সারা দেশে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে নিত্যপণ্য বিক্রি শুরু করেছে সরকার। বাজারের চেয়ে বেশ কম দামে ভোজ্যতেল, চিনি, ডাল ও পেঁয়াজ পেয়ে খুশি মানুষ। তবে অনিয়ম দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনা হানা দিয়েছে এই প্রচেষ্টায়ও।
বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনার আঘাতে চাকরিহারা, বেকার ও আয়-রোজগার কমে যাওয়া জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। তাই ফ্যামিলি কার্ড কর্মসূচি বাস্তবায়নে আরও সতর্ক ও আন্তরিক হতে হবে। যেসব দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। নইলে ফ্যামিলি কার্ডের সফলতা ব্যর্থতায় পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
অনিয়ম আর দুর্নীতি
সারাদেশে তৃণমূল পর্যায়ে নিম্ন আয়ের প্রায় এক কোটি পরিবারের মধ্যে টিসিবির পণ্যসামগ্রী পৌঁছে দেয়ার পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এ কার্ডের আওতায় স্থানীয় ডিলারদের মাধ্যমে পরিবারগুলো স্বল্পমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য যেমন- ২ লিটার সয়াবিন তেল, দুই কেজি চিনি ও দুই কেজি করে মসুর ডাল পাচ্ছে।
এ ছাড়া ৩ এপ্রিল রমজান শুরুর দিন থেকে এই তিন পণ্যের সঙ্গে দুই কেজি করে ছোলাও দেওয়া হবে। এ কর্মসূচি দরিদ্র মানুষের জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে, এতে সন্দেহ নেই।
তবে ইতিমধ্যেই এ কর্মসূচিতে নানারকম অনিয়ম ও অব্যস্থাপনার খবর পাওয়া যাচ্ছে। কতজন প্রকৃত অসচ্ছল ও অভাবী পরিবার তালিকায় এসেছে, এ নিয়ে যেমন প্রশ্ন, তেমনি কার্ড তৈরির দায়িত্বপ্রাপ্ত ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যরা তাদের অনুসারী ও পছন্দের লোকদের কার্ড দিয়েছেন বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
এক পরিবারের একাধিক ব্যক্তির কাছে, অপেক্ষাকৃত সচ্ছল পরিবারকে এবং অর্থের বিনিময়ে কার্ড প্রদানসহ বরাদ্দ অনুসারে কম কার্ড বিতরণ, ওজনে কম দেওয়া, ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা, কার্ড নিয়েও পণ্য না পাওয়া এরকম নানা ভোগান্তির চিত্র দেখা যায় অনেক জেলায়। কম দামে পণ্য কিনতে গিয়ে কাজে যোগ দিতে না পেরে পুরো দিনের মজুরি হারাতে হয়েছে এরকম খবরও পাওয়া গেছে।
আরেকটি সমস্যা হলো এত দিন টিসিবির পণ্য কিনতে সবাই লাইনে দাঁড়াতে পারতেন; কিন্তু এখন রাজধানী ছাড়া অন্য জেলায় পণ্য পাচ্ছে শুধু কার্ডধারীরা। এতে শহরাঞ্চলের বিভিন্ন কারখানায় কাজ করা শ্রমিক, কম বেতনের চাকরিজীবীর মতো নিম্নআয়ের বড় একটি জনগোষ্ঠী সরকারের এই বিশেষ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, করোনাকালে আয় কমা ও নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণে দেশে ছয় থেকে সাত কোটি নিম্নবিত্ত এখন কষ্টে রয়েছেন। ফলে সরকার যে পরিমাণ কার্ড দিয়েছে, তা পর্যাপ্ত নয় বলে প্রতিয়মান হচ্ছে। এ অবস্থায় আরও মানুষকে সহায়তার আওতায় আনতে কার্ডের সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন। পাশাপাশি লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য কেনার সুযোগও চালু রাখা যায় কি-না, সেই বিবেচনা করা দরকার।
