রাজধানীর শাহজাহানপুরে দুর্বৃত্তদের গুলিতে সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু (৫৫) ও বেগম বদরুন্নেসা সরকারি বালিকা কলেজের ছাত্রী সামিয়া আফনান প্রীতি (২০) হত্যার ঘটনায় অন্যতম পরিকল্পনাকারীসহ চারজনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব।
এর আগে ওই হত্যা মামলায় দু’জনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। তারা এখন রিমান্ডে রয়েছে।
শুক্রবার রাত ১২টার দিকে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পাঠানো বার্তায় জানানো হয়, ‘বহুল আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর জাহিদুল ইসলাম টিপু ও সামিয়া আফরান প্রীতি হত্যাকাণ্ডের অন্যতম মাস্টারমাইন্ড এবং টিপুকে অনুসরণকারীসহ চারজনকে রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেফতার করেছে র্যাব।’
জড়িত আ’লীগ নেতা
ঢাকার শাহজাহানপুরে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু খুনের পরিকল্পনাকারী হিসেবে ক্ষমতাসীন দলটিরই স্থানীয় এক নেতাকে চিহ্নিত করার কথা জানিয়েছে র্যাব।
চিহ্নিত এই ব্যক্তি হলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক। তিনিসহ চারজনকে গ্রেপ্তারের পর আজ শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের মুখপাত্র খন্দকার আল-মঈন বলেছেন, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে টিপু হত্যাকাণ্ড ঘটে।
গ্রেপ্তার অন্য তিনজন হলেন আবু সালেহ শিকদার ওরফে শুটার সালেহ (৩৮), নাছির উদ্দিন ওরফে কিলার নাছির (৩৮) এবং মোরশেদুল আলম ওরফে কাইল্লা পলাশ (৫১) এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সব মিলিয়ে ছয়জন গ্রেপ্তার হলেন।
র্যাব জানিয়েছে, মুগদা, শাহজাহানপুর ও মিরপুর এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে হত্যাকাণ্ডের সময় নজরদারির কাজে ব্যবহার করা মোটর সাইকেল এবং হত্যার জন্য দেওয়া ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা ও মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়।
এর আগে ওই হত্যা মামলায় মাসুম মোহাম্মদ আকাশ ও আরফান উল্লাহ দামাল দুজনকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ; যারা এখন রিমান্ডে রয়েছে।
ঢাকার শাহজাহানপুরের আমতলী এলাকার রাস্তায় ২৪ মার্চ রাতে অস্ত্রধারীর গুলিতে নিহত হন আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু (৫৪)। তার মাইক্রোবাসের পাশে দাঁড়িয়ে গুলি ছোড়ে হেলমেটধারী আততায়ী।
ওই সময় গাড়ির কাছেই রিকশায় থাকা বদরুন্নেছা সরকারী মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী সামিয়া আফনান প্রীতিও গুলিতে নিহত হন। আহত হন টিপুর গাড়ি চালক মুন্না। মাত্র মিনিটখানেকের মধ্যে কাজ সেরে হামলাকারী সড়ক বিভাজক টপকে গুলি করতে করতে রাস্তার অন্য পাশে অপেক্ষায় থাকা একটি মোটরসাইকেলে উঠে পালিয়ে যান।
এ ঘটনায় টিপুর স্ত্রী ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফারহানা ইসলাম ডলি শাহজাহানপুর থানায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা দায়ের করেন।
সূত্র মতে, টিপু এক সময় মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। কিন্তু ২০১৩ সালে ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াজুল হক মিল্কী হত্যামামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর দলে পদ হারান তিনি।
পরে অবশ্য ওই মামলা থেকে টিপু অব্যাহতি পান বলে তার সহকর্মীরা জানিয়েছেন। তিনি দলীয় পদ আর ফিরে না পেলেও তার স্ত্রী ফারহানা ইসলাম ডলি ওই এলাকার নারী ওয়ার্ড কাউন্সিলর।
যে ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ফারুক গ্রেপ্তার হয়েছেন, সেই ১০ নম্বর ওয়ার্ডে টিপুর হোটেল রয়েছে, যেখানে তিনি নিয়মিত বসতেন।
এছাড়া জাতীয় ক্রীড়া পরিষদসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদারি করতেন টিপু। পাশাপাশি মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল পরিচালনা পর্ষদের সদস্যও ছিলেন তিনি।
এদিকে, র্যাব মুখপাত্র আল মঈন বলেন, গ্রেপ্তার চারজন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনায় সম্পৃক্ততা সম্পর্কে তথ্য দিয়েছে।
“দীর্ঘদিন যাবৎ মতিঝিল এলাকার চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, স্কুল-কলেজের ভর্তি বাণিজ্য, বাজার নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে টিপু ও হত্যার পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে বিরোধ বিদ্যমান ছিল।”
