বিগত দুই বছর ধরে করোনার তুমুল দাপটে অন্যান্য রোগ বিষয়ে মানুষের আতঙ্ক অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। তবে রোগ হ্রাস পেয়েছে, এমনটি নয়। করোনার দাপটে এক সময়কার মহামারি যক্ষ্মা চাপা পড়ে থাকলেও তা ছুপা রুস্তমের মতো এখনো মহামারির আসনেই রাজত্ব করে যাচ্ছে। বরং চলতি মহামারি করোনার চেয়ে আরও বেশি ভয়ানক রুপ নিয়ে নীরবে কাজ করে যাচ্ছে এই যক্ষ্মা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, যক্ষ্মা এখনো বাংলাদেশের জন্য বোঝা। সরকার ও বেসরকারি সংস্থা দীর্ঘদিন ধরে যক্ষ্মা প্রতিরোধে নানা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এরপরও দেশে দিনে যক্ষ্মায় আক্রান্ত ১২০ জন মারা যাচ্ছে।
বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস উপলক্ষে বৃহস্পতিবার(২৪ মার্চ) জাতীয় সংসদ ভবনে সংসদ সদস্যদের ক্লাবে এসব তথ্য উপস্থাপন করেছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি)। ডব্লিউএইচওর বরাত দিয়ে এসব তথ্য তুলে ধরেছে সংস্থাটি। এই রোগ ঠেকাতে প্রথম যক্ষ্মাবিষয়ক সংসদীয় ককাসের সূচনা আয়োজন করা হয় গতকাল। আইসিডিডিআরবির নেতৃত্বে ইউএসএআইডির ‘অ্যালায়েন্স ফর কমবেটিং টিবি ইন বাংলাদেশ’ প্রকল্পের উদ্যোগে এ আয়োজন করা হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। তিনি বলেন, সাংসদেরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে কাজ করছেন। যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণেও একইভাবে কাজ করতে হবে। আইসিডিডিআরবি ও ইউএসএআইডির এই প্ল্যাটফর্মে সাংসদেরা যুক্ত হবেন বলে তিনি আশা করেন।
আইসিডিডিআরবি জানায়, বাংলাদেশে প্রতিবছর ৩৫ হাজারের বেশি মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। ২০২০ সালে মারা গেছে ৪৪ হাজারজন, যা গত ২ বছরে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার চেয়ে বেশি। দেশে ৩ লাখ ৬০ হাজার যক্ষ্মা রোগী আছে।
আইসিডিডিআরবির নির্বাহী পরিচালক তাহমিদ আহমেদ বলেন, যক্ষ্মা এখনো অনেক বড় ইস্যু বাংলাদেশে। রোগটি প্রতিরোধযোগ্য হওয়ার পরও অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে। যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রোগ্রামটা কীভাবে আরও ফলপ্রসূ করা যায়, তা নিয়ে সাংসদদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে বলে জানান।
আইসিডিডিআরবির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ফেরদৌসী কাদরী বলেন, যক্ষ্মা হলে শুধু ব্যক্তির ক্ষতিই হয় না, এটি পুরো পরিবারের ক্ষতি ডেকে আনে। এই রোগ নির্মূলে এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো টিকা নেই।
যক্ষ্মা হলে শুধু ব্যক্তির ক্ষতিই হয় না, এটি পুরো পরিবারের ক্ষতি ডেকে আনে। এই রোগ নির্মূলে এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো টিকা নেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও করোনার চেয়ে যক্ষ্মা বড় উদ্বেগের কারণ হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর প্রায় ১৫ লাখ মানুষ যক্ষ্মায় মারা যান।
যক্ষ্মাবিষয়ক যৌথ পর্যবেক্ষণ মিশনের একাধিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শিশুদের যক্ষ্মা ঠিকমতো শনাক্ত হচ্ছে না। চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে যাওয়া রোগী জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে না। যক্ষ্মা পরীক্ষাগার বা ল্যাবরেটরিগুলো থেকে মানুষ কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছে না। এসব সমস্যার কথা ২০১৯ সালের সর্বশেষ পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা আছে। এর আগে ২০১০ ও ২০১৬ সালের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনেও এই সমস্যাগুলোর কথা বলা হয়েছিল।
করোনাভাইরাস মহামারি শেষ হলেও এর প্রভাব গরিবদের ওপর দীর্ঘদিন থেকে যাবে। দীর্ঘদিন রোগ শনাক্ত না হলে এর চিকিৎসা পেতে দেরি হবে। পরিস্থিতি জটিল হবে। মানুষ বেশি আক্রান্ত হবে এবং মারা যাবে। একটি পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, বিশ্বের বিভিন্ন অংশে তিন মাসের লকডাউন এবং অন্যান্য কারণে আরও ৬৩ লাখ মানুষ যক্ষ্মা আক্রান্ত হবে এবং ১৪ লাখ মানুষ মারা যাবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যথাসময়ে শনাক্ত না হলে আর মাঝপথে ওষুধ বন্ধ করে দিলে বিপজ্জনক হতে পারে যক্ষ্মা। বড় একটি অংশই থেকে যাচ্ছে শনাক্তের বাইরে। যারা আক্রান্ত পরে অন্যদের এবং ঝুঁকির কারণ হবে জনস্বাস্থ্যের জন্য।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হলে যক্ষ্মা প্রতিরোধ সম্ভব। জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির রিপোর্ট অনুযায়ী, এক দশক আগে যেখানে শনাক্ত রোগীর বিপরীতে সুস্থতার হার ছিল ৯২ শতাংশ, তা এখন ৯৬ শতাংশ। আর মৃত্যুহার ২ দশমিক ৯ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব কোম্পানি আগে স্বল্পমূল্যে যক্ষ্মা রোগ শনাক্তের যন্ত্রপাতি তৈরি করত, তারা সবাই এখন করোনাভাইরাসের পরীক্ষার আকর্ষণীয় ব্যবসায় নেমেছে।
চিকিৎসকরা বলেন, দুই সপ্তাহের বেশি কাশি হলে যক্ষ্মা হতে পারে, এই ধারণা একেবারে সত্যি। কারণ এ সত্যির বশবর্তী হয়ে সে নির্দিষ্ট পরীক্ষা কেন্দ্রে যাবে আর পরীক্ষা করাবে।
তারা বলেন, যদি সঠিক ওষুধ ও সঠিক পরিমাণ ডোজ এবং সময় পর্যন্ত অনুসরণ করে থাকে তাহলে কিন্তু কঠিন সমস্যা হয় না।
তারা আরও বলেন, সরকারের দেওয়া সময় অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছে, সময় চলে যাচ্ছ। কিন্তু আমাদের সেই ধরনের সাফল্যে আসছে না। আরও প্রচারণা দরকার এ ক্ষেত্রে।
আর করোনা মহামারির সময়েও যক্ষ্মা আক্রান্ত ব্যক্তিদের বাড়তি সচেতনতার তাগিদ বিশেষজ্ঞদের। পরামর্শ দিচ্ছেন, করোনা আক্রান্ত হলেই এসব ব্যক্তিদের হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৩৮
আপনার মতামত জানানঃ