বিশ্বে চলছে সোশ্যাল মিডিয়ার রাজত্ব। যুগের চাহিদায় দিন দিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জনপ্রিয়তা বেড়েই চলছে। ফেসবুক ছাড়া এখন ভাবাই অসম্ভব। কী নেই এখানে? চাইলেই সবকিছু মেলে নেট দুনিয়ায়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে ফেসবুক। ভুয়া তথ্য প্রচার, অশালীন মন্তব্য ও ঘৃণা ছড়ানোর অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে এ মাধ্যম। এ ছাড়া ফেসবুকের বিরুদ্ধে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদে সমর্থন ও পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগ তুলেছেন বিশ্বের অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা। মানুষকে বিপথগামী করতে রীতিমতো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি।
মিয়ানমারে গণহত্যায় উসকানিতে ফেসবুক ব্যবহার করা হলেও তা নিয়ে খুব কমই আলোচনা হয়।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা চালানোর সময় তাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানো হয় ফেসবুকে। অ্যাসোসিয়েট প্রেসের এক রিপোর্টে বলা হয়, এ ধরনের বিদ্বেষমূলক ভিডিও বিজ্ঞাপন হিসেবে প্রচারের অনুমতি সে সময় দিয়েছিল ফেসবুক। মোট আটটি বিজ্ঞাপন অর্থের বিনিময়ে প্রচারের অনুমোদন দেয় ফেসবুক। প্রতিটিতে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য দিয়ে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা হয়।
গ্লোবাল উইটনেস’ নামের একটি গ্রুপ ফেসবুককে এই বিজ্ঞাপনগুলো দেয়। তবে প্রচারের আগে বা অর্থ পরিশোধের আগেই সেগুলো সরিয়ে নেয় গ্রুপটি। সেই আটটি বিজ্ঞাপন প্রচার না হলেও অভিযোগ উঠেছে, বিজ্ঞাপনে কী যাচ্ছে তা নজরে রাখতে একেবারে ব্যর্থ হয়েছে ফেসবুক।
গ্লোবাল উইটনেসের ছড়ানো আটটি বিজ্ঞাপন শনাক্ত করা হয় ইনডিপেনডেন্ট ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনে। বিজ্ঞাপন বিষয়ক এই রিপোর্ট জমা দেওয়া হয় জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলে।
এপি’র সাথে বিশেষভাবে শেয়ার করা প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, অধিকার গোষ্ঠী গ্লোবাল উইটনেস ফেসবুকে অনুমোদনের জন্য ৮টি পেইড বিজ্ঞাপন জমা দিয়েছে যার প্রতিটিতেই রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক বক্তব্যের বিভিন্ন সংস্করণ রয়েছে। ফেসবুক ৮টি বিজ্ঞাপনই প্রকাশের অনুমোদন দিয়েছে।
সংস্থাটি বিজ্ঞাপনগুলো পোস্ট করার আগে বা অর্থ প্রদান করার আগে সরিয়ে নিয়েছিল কিন্তু আরও ভালো করার প্রতিশ্রুতি দিলেও ফেসবুকের শিথিল নিয়ন্ত্রণের কারণে তারা এখনো ঘৃণামূলক বক্তব্য এবং ফেসবুক প্লাটফর্মে সহিংসতার আহ্বান সনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়।
২০১৭ সালে একটি রোহিঙ্গা বিদ্রোহী গোষ্ঠীর হামলার পর সেনাবাহিনী পশ্চিম মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে একটি নির্মূল অভিযান চালায়। ৭ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে যায় এবং নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে গণধর্ষণ,হত্যা ও হাজার হাজার বাড়িতে অগ্নিসংযোগের অভিযোগ আনা হয়।
গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারি কর্মকর্তাদের জেলে বন্দি করে জোরপূর্বক দেশটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা সেনাদখলের নিন্দা জানিয়ে বলে, এর ফলে মিয়ানমারে ফিরে যেতে তারা আরও ভয় পাচ্ছে।
