নগদ-সম্পর্কিত নিয়োগে অনিয়ম ও ১৫০ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্কটি বাংলাদেশের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) নগদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগ এবং মোটা অঙ্কের অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে অনুসন্ধানে নেমেছে। এই ঘটনায় প্রধান উপদেষ্টার একজন বিশেষ সহকারীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা আতিক মোর্শেদ ও তার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হয়।
দুদকের দাবি অনুযায়ী, প্রাথমিক অনুসন্ধানে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়মের সত্যতা মিলেছে এবং অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের ভিত্তিতে তথ্যপ্রমাণ চাওয়া হয়েছে। যদিও দুদক আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করেনি যে আতিক মোর্শেদকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে কিনা, তবু তার দুদকে গিয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এই ঘটনা সামনে আসার পর বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে—ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের দুর্নীতির দায় সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টারা এড়াতে পারেন কি না। এই প্রশ্নের উত্তরে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান স্পষ্ট করে বলেছেন, একজন এপিএস বা ব্যক্তিগত কর্মকর্তার দায়িত্বে দুর্নীতির দায় যে উপদেষ্টার অধীনে সে কাজ করেছে, তারও এড়ানোর সুযোগ নেই। বরং এ ধরনের অভিযোগ উঠলে সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টার উচিত দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়ে নিরপেক্ষ তদন্তে সহযোগিতা করা।
ইতিমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের দুই উপদেষ্টা—আসিফ মাহমুদ ও নূরজাহান বেগমের ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ উঠে এসেছে, যার প্রেক্ষিতে তাদেরকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। দুদক জানিয়েছে, মোয়াজ্জেম হোসেন (আসিফ মাহমুদের এপিএস) এবং তুহিন ফারাবী (নূরজাহান বেগমের পিও) এর বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে এবং মোয়াজ্জেম হোসেনের বিদেশ যাত্রায় আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এমনকি তার জাতীয় পরিচয়পত্রও ব্লক করা হয়েছে।
এই অনুসন্ধানে নানা ধরণের অভিযোগ উঠে এসেছে—ক্ষমতার অপব্যবহার, তদবির বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্য এবং চাঁদাবাজির মতো গুরুতর অনিয়ম। এই প্রসঙ্গে আসিফ মাহমুদ জানিয়েছেন, অভিযোগ শোনা মাত্র তিনি নিজেই দুদককে তদন্তের অনুরোধ করেছেন এবং মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করতে বলেছেন।
নগদ-সংক্রান্ত অভিযোগে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা আতিক মোর্শেদের স্ত্রীকে ১ লাখ ৩৪ হাজার টাকা বেতনে চাকরি দেওয়ার বিষয়টি বিশেষভাবে আলোচনায় এসেছে। যদিও মোর্শেদ দাবি করেছেন যে তার স্ত্রী মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরি পেয়েছেন, তবে দুদকের বক্তব্য অনুযায়ী নিয়োগ সংক্রান্ত অভিযোগ আংশিক সত্য বলে প্রতীয়মান হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে দুর্নীতি দমন কমিশনের কার্যক্রম এবং রাজনৈতিক দায়িত্ববোধ নিয়ে আবারও আলোচনা শুরু হয়েছে। অতীতে এমন অনেক ঘটনার উদাহরণ রয়েছে যেখানে ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বা উপদেষ্টারা দায় এড়াতে পেরেছেন। যেমন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক ব্যক্তিগত কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানোর আগে ৪০০ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হন, কিন্তু তার বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
এইসব ঘটনা প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের অপব্যবহার এবং তাদের ওপর রাজনৈতিক ছত্রছায়া দুর্নীতি দমনে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে যখন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা বা উপদেষ্টারা নিজেদের দায় এড়িয়ে যান অথবা দায় স্বীকার না করে অভিযোগকে এড়িয়ে যান, তখন দুর্নীতি প্রতিরোধের পথ কঠিন হয়ে পড়ে।
এই প্রেক্ষাপটে সাধারণ মানুষের দাবি, দুর্নীতির অভিযোগে জড়িত ব্যক্তিই হোক বা তার সহযোগী, প্রত্যেকের জন্য একই ধরনের তদন্ত এবং বিচার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা হোক। শুধু কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে ঊর্ধ্বতনদের দায়মুক্তি দেওয়ার সংস্কৃতি বন্ধ না হলে প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না।
এই ঘটনার রাজনৈতিক প্রভাব এবং জনগণের মধ্যে এর প্রতিক্রিয়াও বিবেচ্য বিষয়। একদিকে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যবহার ও ঘনিষ্ঠদের চাকরিতে অগ্রাধিকার দেওয়া জনগণের আস্থার সঙ্কট তৈরি করে, অন্যদিকে এসব ঘটনা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক দোষারোপ এবং দায় এড়ানোর প্রবণতাও বাড়িয়ে তোলে।
তাই প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা সকল স্তরের ব্যক্তিদের উচিত ব্যক্তিগত ও পেশাদারী আচরণে সততা বজায় রাখা এবং কোনো অভিযোগ উঠলে তা স্বচ্ছভাবে তদন্তে সহায়তা করা। একইসাথে দুদকের উচিত নিরপেক্ষ ও দৃঢ় অবস্থান নিয়ে যেকোনো প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধেও সমানভাবে ব্যবস্থা নেওয়া, যাতে ভবিষ্যতে কেউ আর আইনের ঊর্ধ্বে ভাবতে না পারে।
এই বিতর্ক শুধু একজন ব্যক্তিগত কর্মকর্তার দুর্নীতি নিয়ে নয়—এটি বাংলাদেশের নৈতিক কাঠামো, প্রশাসনিক জবাবদিহিতা এবং দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান কতটা কার্যকর, সেটিরও পরীক্ষা।
আপনার মতামত জানানঃ