বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহিংসতার কারণ ও বৈশিষ্ট্য তার প্রতিবেশীদের থেকে স্বতন্ত্র৷ শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানে যেমন জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রকট, ভারতের যেমন সাম্প্রদায়িক ও জাতপাত সমস্যা, সেভাবে বাংলাদেশে সহিংসতার সংকট নেই৷
এরপরেও প্রধানত সমগোত্রীয় সমাজব্যবস্থা হয়েও বাংলাদেশ বিপজ্জনকভাবে একটি রাজনৈতিক সহিংসতাপ্রবণ দেশ থেকে ক্রমশ একটি উচ্চমাত্রার রাজনৈতিক সন্ত্রাসপ্রবণ দেশে রূপান্তরিত হচ্ছে কিনা, সেটা একটা বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে৷ অন্যদিকে বিচারহীনতা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, সামাজিক সন্ত্রাস উদ্বেগজনকভাবে চলমান এবং প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পরমতসহিষ্ণুতার ঘাটতি বেড়েই যাচ্ছে৷ এমনকি নির্বাচনি সহিংসতায় আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার ও প্রাণহানি প্রায় নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হতে চলেছে৷
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত ৩ মাসে দেশে ১৯৩টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় মোট ৪০ জন নিহত হয়েছেন।
রোববার (১০ এপ্রিল) আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য দেওয়া হয়েছে।
দেশের কয়েকটি জাতীয় দৈনিক ও অনলাইন পত্রিকার বরাত দিয়ে মানবাধিকার সংস্থাটি প্রতিবেদনে জানায়, এ ঘটনাগুলোতে মোট ২ হাজার ১৭৩ জন আহত হয়েছেন।
নিহত ৪০ জনের মধ্যে ১০ জন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা ও সমর্থক ছিলেন। বাকি ৩০ জনের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় ছিল না।
আসক আরও জানায়, গত ৩ মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে ২৩৮টি ধর্ষণ ও ৩৫টি ধর্ষণচেষ্টা হয়েছে। ১৩টি ধর্ষণ পরবর্তী খুন ও ধর্ষণের পর ৩টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। ৪৮ জন নারী তাদের স্বামীর হাতে খুন হয়েছেন।
এছাড়া তিন মাসে ১৩৭টি শিশু হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার মধ্যে ৫৮টিতে মামলা হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর হরতাল-অবরোধ আর সহিংসতা চালিয়ে দেশের বহমান অগ্রগতির রাস্তায় কাদা তৈরি করে অর্থনীতির সচল চাকাকে অচল করে ভোটের রাজনীতিতে টু পাইস কামাতে চায়। তাদের এই সহজ কিন্তু বিপজ্জনক পেশা শুধু আমাদের সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকেই আটকে দিচ্ছে না; আটকে দিচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকেও।
আসলে আমরা আজ যে সমাজে বাস করছি সে সমাজ আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না, এমনকি যে রাষ্ট্রে বাস করছি সে রাষ্ট্রও নিরাপত্তাদানে অপারগ। আমরা নানা রকম সামাজিক এবং রাষ্ট্রিক সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করেও বারবার ব্যর্থ হচ্ছি। সামাজিক মূল্যবোধ তথা ধৈর্য, উদারতা, কতর্ব্যনিষ্ঠা, ন্যায়পরায়ণতা, শৃঙ্খলা, শিষ্টাচার সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যবসায়, নান্দনিক সৃষ্টিশীলতা, দেশপ্রেম, কল্যাণবোধ, পারস্পরিক মমতাবোধ ইত্যাদি নৈতিক গুণাবলি লোপ পাওয়ার কারণেই সামাজিক অবক্ষয় দেখা দেয়। যা বতর্মান সমাজে প্রকট। মনে রাখতে হবে, বিশৃঙ্খল সমাজে বসবাস করে উন্নত রুচি ও সংস্কৃতির অধিকারী হওয়া যায় না। আমরা চাই, পরিকল্পিত ও বিন্যস্ত সমাজ। নীতিবোধ ও চারিত্রিক মূল্যবোধ সমাজ গঠনের প্রধান শক্তি- যা আমরা হারিয়ে ফেলেছি।
আমরা দীর্ঘদিন থেকেই লক্ষ্য করে আসছি- রাজনৈতিক সহিংসতা, ধর্ষণ ও হত্যার মতো বিপজ্জনক অপরাধমূলক প্রবণতা সমাজে ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি।
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তারা বলেন, ‘আদর্শিক রাজনীতি এক জিনিস। যেমন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কিংবা গণতন্ত্রের জন্য রাজনীতি হচ্ছে আদর্শের রাজনীতি। সেই বিষয়টি আলাদা। কিন্তু রাজনীতির উদ্দেশ্য যদি হয় জমি দখল, ঠিকাদারি, চাঁদাবাজি, তাহলে সেটা রাজনীতি হবে না। সেটা হবে রাজনৈতিক ছদ্মবেশে দুর্বৃত্ত্বায়ন। আমাদের দেশে এখন রাজনৈতিক ছদ্মবেশে দুর্বৃত্ত্বায়ন হচ্ছে। আমরা প্রত্যাশা করি, রাজনীতি হবে নীতির জন্য ও আদর্শের জন্য। রাজনীতি যদি হানাহানির জন্য হয় সেই রাজনীতি প্রত্যাশিত নয়।’
তারা বলেন, আধিপত্য বিস্তার, প্রভাব বিস্তার ও ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার চেষ্টা ও আদর্শবর্জিত রাজনীতির চর্চার কারণেই অভ্যন্তরীণ সংঘাত বেড়ে যাচ্ছে। নিজ রাজনৈতিক দলের ভেতরে এ প্রতিযোগিতা চলবে। যেহেতু রাজনীতিটা আদর্শবিহীন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে জবাবদিহিতা নাই, স্বচ্ছতা নাই। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রেও এগুলো নাই। এ কারণেই সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮২০
আপনার মতামত জানানঃ