অভিযোগ উঠেছে, বিজ্ঞাপনে কী যাচ্ছে তা নজরে রাখতে একেবারে ব্যর্থ হয়েছে ফেসবুক।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফেসবুক আরও ভালো করার প্রতিশ্রুতি এবং গণহত্যায় এ ধরণের বিজ্ঞাপনের ভূমিকাকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করার আশ্বাস দিলেও এগুলো ক্রমাগত প্রদর্শিত হচ্ছে। রোহিঙ্গা মুসলিমদের হত্যার আহ্বান জানিয়ে বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্যে ভরা এই বিজ্ঞাপনগুলো যেন ফেসবুকের সাইটে না থাকে- এমন সহজতম পদক্ষেপ নিতে ফেসবুক এখনো ব্যর্থ ।
২০১৮ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার এক তদন্তের তথ্যানুযায়ী, মিয়ানমারে ঘৃণামূলক বক্তব্য ও অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরিতে ফেসবুক মূল ভূমিকা পালন করছে। একই সময়ে রয়টার্সের এক তদন্তে দেখা যায়, এক হাজারের বেশি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে রোহিঙ্গা ও মুসলিমদের বিকৃত ভাষায় কটাক্ষ করা হয়। এমনকি তাদের গুলি করে হত্যার অনুরোধও করা হয়। ফেসবুক জানায়, সে সময় তাদের ভুয়া তথ্য এবং ঘৃণা ছড়ানো বক্তব্য ও কনটেন্ট প্রতিরোধ ব্যবস্থা অনেকটা ধীরগতিতে চলছিল।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০১৪ সালে মিয়ানমারের ৫ কোটি ৩০ লাখ জনসংখ্যার মাত্র এক শতাংশ মানুষের কাছে ইন্টারনেট ছিল। কিন্তু মাত্র দু’বছরের ব্যবধানে ২০১৬ সালে মিয়ানমারে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ৪০ লাখ।
রোহিঙ্গা গণহত্যায় ফেসবুকের ভূমিকা সুপ্রতিষ্ঠিত। ২০১৮ সালে ফেসবুকের নিয়োগকৃত একটি কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা উসকে দিতে এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা হয়েছে। ওই বছরের আগস্টে ফেসবুক মিয়ানমারে ২০ টি সংগঠন ও ব্যক্তিকে নিষিদ্ধ করে। এদের মধ্যে একজন সামরিক কমান্ডারও রয়েছেন।
২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাবিরোধী সামরিক অভিযানের শুরু করে দেশটির সেনাবাহিনী। সেই অভিযানে রোহিঙ্গাদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, ব্যাপকমাত্রায় গণহত্যার শিকার হয় রোহিঙ্গারা। বহু রোহিঙ্গা নারীকে ধর্ষণ করে মিয়ানমারের সেনাসদস্যরা। সেনাবাহিনীর নির্যাতন থেকে বাঁচতে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন।
ফেসবুকের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়।
প্রথমটি হলো, ২০১০ সাল থেকে ফেসবুক সক্রিয় ও কার্যকরভাবে তাদের নেটওয়ার্কের সেই সব বিষয়বস্তু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে, যা মিয়ানমারে গণহত্যার উসকানিতে অবদান রাখছিল। যদিও এসব বিষয় সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল ফেসবুক।
দ্বিতীয়টি হলো, ফেসবুকের অ্যালগরিদম এসব উসকানিমূলক বিষয়বস্তু ছড়ানোর ক্ষেত্রকে আরও প্রসারিত করেছিল।
তবে বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে এমন কোনো মামলায় বিচারের নজির এখন পর্যন্ত নেই।