কাউন্সিলরদের দুর্নীতি
ময়মনসিংহ শহরে সরকারি চাকরিজীবী ও সম্পদশালীদের কার্ড দিতে গিয়ে গরিব মানুষদের ঠকানোর সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া গেছে। স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের সঙ্গে আত্মীয়তা ও তাকে ভোট দেয়া হয় বলে কার্ড পাওয়ার কথা জানিয়েছেন উপকারভোগীরা।
চার তলা ভবনের এক মালিক বলেন, ‘সরকারি সুবিধা সবার জন্যই সমান। এ জন্য আমিও কার্ড সংগ্রহ করেছি। এটা আমার প্রাপ্য।’
ময়মনসিংহ শহরের আকুয়া মাদ্রাসা কোয়ার্টার এলাকার বাসিন্দা আব্দুল জব্বার একটি চার তলা ভবনের মালিক। বাসা থেকে প্রতি মাসে ভাড়া ওঠে ১ লাখ টাকার বেশি।
স্বল্প আয়ের এক কোটি মানুষকে ভর্তুকি মূল্যের কয়েকটি পণ্য দিতে সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে, সেটি পাওয়ার কথা ছিল না জব্বারের, কিন্তু তাকে এই কার্ড দেয়া হয়েছে।
প্রতি পরিবার একটি কার্ড পাওয়ার কথা থাকলেও জব্বারের স্ত্রী হেলেনা আক্তারও ফ্যামিলি কার্ড পেয়েছেন। এ ছাড়া জব্বারের শ্যালিকা রেহেনা আক্তার ও রেহেনার মেয়ে মেরী আক্তারকেও কার্ড দেয়া হয়েছে।
গত ২০ মার্চ থেকে সারা দেশে স্বল্প আয়ের এক কোটি পরিবারকে কম মূল্যে তেল, ছোলা, চিনি, খেজুর ও মসুর ডাল বিক্রির এই কার্যক্রম শুরু হয়। এতে সরকারকে প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে।
ময়মনসিংহে কয়েক দিন ধরে একেকটি কার্ডের বিপরীতে ৫৫ টাকা দরে দুই কেজি চিনি ও ৬৫ টাকা করে দুই কেজি ডাল এবং ১১০ টাকা দরে দুই লিটার সয়াবিন তেল দেয়া হচ্ছে। এতে একেকটি পরিবারের সাশ্রয় হয় ২৪০ টাকা।
জব্বার ও তার পরিবারের সচ্ছল চার স্বজন মিলিয়ে ভর্তুকি থেকে সুবিধা পেয়েছেন ১ হাজার ২০০ টাকা, যা আসলে তাদের এক দিনের আয়ের এক-তৃতীয়াংশেরও কম।
এই কর্মযজ্ঞের যে উদ্দেশ্য, তা জব্বারের মতো লোকদের কারণে ভেস্তে যাবে, সেটা বলাই বাহুল্য। কারণ তার পরিবারকে পাঁচটি কার্ড দিতে গিয়ে স্বল্প আয়ের পাঁচটি পরিবারকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
ধনাঢ্য মানুষটি স্বীকার করেন তিনি চেষ্টা-তদবির করে এই কার্ড জোগাড় করেছেন। ‘আপনার তো এই কার্ড নেয়ার দরকার নেই’, এমন উক্তির উত্তরে তিনি বলেন, ‘সরকারি সুবিধা সবার জন্যই সমান। এ জন্য আমিও কার্ড সংগ্রহ করেছি। এটা আমার প্রাপ্য।’
জব্বারের বাড়িটি ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের ৬ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায়। তার পরিবারকে চারটি কার্ড কোন বিবেচনায় দেয়া হলো জানতে চাইলে ওয়ার্ড কাউন্সিলর সৈয়দ শফিকুল ইসলাম কিছু বলতে পারেননি।
তিনি বলেন, ‘স্বজনপ্রীতি করে কাউকে কার্ড দেয়া হয়নি। ওই ব্যক্তি কীভাবে কার্ড পেল তা জানার চেষ্টা চলছে।’
সুনির্দিষ্ট উদাহরণ দেখানোর পরও তিনি বলেন, ‘আমার ওয়ার্ডে গরিব ও হতদরিদ্ররা কার্ড পেয়েছে। মাসে লাখ টাকা আয়ের লোকজন এই এলাকায় নেই বললেই চলে।’
অনিয়ম কেবল জব্বারের ক্ষেত্রে হয়েছে এমন নয়, ময়মনসিংহে এই কার্ড পেয়েছেন হামিদ উদ্দিন রোডের বাসিন্দা সরকারি চাকরিজীবী আব্দুল জলিল ও তার স্ত্রী।
