সরবরাহ করতে তিন হাজার ৬৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে শোধনাগার নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু শোধনাগার থেকে পানি রাজধানীতে নিতে সরবরাহ লাইনই স্থাপন করেনি ওয়াসা। এতে শোধনাগারের সক্ষমতার প্রায় ৫০ শতাংশই অব্যবহৃত থাকছে দুই বছরের বেশি সময় ধরে। ফলে নির্ধারিত সময়ে ভূ-উপরিস্থ পানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারছে না ওয়াসা।
ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে পানির স্তর নিচে নেমে যায়, এতে প্রাকৃতিক পরিবেশে বা ইকোসিস্টেমে ভারসাম্য ক্ষুণ্ন হয়।
জানতে চাইলে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাছের খান গণমাধ্যমকে বলেন, ঢাকা শহরে চাহিদার ৮০ শতাংশ পানি ভূর্গভস্থ থেকে মেটায় ওয়াসা। এতে প্রতিবছর পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। এভাবে কমতে থাকলে ভূমিকম্পসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক ঝুঁকি বাড়তে থাকবে। তাই ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে ওয়াসাকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে।
ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে পানির স্তর নিচে নেমে যায়, এতে প্রাকৃতিক পরিবেশে বা ইকোসিস্টেমে ভারসাম্য ক্ষুণ্ন হয়।
প্রত্যক্ষভাবে যে সমস্যা সৃষ্টি হয় তা হলো, পানির স্তর ক্রমাগত নেমে যাওয়ার ফলে পানি তোলার ব্যয় বেড়ে যায় এবং পানির প্রাপ্যতা কমে যায়, এমনকি ভূগর্ভস্থ পানিতে দূষণের ঝুঁকিও দেখা দিতে পারে। দ্বিতীয়ত, মাটির নিচ থেকে অতিরিক্ত পানি তোলা চলতে থাকলে ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়ে। উভয় প্রকার ঝুঁকির কথা আমাদের সবারই জানা আছে। সে জন্য ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে ভূ-উপরিস্থিত বিভিন্ন উৎস থেকে পানি ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া হয় সব দেশেই।
ঢাকা ওয়াসাও এ বিষয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। এই সংস্থা অনেক আগে থেকেই বলে আসছে, রাজধানী ঢাকার মাটির নিচের পানির স্তর বিপজ্জনক হারে নেমে যাওয়ার ফলে ব্যাপক হারে গভীর নলকূপ বসানো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এক দশক আগে ২০০৯ সালে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেছিলেন, ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে নদীর পানির ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে। তিনি বলেছিলেন, এখন থেকে গভীর নলকূপ বসানো কমে যাবে। কিন্তু আসলে উল্টো কাজই করা হয়েছে, ওয়াসার এমডির দায়িত্ব নেওয়ার পরের ১০-১২ বছরে আরও অসংখ্য নতুন গভীর নলকূপ বসানো হয়েছে।
এর ফল কী হয়েছে, তা–ও অজানা নেই। পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে; প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৫ ফুট করে নেমে যাচ্ছে। আর এর ফলে পানি তোলার খরচ বেড়েছে এবং আরও বাড়ছে। ৮-১০ বছর আগে একটি গভীর নলকূপ বসাতে খরচ হতো ৪০-৫০ লাখ টাকা। এখন খরচ হয় ১ কোটি ২০ লাখের বেশি। মাটির নিচেও পানি ক্রমেই আরও দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে। আগে একটি গভীর নলকূপ দিয়ে ১০-১২ বছর ধরে পানি উঠত, আর এখন দু-তিন বছরের মধ্যেই পানি ওঠা বন্ধ হয়ে যায়। পানির স্তর নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গভীর নলকূপ বসানোর ব্যয় ক্রমাগত বাড়ার ফলে ১৯৮২ সাল থেকে এ পর্যন্ত গ্রাহক পর্যায়ে পানির দাম বেড়েছে ১১ গুণেরও বেশি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গভীর নলকূপের বাইরে আছে পাঁচটি পানিশোধনাগার, যেগুলো থেকে মোট চাহিদার ২২ শতাংশ পূরণ হচ্ছে। কিন্তু শোধনাগারের পানির উৎপাদন খরচ ভূগর্ভস্থ পানির উৎপাদন খরচের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি। তা সত্ত্বেও আমাদের গভীর নলকূপের ওপর নির্ভরশীলতা দূর করতে হবে। ভূ-উপরিস্থিত বিভিন্ন উৎস থেকে পানির ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। বৃষ্টির পানি একটি ভালো উৎস, বর্ষা মৌসুমে তার প্রাপ্তিও অঢেল। ২০০০ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সরকারি ভবনে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও ব্যবহারের জন্য একটি নির্দেশনা জারি করেছিল। কিন্তু ২১ বছরেও নির্দেশনাটির বাস্তবায়ন শুরু হয়নি।
তারা বলেন, আমরা মনে করি, এ নির্দেশনা সরকারি-বেসরকারি সকল পর্যায়েই বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এভাবে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কিছু মাত্রায় হলেও কমবে।
আরও বলেন, ঢাকা শহরে গভীর নলকূপ স্থাপনের শুরুতে ধারণা করা হয়েছিল ঢাকার আশপাশে অনেক নদী আছে। গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি তুললেও শীতলক্ষ্যা-বুড়িগঙ্গার পানি তলদেশ দিয়ে রাজধানীর ভূগর্ভের পানির শূন্যতা পূরণ করবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। রাজধানী ঢাকার পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার পাশাপাশি বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যা সংলগ্ন নারায়ণগঞ্জেও পানির স্তর নেমে গেছে। এর মানে রাজধানীর ভূগর্ভের পানির শূন্যতা পূরণ হচ্ছে না। এটা খুবই উদ্বেগের। এর ফলে ভয়াবহ ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়ছে। সেই সাথে বাড়ছে ধসে যাওয়ার ঝুঁকিও। একসঙ্গে পুরো ঢাকা দেবে না গেলেও কিছু পকেট এলাকা দেবে যেতে পারে। এ রকম নজির বিশ্বের অনেক দেশেই আছে। পাশাপাশি ভূগর্ভে পানির শূন্যতা তৈরি হওয়ায় লবণাক্ততা ভর করবে, যেটা উপকূলীয় এলাকায় শুরু হয়েছে। আসলে ‘ভূ-উপরিস্থ পানির ওপর নির্ভরতা বাড়ানোর যে লক্ষ্য ঢাকা ওয়াসা ঠিক করেছিল, তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এটা ওয়াসার বড় ব্যর্থতা। ৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেও ওয়াসা ভালো ফলাফল দিতে পারেনি। ফলে ঢাকা নগরের ইকো সিস্টেম কলাপস করে গেছে। এজন্য ঢাকা নগরী বড় ধরনের বিপদের ঝুঁকিতে রয়েছে। এব্যাপরে এখনই সরকারের উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮২৭
আপনার মতামত জানানঃ