অবশ্য এ ঘটনার সঙ্গে একটি দূরবর্তী সাদৃশ্য রয়েছে রেডিও মিলে কলিন্সের। এটি রুয়ান্ডার একটি রেডিও স্টেশন। ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডায় সংঘটিত গণহত্যায় উসকানিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে রেডিও স্টেশনটি। প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ এই গণহত্যার শিকার হয়, যাদের বেশির ভাগই ছিল সংখ্যালঘু টাট্সি জনগোষ্ঠীর। তখন রেডিও স্টেশনটি পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত কতিপয় ব্যক্তি পরে গণহত্যায় প্ররোচনার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন।
এখানে ফেসবুকের সঙ্গে রেডিও মিলে কলিন্সের ভূমিকার পার্থক্যটা মূল উদ্দেশ্যে। রেডিও মিলে কলিন্সের প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল গণহত্যায় উসকানি দেওয়া। যারা ওই গণহত্যার আহ্বান জানিয়েছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন আন্তর্জাতিক আদালত। কিন্তু রেডিও সরঞ্জাম নির্মাতাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
বর্তমান মামলায় যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে যে ফেসবুক একই সঙ্গে উৎপাদক ও কিছু ক্ষেত্রে বার্তাবাহকের কাজ করেছে।
কেননা মানুষ কী দেখবে আর কী দেখবেন না, তা ফেসবুকের অ্যালগিরদমই ঠিক করে দেয়।
ফেসবুকের অ্যালগরিদম যা করে, তার জন্য কোম্পানিটি দায়ী কি না বা কীভাবে দায়ী, এখন সেটাই দেখার বিষয়।
ফেসবুক বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম। প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী মাসে তাদের দুইশ সত্তর কোটি নিয়মিত ব্যবহারকারী রয়েছে। লাখ লাখ মানুষ এই প্রতিষ্ঠানে হোয়াটসঅ্যাপ এবং ইন্সটাগ্রামের মতো পণ্যও ব্যবহার করে।
কিন্তু ব্যবহারকারীদের গোপনীয়তা রক্ষা করতে ব্যর্থতা থেকে শুরু করে ভুয়া তথ্য ছড়ানো বন্ধে যথেষ্ট ব্যবস্থা না নেয়ার অভিযোগ রয়েছে ফেসবুকের বিরুদ্ধে।
সম্প্রতি সময়ে একের পর এক অভিযোগে বিদ্ধ হচ্ছে ফেসবুক। আর প্রতিটি অভিযোগের মাত্রাই ছাড়িয়ে যাচ্ছে আগেরটা। এর মধ্যেই প্রায় ৭ ঘণ্টা বন্ধ থাকার জেরে ব্যাপক লোকসানের সম্মুখীন হতে হয়েছে ফেসবুককে।
সম্প্রতি ফেসবুকের ‘হুইসেল ব্লোয়ার’ ফ্রান্সেস হাউগেন মার্কিন সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে অভ্যন্তরীণ একটি রিপোর্ট পেশ করেন। আর এতেই অভিযোগের লাইন লেগে গেছে।
অনেক অভিযোগের মধ্যে হাউগেনের জমা দেওয়া নথিতে উল্লেখ আছে, ফেসবুক কীভাবে আরএসএস গোষ্ঠী পরিচালিত অ্যাকাউন্টগুলোর পোস্ট প্রমোট করেছে।
হাউগেন বলেন, আরএসএস গোষ্ঠীর ফেসবুক অ্যাকাউন্টগুলো মুসলিম-বিদ্বেষী কনটেন্টের প্রচারণা চালায়। হিন্দুপন্থী জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে এ প্রচারণা চালায় তারা।
সূত্র মতে, মুসলমানদের ‘শুকর’ এবং ‘কুকুর’-এর সাথে তুলনা করে অসংখ্য অমানবিক পোস্ট করা হয়েছে এসব অ্যাকাউন্ট থেকে। হয়েছে কোরআন অবমাননা করা পোস্টও। কিন্তু এসব মুসলিম-বিদ্বেষী কনটেন্ট ফেসবুক মডারেট করেনি বলে অভিযোগ হাউগেনের। তার দাবি, ভারতে বাংলা ভাষার কনটেন্টগুলো পর্যবেক্ষণ করার জন্য বাঙালি মডারেটরের ঘাটতি ছিল।
হাউগেন আরও দাবি করেছেন, বিদ্বেষ ছড়ানো কনটেন্টের মাত্র ০.২ শতাংশ পোস্ট সরানো হয় ফেসবুকের অটোমেটেড সিস্টেমের দ্বারা। মুসলিমবিরোধী পোস্টকে প্রায় কখনও ‘ফ্ল্যাগ’ করা হয়নি ফেসবুকে। ফেসবুকের সিভিক ইন্টেগ্রিটি গ্রুপের প্রোডাক্ট ম্যানেজার ছিলেন ফ্রান্সেস হাউগেন। গত মে মাসে সংস্থাটির চাকরি ছাড়েন তিনি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৫২
আপনার মতামত জানানঃ