করোনায় মৃত্যু হচ্ছে। আবার করোনার প্রভাবে অন্য রোগেও মৃত্যু বেড়েছে। কোভিড-১৯ মহামারিতে বাংলাদেশে প্রায় ৪ লাখ ৪২ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এমনটাই বলছে স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রখ্যাত জার্নাল ল্যানসেটে প্রকাশিত এক গবেষণা।
বাংলাদেশে সরকারি হিসাব অনুযায়ী করোনায় মারা গেছে ২৯ হাজার ১০৫ জন। কিন্তু গবেষণা অনুযায়ী মৃত্যুর আসল সংখ্যা এর ১৫ গুণ। মহামারির দুই বছরে সরকারি হিসেবের থেকেও অতিরিক্ত ৪ লাখ ১৩ হাজার লোকের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে গবেষকরা।
বৃহস্পতিবার ওই গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে ল্যানসেট। এতে অবশ্য জানানো হয়েছে, শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই কোভিডে মৃত্যুর ভুল হিসাব প্রচার করা হয়েছে। বিশ্বের সরকারগুলো যে তথ্য দিয়েছে তাতে এই মহামারিতে বিশ্বজুড়ে ৫৯ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। তবে গবেষকরা বলছেন, প্রকৃতপক্ষে এ মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর হেলথ ম্যাট্রিক্স অ্যান্ড ইভাল্যুয়েশনের নেতৃত্বে একদল গবেষক মহামারিকালে বৈশ্বিক মৃত্যু পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেছেন। তারা বলছেন, করোনায় আক্রান্ত হয়ে যে মৃত্যুর তথ্য পাওয়া যায়, বাস্তবে মহামারির প্রভাবে মৃত্যু তার চেয়ে অনেক বেশি।
গবেষকেরা বলছেন, ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা বিশ্বে ৫৯ লাখ ৪০ হাজার মানুষের করোনায় মৃত্যু হয়। এ সময় করোনার কারণে সারা বিশ্বে ১ কোটি ২৩ লাখ মানুষের বাড়তি মৃত্যু হয়েছে। ল্যানসেট ১০ মার্চ গবেষকদের এই বিশ্লেষণ প্রবন্ধ আকারে প্রকাশ করেছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, করোনায় সারাবিশ্বে মৃত্যু হয়েছে হিসাবের চেয়ে তিন গুণ। অর্থাৎ গত দুই বছরে ১ কোটি ৮২ লাখের বেশি মানুষ করোনাভাইরাসে সরাসরি বা সংক্রমিত হয়ে মারা গেছে।
ল্যানসেটের প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে প্রতি এক লাখ জনসংখ্যার বিপরীতে কোভিডে ৯.২ জন মারা গেছে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে এই হার প্রতি এক লাখে ১৩৪.৭ জন।
গবেষণায় দেখা যায়, করোনায় সাতটি দেশে বিশ্বের মোট মৃত্যুর অর্ধেক ঘটেছে। এগুলো হলো ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, মেক্সিকো, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তান। ভারতের ক্ষেত্রে দেখা গেছে সরকারি পরিসংখ্যান বলছে দেশটিতে ৪ লাখ ৯০ হাজার মানুষ কোভিডে মারা গেছেন। কিন্তু ল্যানসেটের গবেষণা বলছে দেশটিতে কোভিডে মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা ৪১ লাখের বেশি। করোনায় বিশ্বে যত মানুষ মারা গেছে, তার ২২ শতাংশই ঘটেছে ভারতে।
বিবিসি জানিয়েছে, স্বাভাবিক অবস্থার তুলনায় মহামারির বছরগুলোতে কী পরিমাণ বেশি মৃত্যু হয়েছে তার তুলনা করেই এ সিদ্ধান্তে এসেছেন গবেষকরা। এ জন্য তারা বিভিন্ন সরকারি ওয়েবসাইট থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। এরমধ্যে আছে, ওয়ার্ল্ড মর্টালিটি ডাটাবেজ, দ্য হিউম্যান মর্টালিটি ডাটাবেজ এবং দ্য ইউরোপিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল অফিস। এই অতিরিক্ত মৃত্যুর সংখ্যা দেশ ও অঞ্চলভেদে আলাদা বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। তবে বৈশ্বিক হিসেবে এই সংখ্যা ছিল প্রতি এক লাখ জনে ১২০ মৃত্যু। অর্থাৎ, স্বাভাবিক অবস্থার তুলনায় প্রতি লাখে ১২০ জন মানুষের বেশি মৃত্যু হয়েছে মহামারি কালে। সামগ্রিক হিসেবে গত দুই বছরে মোট ১ কোটি ৮২ লাখ মানুষ অতিরিক্ত প্রাণ হারিয়েছে।
বাংলাদেশে সরকারি হিসাব অনুযায়ী করোনায় মারা গেছে ২৯ হাজার ১০৫ জন। কিন্তু গবেষণা অনুযায়ী মৃত্যুর আসল সংখ্যা এর ১৫ গুণ। মহামারির দুই বছরে সরকারি হিসেবের থেকেও অতিরিক্ত ৪ লাখ ১৩ হাজার লোকের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে গবেষকরা।