আব্দুল জলিল কার্ড পাওয়ার বিষয়ে কিছু না বললেও তার ছেলে বলেন, ‘আমাদের পরিবারের সদস্যরা সব সময় কাউন্সিলরকে ভোট দেয়। এ ছাড়া আমরা কাউন্সিলরের আত্মীয়। তাই দুটি কার্ড পেয়েছি।’
একই এলাকার সচ্ছল আব্দুর রহমান পরিবারের চারজনের নামেও কার্ড এসেছে, তবে বঞ্চিত হয়েছেন অসংখ্য হতদরিদ্র। কার্ড পেয়ে খুশি আব্দুর রহমান। তিনি বলেন, ‘কাউন্সিলরের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক। তাই আমি ও স্ত্রীসহ বোন-ভাগনের নামে চারটি কার্ড পেয়েছি।’
‘আপনাদের পাওয়া কার্ডগুলো হতদরিদ্রদের প্রাপ্য ছিল কি না’, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এটা কাউন্সিলরের ব্যাপার। তারা যাচাই-বাছাই করেই কার্ড দেন। আমার কম দামে পণ্য প্রয়োজন, তাই কার্ড নিয়েছি। যারা বঞ্চিত হয়েছেন, তাদের উচিত কাউন্সিলরের সঙ্গে যোগাযোগ করা।’
তথ্য মিলেছে এই সম্পদশালীদের কার্ডের ব্যবস্থা করেছেন ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শরীফুল ইসলাম শরীফ, তবে তিনি দায় নিতে চান না।
তিনি বলেন, ‘আমি নিম্নবিত্ত লোকদের কার্ড বিতরণ করেছি। এ ছাড়া দলীয় নেতা-কর্মীরা তাদের মতো করে মেয়রের কাছ থেকে কার্ড এনে বিতরণ করেছেন।’
একপর্যায়ে কাউন্সিলর বলেন, ‘আমার ওয়ার্ডে নিম্ন আয়ের মানুষের সংখ্যা কম থাকায় কিছু কার্ড মধ্যবিত্ত লোকদের হাতেও দেয়া হয়েছে।’
এভাবে সচ্ছলদের কার্ড দেয়ার কারণে বঞ্চিত হয়েছেন মাদ্রাসা কোয়ার্টার এলাকার দিনমজুর ফয়জুল হক, জালাল উদ্দিনসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডের অসংখ্য নিম্নবিত্ত আয়ের লোকজন।
তাদের অভিযোগ, ভোটের হিসাব কষে এ কার্ডগুলো বিতরণ করেছেন কাউন্সিলররা। নিজ পক্ষের ভোটারসহ আত্মীয়স্বজনের কার্ড দেয়া হয়েছে।
সম্পদশালীদের কার্ড দিতে গিয়ে গরিব এই মানুষদের বঞ্চিত করার বিষয়ে জানতে চাইলে ওয়ার্ড কাউন্সিলর শরীফুল ইসলাম শরীফ বলেন, ‘নিম্নবিত্ত যারা এখনও কার্ড পায়নি, তাদের কার্ড দেয়ার ব্যবস্থা করব।’
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ এনামুল হক বলেন, ‘যারা কার্ড পাওয়ার উপযুক্ত, তাদেরকেই কার্ড দিতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আমরা সবকিছু তদারক করছি। কোথাও কোনো ধরনের অসংগতির প্রমাণ মিললেই ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
ময়মনসিংহে ১৫৩ জন ডিলারের মাধ্যমে ৫৬৬টি স্থানে ৩ লাখ ২ হাজার ৯৭১ জনকে দেয়া হচ্ছে টিসিবির পণ্য। এর মধ্যে সিটি করপোরেশনে ৭০ হাজার ৪০৯ জনকে পণ্য দেয়া হবে।
ফ্যামিলি কার্ড কাদের দেয়া হয় জানতে চাইলে টিসিবির সচিব মনজুর আলম প্রধান বলেন, নিম্ন আয় ও দরিদ্র মানুষদের জন্য এ কার্ড করা হয়েছে।
কার্ডগুলো কোনোভাবে উচ্চবিত্তদের দেয়ার সুযোগ আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই নয়।’
মনজুর আরও বলেন, কার্ডগুলো টিসিবি বিতরণ করে না। এগুলো স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়। কোনো অনিয়ম হলে সেটা স্থানীয় প্রশাসন বলতে পারবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫১০
আপনার মতামত জানানঃ