যে কোনো জাতিরাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক উন্নয়নে সমাজ-ধনবিজ্ঞানের প্রাসঙ্গিক অনুষঙ্গগুলোর প্রয়োগ প্রক্রিয়ার উৎকর্ষকতা কল্যাণমুখী মানবিক সমাজ বিনির্মাণে প্রণিধানযোগ্য অবদান রেখে আসছে। অনগ্রসর থেকে প্রাগ্রসর সমাজে পরিণত হওয়ার পটভূমিতে রয়েছে শিল্প-নগরায়নের শক্তিমান গতিশীলতার ব্যাপক প্রভাব। ক্ষুদ্রায়তনের জনঅধ্যুষিত বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বিগত কয়েক দশক শ্রমঘন শিল্পের প্রসার এবং গুণগত মানসম্মত উৎপাদিত পণ্যের বিতরণ-বাণিজ্যিকীকরণ দেশের রাজস্ব খাতে অবদান রাখার ক্ষেত্রে অসাধারণ পরিতোষ সৃজনে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। এরই আলোকে দেশে শিল্পঋণ বিতরণ-ব্যবহার-অতিরঞ্জিত প্রতারণা-চিহ্নিত মাফিয়া চক্রের সিন্ডিকেট কর্তৃক ঋণগ্রহণে যথেচ্ছাচার-অপকৌশলে বিদেশে অর্থ পাচার দেশকে নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করেছে।
করোনার কারণে গত দুই বছর ঋণ পরিশোধে ঢালাও সুবিধা পেয়েছে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো। দেওয়া হয়েছে বিশেষ সুবিধাও। তারপরও শিল্প খাতে বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ।
গত বছর ডিসেম্বর শেষে শিল্প খাতে মোট ঋণ স্থিতি ছিল ৬ লাখ ২৮ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৯ হাজার ২৬২ কোটি টাকা। এ অংক মোট ঋণের ৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ। এর আগে ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে শিল্প ঋণের স্থিতি ছিল ৫ লাখ ৭২ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা। ওই সময়ে এ খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ৪৫ হাজার ৪১৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে শিল্প খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ হাজার ৮৪৭ কোটি টাকা। আর ঋণস্থিতি বেড়েছে ৫৬ হাজার ৬৩৭ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঋণ নিচ্ছে কিন্তু পরিশোধ করছে না। ফলে ঋণের বড় অংশই একের পর এক খেলাপি হয়ে পড়েছে। নানা উদ্যোগের পরও খেলাপি ঋণের লাগাম টানতে পারছে না নিয়ন্ত্রণ সংস্থা। এতে দেশের ব্যাংকিং খাত এখন নড়বড়ে অবস্থায় রয়েছে। বড় শিল্পে ঋণ কেলেঙ্কারিসহ নানা অনিয়মের কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ঋণ বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যদিও বেশি মুনাফার সুযোগের ফলে বরাবরই বড় শিল্প ঋণে ঝুঁকছে ব্যাংকগুলো।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪ লাখ ৯ হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে শিল্প খাতে বিতরণ হয়েছে ৪ লাখ ২৯ হাজার ৪৭০ কোটি। সুতরাং ব্যাংকের মোট ঋণের ৩০ দশমিক ৪৭ শতাংশ বিতরণ করা হয়েছে শিল্প খাতে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে শিল্প খাতের খেলাপি ছিল ৪৯ হাজার ২৬২ কোটি। হিসাব অনুযায়ী ব্যাংকিং খাতের মোট খেলাপির ৪৭ দশমিক ৭০ শতাংশই শিল্প খাতের।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত শিল্প খাতে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ৪ লাখ ২৯ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা, যা ২০২০ সালের একই সময়ে (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) ছিল ৩ লাখ ৬১ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে শিল্প খাতে ঋণ বিতরণ বেড়েছে ৬১ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা বা ১৮ দশমিক ৯২ শতাংশ।
