পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়ার সমালোচনা করায় দেশটির সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) ১২ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ওই ১২ জন পিটিআইয়ের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অ্যাক্টিভিস্ট বলে জানা গেছে।
মঙ্গলবার(১২ এপ্রিল) পাকিস্তানের ফেডারেল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এফআইএ) পাঞ্জাবপ্রদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে। খবর ডনের।
পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম জিও নিউজের খবরে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরান খানের ক্ষমতাচ্যুতির পর নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে প্রচার শুরু হয়। ইমরানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফের হাজার হাজার সমর্থক টুইট বার্তায় ক্ষমতাচ্যুতির নিন্দা জানান। শাহবাজ শরিফের সরকারকে ‘আমদারি করা সরকার’ আখ্যা দিয়ে তাদের মেনে না নেওয়ার ডাক দেওয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের নির্দেশনায় ‘ক্ষতিকর প্রচারণায়’ জড়িতদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে নিরাপত্তা বাহিনী। এই অভিযানে প্রথমে পাঁচ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে এফআইএ-এর সন্ত্রাসবাদ বিরোধী শাখা আরও সাত সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করে।
এসব সন্দেহভাজনদের বিরুদ্ধে মোট নয়টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এছাড়া ইসলামাবাদ থেকে প্রতিদিনই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
সেনাবাহিনী বিরোধী প্রচারণার ‘মাস্টারমাইন্ড’ এবং তার নেটওয়ার্কে ছয় সদস্যকে লাহোরের সাবজাবাজার এলাকা থেকে প্রথমে গ্রেপ্তার করা হয়। এই নেটওয়ার্কের অধীনে ২১ হাজার টুইটার অ্যাকাউন্ট রয়েছে বলে জানা গেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে তা আমলে নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির সামরিক কর্তৃপক্ষ। পাকিস্তান সেনাবাহিনী জানিয়েছে, এমন অপপ্রচারের মাধ্যমে দেশটির সেনাবাহিনী ও সমাজের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা হচ্ছে। মঙ্গলবার এমন মন্তব্য করা হয় বলে সংবাদ প্রকাশ করেছে ডন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের একটি বৈঠকে বলা হয়েছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে তা আমলে নেয়া হয়েছে। এ সময় পাকিস্তানের সংবিধান ও আইনের শাসনের পক্ষে দেশটির রাজনীতিবিদদের অবস্থানের বিষয়ে সেনাবাহিনীর সমর্থন আছে বলে জানানো হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের এ বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী বলেছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কিছু ব্যক্তির ক্ষতিকর অপপ্রচার চালানোর কারণে দেশটির সেনাবাহিনী ও সমাজের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে।
পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন শাহবাজ শরিফ। তবে এতসব ঘটনার মধ্যেও সামনে এসেছে দেশটির রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর প্রভাবের বিষয়টি।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ বিভাগ জানিয়েছে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে রক্ষার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী সব সময় চেষ্টা করছে এবং তারা ভবিষ্যতেও এটা করবে। কোনো ধরনের আপস ছাড়াই এটা করা হবে।
বিভিন্ন নাটকীয়তার মাধ্যমেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে হলো তেহরিক-ই ইনসাফের (পিটিআই) প্রধান ইমরান খানকে। এরপর পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন শাহবাজ শরিফ। তবে এতসব ঘটনার মধ্যেও সামনে এসেছে দেশটির রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর প্রভাবের বিষয়টি।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রচলিত আছে- পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর নেতা। আর দেশটির সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর নেতা হচ্ছে আসলে সেনাপ্রধান।
এটাও বলা হয়, পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি আর প্রতিরক্ষানীতি ঠিক হয় সেনা সদর দপ্তরে, সেখানে বেসামরিক প্রধানমন্ত্রীর কোন এখতিয়ারই নেই। যখনই পাকিস্তানে কোনো বেসামরিক সরকার ক্ষমতায় থেকেছে, সেটা যে রাজনৈতিক দলেরই হোক, তাদেরকে একটা আপোস বা সমঝোতা করতে হয়েছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে। কিন্তু দেশটির রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর প্রভাব এত বেশি কেন। জানা যায়, পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ নতুন কিছু নয়।
পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকভাবেই দেশটির সামরিক বাহিনী বেশ শক্তিশালী হিসেবেই আবির্ভূত হয়। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পরপরই ভারতের সঙ্গে সীমানা নিয়ে বিরোধ শুরু হয়। এক বছরের মধ্যে কাশ্মীর নিয়ে প্রথম দফার যুদ্ধও হয়ে যায়। যার কারণে পাকিস্তান সব কিছুর আগে প্রতিরক্ষা তথা সামরিক বাহিনীকে অগ্রাধিকার দিয়ে আসছে।
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর দেশটিতে এ পর্যন্ত তিনটি সফল সেনা অভ্যুত্থান হয়েছে। এর মধ্যে প্রথমটি হয় ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের নেতৃত্বে এবং ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। এরপর ব্যাবপ গণবিক্ষোভের মুখে আইয়ুব খানের পতন হলে দেশটির ক্ষমতা দখল করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহইয়া খান। কিন্তু দু’বছর পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজয়ের পর তাকেও ক্ষমতা ছাড়তে হয়। এরপর ১৯৭৭ সালে দ্বিতীয় সফল সেনা অভ্যুত্থান হয় জিয়াউল হকের নেতৃত্বে। ১৯৭৭ সালে তিনি সামরিক আইন জারি করেন এবং এর পরের বছর ১৯৭৮ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট হন। তিনি ক্ষমতায় ছিলেন ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত। পাকিস্তানের তৃতীয় সেনা অভ্যুত্থান হয় ১৯৯৯ সালে জেনারেল পারভেজ মোশাররফের নেতৃত্বে। পরে অবশ্য ২০০১ সালে তিনি বেসামরিক প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আসেন।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রীয় সম্পদে যে পরিমাণ ভাগ পায় তা দিয়ে তারা তাদের কাঠামোগত শক্তিও বৃদ্ধি করেছে বছরের পর বছর ধরে। ২০১৬ সালে পাকিস্তানের সিনেট রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৭ সালে সেনাবাহিনী প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলারের একটি বাজেট নেয় নিজেদের জন্য। যা সেবছর দেশটির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সরকারি ব্যায় ছিল। কমপক্ষে ৫০টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে ব্যাবসায়িক অংশীদারিত্ব রয়েছে সেনাবাহিনীর। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বেকারি এবং চিনির কারখানা থেকে শুরু করে ব্যাংক-এয়ারলাইন্সও রয়েছে। ২০০৮ সালে দেশটির সেনাবাহিনীর বিনিয়োগ ছিল আনুমানিক প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার।
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী নিজেদের অভ্যন্তরে অটোনমি রক্ষা করে চলে, সেখানে তারা কাওকে হস্তক্ষেপ করতে দেয় না। পাকিস্তানের সামরিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব সামরিক বাহিনীকে যে কোনো স্বাধীনতা দিয়েছে এবং তাদের মধ্যে কোনো হস্তক্ষেপ করতে যায়নি। দেশটির সামরিক বাহিনীও বেসামরিক সরকারকে বলেছে যে, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করতে হলে তাদের পূর্ণ স্বাধীনতা দরকার। আর এই স্বাধীনতার ব্যবহার করে সামরিক বাহিনী শুধু তাদের সক্ষমতাই বাড়ায়নি, বরং কর্পোরেট এবং প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়ও গড়ে তুলেছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তানে যেসব রাজনৈতিক কাঠামো ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলো কখনই শক্তিশালীভাবে গড়ে ওঠেনি। এর প্রধান কারণ হচ্ছে—বিভিন্ন সময়ে সামরিক বাহিনী রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছে। আর রাজনৈতিক নেতৃত্বে দুর্বলতার কারণে বারবার শক্তির বিচারে রাজনীতির তুলনায় সামরিক বাহিনী এগিয়ে থেকেছে। এছাড়া পাকিস্তানে যেসব রাজনৈতিক দল রয়েছে তারা বিভিন্ন সময়ে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করতে চেয়েছে। তারা সেনাবাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে ক্ষমতায় আসা, ক্ষমতা ধরে রাখা বা কাউকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ— সেটাও করেছে। আর এসব কারণেই একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ভূমিকায় রয়েছে দেশটির সামরিক বাহিনী। এ ছাড়া দেশটির রাজনৈতিক দলগুলোও পারষ্পারিক কোন্দলে যুক্ত থাকার কারণে পাকিস্তানে রাজনৈতিক একক কোনো দলও যেমন গড়ে ওঠেনি তেমনি এসব রাজনৈতিক দলের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থাও কমতে শুরু করেছে। এ ছাড়া পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোর বিকল্প হিসেবেও অনেক ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ চায় সাধারণ মানুষ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭২১
আপনার মতামত জানানঃ