প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত দেশব্যাপী এক কোটি পরিবারকে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে খাদ্য সরবরাহ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে ট্রাকের মাধ্যমে কয়েকটি পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে।
তবে ইতিমধ্যেই এ কর্মসূচিতে নানারকম অনিয়ম ও অব্যস্থাপনার খবর পাওয়া যাচ্ছে। কতজন প্রকৃত অসচ্ছল ও অভাবী পরিবার তালিকায় এসেছে, এ নিয়ে যেমন প্রশ্ন, তেমনি কার্ড তৈরির দায়িত্বপ্রাপ্ত ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যরা তাদের অনুসারী ও পছন্দের লোকদের কার্ড দিয়েছেন বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
এক পরিবারের একাধিক ব্যক্তির কাছে, অপেক্ষাকৃত সচ্ছল পরিবারকে এবং অর্থের বিনিময়ে কার্ড প্রদানসহ বরাদ্দ অনুসারে কম কার্ড বিতরণ, ওজনে কম দেওয়া, ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা, কার্ড নিয়েও পণ্য না পাওয়া এরকম নানা ভোগান্তির চিত্র দেখা যায় অনেক জেলায়। কম দামে পণ্য কিনতে গিয়ে কাজে যোগ দিতে না পেরে পুরো দিনের মজুরি হারাতে হয়েছে এরকম খবরও পাওয়া গেছে।
সারা দেশে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) কার্ডের মাধ্যমে পণ্য বিতরণ শুরু করলেও মিলছে না ক্রেতাদের স্বস্তি। অনেকেই কার্ড পেয়েও পণ্য পাননি, অনেকের আবার কার্ড নিতে গিয়ে করতে হয়েছে আর্থিক লেনদেন।
চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদায় এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ১০০ টাকার বিনিময়ে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) কার্ড দেয়ার অভিযোগ উঠেছে।
অভিযুক্ত মজিবর রহমানের বাড়ি উপজেলার কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়নের আরামডাঙ্গা গ্রামে।
আরামডাঙ্গা গ্রামের দিনমজুর জাহাঙ্গীর আলম অভিযোগে বলেন, ‘আমার টিসিবির পণ্য কেনার কার্ড করে দিতে ১০০ টাকা নিয়েছেন মজিবর। অন্যের থেকে ধার করে তাকে ১০০ টাকা দিয়েছি। পরে জানতে পারলাম কার্ড করতে কোনো টাকা লাগে না।’
একই গ্রামের দিনমজুর মহাসীন আলী বলেন, ‘কম দামে টিসিবির পণ্য পাওয়া যাবে এমন প্রলোভন দেখিয়ে কার্ড করে দিতে আমার কাছ থেকে ১০০ টাকা নেন মজিবর। তিনি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য বিল্লাল হোসেনের লোক।’
একই অভিযোগ আবু সুফিয়ানসহ এলাকার অনেকের।
সারা দেশে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) কার্ডের মাধ্যমে পণ্য বিতরণ শুরু করলেও মিলছে না ক্রেতাদের স্বস্তি। অনেকেই কার্ড পেয়েও পণ্য পাননি, অনেকের আবার কার্ড নিতে গিয়ে করতে হয়েছে আর্থিক লেনদেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দামুড়হুদার কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়নে ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পণ্য বিক্রির জন্য মোট ১ হাজার ৩৭৬টি কার্ড বরাদ্দ দেওয়া হয়, যার মধ্যে ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য ও ২ নম্বর প্যানেল চেয়ারম্যান বিল্লাল হোসেনকে ২০টি কার্ড দেওয়া হয়। বিল্লাল হোসেন এর মধ্যে কিছু কার্ড বিতরণের জন্য তার অনুসারী মজিবর রহমানকে দায়িত্ব দেন। মজিবর রহমান কার্ড বিতরণের সময় প্রত্যেকের কাছ থেকে ১০০ টাকা নেন। গতকাল বুধবার ইউনিয়ন পরিষদে পণ্য কেনার সময় ভুক্তভোগীরা টাকা নেওয়ার বিষয়টি স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের জানালে বিষয়টি প্রকাশ পায়।
আরামডাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা দিনমজুর জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘তেল–নুন দিয়ার কার্ড করার জন্যি মজিবারের কাচে ফটো দিয়ার সুমায় বলে যে ১০০ ট্যাকা দিয়ে যা। আমার কাচে ট্যাকা ছিল না। ধার কইরে ট্যাকাডা দিই।’
একই গ্রামের বৃদ্ধ জান মহাম্মদ বলেন, ‘গ্রামের সজীব এট্টা কার্ড দিয়েলো। ওই কার্ড দিয়ে জিনিস তুলে আনার পর বাড়ি আইলি বউমা জানায় যে তার কাচ থেইকে মজিবার ১০০ ট্যাকা নিয়েচে।’ একই ধরনের অভিযোগ করেন ওই গ্রামের বাসিন্দা দিনমজুর মহাসীন আলী ও আবু সুফিয়ান।
টাকা নিয়ে কার্ড করে দেয়ার বিষয়টি স্বীকার করে মজিবর রহমান বলেন, ‘আমি গরিব মানুষ, দিনমজুরের কাজ করে খাই। মেম্বার বিল্লালের সঙ্গে থাকি। এলাকার দরিদ্রদের কার্ডের কাজ করে দিতে গিয়ে নিজের কোনো কাজ করতে পারি না। তাই তাদের কাছ থেকে ১০০ টাকা করে নিয়েছি।’
তবে টাকা নেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য বিল্লাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমি টাকা নেয়ার বিষয়ে কিছুই জানি না।’
কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল করিম বিশ্বাস জানান, ইউনিয়নে ১ হাজার ৩৭৬ জন উপকারভোগীর তালিকা তৈরি করে কার্ডের মাধ্যমে নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে টিসিবির পণ্য বিক্রি করা হয়েছে। ক্রেতার তালিকা তৈরিতে অর্থ আদায়ের কোনো সুযোগ নেই। কেউ অবৈধভাবে অর্থ আদায় করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এই বিষয়ে দামুড়হুদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাছলিমা আক্তার বলেন, ‘ঘটনাটি শুনেছি। বিষয়টি তদন্ত করে দেখতে উপজেলা সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) বলা হয়েছে। আজ ঘটনাটি তদন্ত করতে যাবেন তিনি।’
জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, পবিত্র রমজানকে সামনে রেখে ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে স্বল্প মূল্যে নিত্যপণ্য বিক্রির জন্য চুয়াডাঙ্গা জেলায় ৭৪ হাজার ৫৫৬টি ফ্যামিলি কার্ড তৈরি করা হয়েছে। ২০ মার্চ থেকে কার্ডধারী উপকারভোগীদের কাছে ৪৬০ টাকার বিপরীতে ২ কেজি চিনি, ২ কেজি মসুর ডাল ও ২ লিটার সয়াবিনের তেল বিক্রি করা হচ্ছে। আজ ২৪ মার্চ পর্যন্ত ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে ৩৬ হাজার ২৫৮ জনের কাছে পণ্য বিক্রি করা হয়েছে।
আরেকটি সমস্যা হলো এত দিন টিসিবির পণ্য কিনতে সবাই লাইনে দাঁড়াতে পারতেন; কিন্তু এখন রাজধানী ছাড়া অন্য জেলায় পণ্য পাচ্ছে শুধু কার্ডধারীরা। এতে শহরাঞ্চলের বিভিন্ন কারখানায় কাজ করা শ্রমিক, কম বেতনের চাকরিজীবীর মতো নিম্নআয়ের বড় একটি জনগোষ্ঠী সরকারের এই বিশেষ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, করোনাকালে আয় কমা ও নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণে দেশে ছয় থেকে সাত কোটি নিম্নবিত্ত এখন কষ্টে রয়েছেন। ফলে সরকার যে পরিমাণ কার্ড দিয়েছে, তা পর্যাপ্ত নয় বলে প্রতিয়মান হচ্ছে। এ অবস্থায় আরও মানুষকে সহায়তার আওতায় আনতে কার্ডের সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন। পাশাপাশি লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য কেনার সুযোগও চালু রাখা যায় কি-না, সেই বিবেচনা করা দরকার।
তারা বলেন, করোনার আঘাতে চাকরিহারা, বেকার ও আয়-রোজগার কমে যাওয়া জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। তাই ফ্যামিলি কার্ড কর্মসূচি বাস্তবায়নে আরও সতর্ক ও আন্তরিক হতে হবে। যেসব দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। নইলে ফ্যামিলি কার্ডের সফলতা ব্যর্থতায় পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০৪৮
আপনার মতামত জানানঃ