হত্যাকাণ্ড দেশে হলেও তার নিয়ন্ত্রণ দুবাইয়ে হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, “দেশ থেকে কিলার নাছির, কাইল্লা পলাশসহ আরও কয়েকজন জাহিদুল ইসলাম টিপুর অবস্থান সম্পর্কে বেশ কয়েকদিন যাবত মুসার কাছে তথ্য প্রেরণ করত। ঘটনার দিন সন্ধ্যার পর কিলার নাছির আনুমানিক চারবার জাহিদুল ইসলাম টিপুর অবস্থান সম্পর্কে মুসাকে অবহিত করে।”
টিপু হত্যাকাণ্ডের পর ঘুরেফিরে আসছে মুসার নাম, যিনি তালিকাভুক্ত শীর্ষসন্ত্রাসী প্রকাশ-বিকাশের সহযোগী বলে পুলিশের ভাষ্য।
হত্যার রাজনীতি
দক্ষিণ-এশীয় রাষ্ট্রগুলো নৃশংস রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের উর্বর ভূমি। প্রতিহিংসার রাজনীতি দক্ষিণ এশিয়ায় একটি অতি স্বাভাবিক বিষয় বলেই আমরা ধরে নেই।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক হত্যা বাড়ছে। আর এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো ঘটছে আধিপত্য নিয়ে। নিজেদের মধ্যেও দ্বন্দ্বের কারণেও ঘটছে হত্যাকাণ্ড। ঘটছে গুপ্ত হত্যা।
২০২১ সালের প্রথম ১১ মাসে ৬৮৮টি রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছে ১৩০ জন। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন ৮ হাজার ৫৯৪ জন।
নিহতদের মধ্যে ৫৭ জন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা ও সমর্থক, ৪ জন বিএনপির নেতাকর্মী ও ১ জন সাংবাদিক। নিহতদের মধ্যে ৫০ জনের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই।
এই সময়ের মাঝে শিশু হত্যা হয়েছে ৫৪৭ এবং স্বামীর নির্যাতনে মারা গেছে ২১৩ নারী। এই ১১ মাসে নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ২৪৭টি এবং ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা ৪৬টি। আর ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছে ৯ জন নারী। এছাড়াও ধর্ষণের চেষ্টা হয়েছে ২৮৬ জনের সাথে।
এতে আরও বলা হয়, বিগত ১১ মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে থাকাকালে প্রাণ গেছে ৬৭ জনের।
অবশ্য এর আগের বছর ২০২০ সালে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড অনেক কম ছিলো। ওই বছর পুরো ১২ মাসে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ৩১টি। তার মধ্যে নির্বাচনী সংঘাতে মারা গেছে পাঁচ জন। গত বছর অল্প কিছু নির্বাচন ও উপনির্বাচন ছিলে। এরমধ্যে উপজেলা নির্বাচনে একজন এবং পৌর ও সিটি নির্বাচনে চার জন নিহত হন।
২০১৯ সালে রাজনৈতি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ৩৯টি। তার মধ্যে বিভিন্ন নির্বাচনে নিহত হয়েছেন ২৫ জন। ২০১৮ সাল ছিলো একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছর। ওই বছর রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ৬৯টি। ২০১৭ সালে রাজনৈতিক হত্যাকান্ড হয়েছে ৫২টি।
আসকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়। ২০১৭ সাল থেকে এপর্যন্ত রাজনৈতিক হত্যা চলতি বছরেই বেশি ঘটেছে।
এদিকে, ব্যক্তি উদ্যোগে পাওয়া পুলিশের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় বছরে ঢাকায় গড়ে ২৫০টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আর সারাদেশে কম বেশি চার হাজার।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) হিসাব বলছে গত ফেব্রুয়ারি মাসে রাজধানীতে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ১২টি। তার আগে জানুয়ারি মাসে নয়টি। বছর হিসেবে দেখা যায় ২০২১ সালে ঢাকায় ১৬৬টি এবং ২০২০ সালে ২১৯টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
রাজধানীতে ২০০৮ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১৪ বছরে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তিন হাজার ৩৭৫টি, গড়ে প্রতিবছর ২৪১টি।
এই তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, ঢাকায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কখনো সামান্য কমে আবার আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে। কোনো স্পর্শকাতর বা আলোচিত হত্যাকাণ্ড ঘটলে তখন তা আলোচনায় আসে। পুলিশের তৎপরতা বাড়ে। সংবাদমাধ্যমে আসে। কিছুদিন পর আবার চুপ।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৩০
আপনার মতামত জানানঃ