যেসব দেশে সবথেকে বেশি অতিরিক্ত মৃত্যু দেখেছেন গবেষকরা তা হলো, বলিভিয়া, বুলগেরিয়া, এস্বাতিনি, উত্তর মেসিডোনিয়া ও লেসোথো। অপরদিকে সবথেকে কম পাওয়া গেছে আইসল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, নিউজিল্যান্ড ও তাইওয়ানে। বৃটেন ও যুক্তরাষ্ট্রে কোভিডে মৃত্যুর সংখ্যা সরকারি হিসাবের কাছাকাছিই রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি হিসাবে ৯ লাখ ৬০ হাজার মৃত্যুর কথা বলা হলেও প্রকৃত মৃত্যু ১১ লাখ ৩০ হাজারের কাছাকাছি। বৃটেনে এ সময়ে ১ লাখ ৭৩ হাজার মানুষ করোনা সংক্রমণে মারা গেছে। দেশটিতে প্রতি ১ লাখে ১৩০ জন এ রোগে মারা গেছেন।
৭৪টি দেশ ও অঞ্চল এবং বিভিন্ন দেশের ২৬৬টি প্রদেশে করোনাকালের এবং তার আগের ১১ বছরের মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণ করেছেন গবেষকেরা। বিভিন্ন রোগব্যাধি ও জখমে বিশ্বে মৃত্যুর যে প্রবণতা ছিল, মহামারি শুরুর পর তাতে কী পরিবর্তন এসেছে, তা গবেষকেরা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। এই বিশ্লেষণে তারা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য গাণিতিক মডেল ব্যবহার করেছেন।
গবেষকেরা বলছেন, জনস্বাস্থ্যের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য মহামারিতে মৃত্যুর প্রকৃত প্রভাব অনুধাবন করা দরকার। কিন্তু অনেক দেশের সঠিক জন্মনিবন্ধন হয় না। অধিকাংশ দেশ মৃত্যুর নিবন্ধনও ঠিকভাবে করে না। এসব সমস্যা ছাড়াও কিছু সীমাবদ্ধতার কথা গবেষকেরা স্বীকার করেছেন। অনেক দেশে সব মৃত্যুর পেছনের কারণের উপাত্ত নেই।
করোনা সংক্রমণের শুরু থেকে দেশে রোগ শনাক্ত, মানুষকে করোনাবিষয়ক তথ্য দেওয়াসহ মহামারি পরিস্থিতি বিশ্লেষণের কাজে যুক্ত আছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরীন জাতীয় এক দৈনিককে বলেন, করোনাকালে মানুষ সেবাকেন্দ্রে যেতে পারেনি, অনেকে সেবা নেওয়া থেকে দূরে থেকেছে। এ ধরনের বেশ কিছু কারণে মৃত্যু বেড়েছে। তবে এর সঠিক সংখ্যা এখন বলা সম্ভব না।
গবেষকেরা বলছেন, লকডাউন এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও বিশৃঙ্খলা মৃত্যুর কারণে পরিবর্তন এনে থাকতে পারে। স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বেশ কিছু রোগে মৃত্যু বেড়েছে, সুস্থতাও বিলম্বিত হয়েছে। এ সময়ে টিকাদানব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং বাড়িতে সন্তান প্রসব বেড়েছে। এ সময় মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ও বিষণ্নতা বেড়ে যাওয়ায় আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। মহামারির শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বেড়েছিল। অনেক স্থানে হৃদ্রোগ ও দীর্ঘস্থায়ী ফুসফুসের রোগ বেড়েছে। এসবই অতিরিক্ত মৃত্যুর কারণ।
বাংলাদেশ জনবহুল দেশ। দেশের স্বাস্থ্য অবকাঠামো ও জনবল মহামারি মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী নয়, প্রস্তুতিরও ঘাটতি ছিল। মহামারির শুরুর দিকে কেউ কেউ ধারণা করেছিলেন, মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে অনেক মানুষ মারা যাবে। কিন্তু পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে ততটা খারাপ হয়নি।
অনেকে মনে করেন, সরকার মৃত্যুর যে সংখ্যা প্রকাশ করে করোনায় মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা তার চেয়ে বেশি। করোনার উপসর্গ নিয়ে অনেকের মৃত্যু হয়েছে, তবে মৃত্যুর আগে পরীক্ষা হয়নি বলে সেটা করোনায় মৃত্যু হিসেবে সরকারি খাতায় ওঠে না। বাড়তি কত মৃত্যু হয়েছে, তা নিয়ে একাধিক গবেষণার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে সেসব গবেষণার ফলাফল এখনো প্রকাশ করা হয়নি।
জনসংখ্যা নিয়ে কাজ করেন এমন একজন গবেষক ওই দৈনিককে বলেছেন, ল্যানসেট বাড়তি মৃত্যুর যে অনুমিত সংখ্যা বলেছে প্রকৃত সংখ্যাটি হয়তো তার কাছাকাছি হবে। মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করেন এমন একজন গবেষক বলেছেন, বাড়তি মৃত্যু হয়েছে ২০ শতাংশের মতো। সেই হিসাবে বাড়তি মৃত্যুর অনুমিত সংখ্যা হবে সাড়ে তিন লাখের কাছাকাছি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৪৪
আপনার মতামত জানানঃ