এদিকে শিল্প ঋণ বিতরণের বিপরীতে আদায়ের হার বৃদ্ধি পেয়েছে ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত শিল্প খাতে ঋণ আদায় হয়েছে ৩ লাখ ৫১ হাজার ৬২৭ কোটি টাকা, যা ২০২০ সালের একই সময়ে ছিল তিন লাখ ১৯ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে শিল্প খাতে ঋণ আদায় বেড়েছে ৩২ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা।
করোনার কারণে গত দুই বছর ঋণ পরিশোধে ঢালাও সুবিধা পেয়েছে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো। দেওয়া হয়েছে বিশেষ সুবিধাও। তারপরও শিল্প খাতে বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে শিল্প খাতে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৫ হাজার ৮২৭ কোটি টাকা। ২০২০ সাল শেষে এর পরিমাণ ছিল ৭০ হাজার ৬০৪ কোটি টাকা। এ হিসাবে এক বছরে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ বেড়েছে ১৫ হাজার ২২৩ কোটি টাকা বা ২১ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এছাড়া এ খাতে বিতরণ করা ঋণের মধ্যে ছয় লাখ ২৮ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। এই অংক আগের বছরের তুলনায় ৯ দশমিক ৯০ শতাংশ বেশি। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে বকেয়া ছিল ৫ লাখ ৭২ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা।
শিল্প খাতে এ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার পেছনে মূলত দু’টি কারণ উল্লেখ করেন বিশ্লেষকরা। তারা বলেন, অনেকেই শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য ঋণ নেন। কিন্তু সেই ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তারা পরিশোধ করেন না। এটাকে তারা ইচ্ছেকৃত খেলাপি ঋণ বলেন। এর বিরুদ্ধে অবশ্যই পদক্ষেপ নেয়া দরকার বলে মনে করেন তারা।
আরেক ধরনের খেলাপি ঋণ আছে, যেটা প্রকৃত পক্ষেই খেলাপি হয়ে গেছে। আর তা হলো, একজন উদ্যোক্তা কারখানা করার জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি করলেন। জমি কিনে অবকাঠামো নির্মাণ করে তা স্থাপনও করা হলো। কিন্তু শিল্প চালু করার জন্য গ্যাস সংযোগ পাওয়া গেলো না। এতে ওই উদ্যোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত হলেন। সময়মতো কারখানা চালু করতে না পারায় ব্যাংক ঋণও সময়মতো পরিশোধ করতে না পারায় ব্যাংকের খাতায় তিনি খেলাপি হয়ে গেলেন। এভাবে অনেক উদ্যোক্তাই ঋণখেলাপির খাতায় নাম লেখিয়েছেন। এটাকে তারা অনিচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ হিসেবে দেখছেন।
তারা মনে করেন, সামগ্রিকভাবেই খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাড়ছে। আবার বর্তমান অবস্থায় অনেকেই কিছুটা চাপে রয়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য তারা ঋণের সুদহার এক অঙ্ক কার্যকর করার অনুরোধ জানিয়েছেন।
ব্যাংকসংশ্লিষ্ট বিজ্ঞজনের মতে, খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতি কমাতে হলে সুশাসন বাড়িয়ে দুর্নীতি বন্ধ করে প্রতিটি ঋণ যথাযথভাবে যাচাই-বাছাইয়ে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে ঋণের মান বাড়াতে হবে। ঋণ জালিয়াতির সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিদের শাস্তির দৃশ্যমানতা এবং স্বচ্ছতাই ঋণখেলাপি হ্রাসের সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করবে বলে তাদের মতামতে উঠে আসে।
তারা বলেন, ঢালাওভাবে সুবিধা দেবে; আদায়ে কোনো চাপ দেবে না তাহলে তো খেলাপি ঋণ বাড়বেই। কারণ খেলাপিরা দেখছে ঋণ পরিশোধ না করলেও কিছু হয় না। তাই তারা ঋণ ফেরত দিচ্ছে না। এ অবস্থা থেকে উন্নতি করতে হলে আদায় বাড়াতে হবে। এজন্য ব্যাংকগুলোকে টার্গেট দিয়ে দিতে হবে। যারা টার্গেট অনুযায়ী আদায় করতে পারবে না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮২০
আপনার মতামত জানানঃ