হত্যা মামলার আসামিকে একদিনের পুলিশ রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। জেলা কারাগার থেকে প্রাইভেটকারে থানায় আনা হলো তাকে। শত শত লোকের ভিড় সেখানে। থানা চত্বরে হ্যান্ড মাইকে বক্তব্য রাখলেন রিমান্ড মঞ্জুর হওয়া ওই ব্যক্তি; বললেন- আমি নির্দোষ।
ওই ব্যক্তি ঝিনাইদহ জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক এবং শৈলকুপা উপজেলার বগুড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম। হত্যা মামলার আসামি তিনি। আদালত তাকে এক দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আদেশ দিয়েছেন। এ কারণে তাকে গত মঙ্গলবার(৮ মার্চ) থানায় আনা হয়।
হ্যান্ডমাইকে আসামির কথা বলার বিষয়ে পুলিশ বলে, শিমুলকে থানায় আনা হচ্ছে, এ খবরে থানার সামনে কর্মী-সমর্থকেরা জড়ো হন। তাদের সরাতেই আসামিকে দিয়ে কর্মীদের বাড়ি ফেরার আহ্বান জানানো হয়।
মামলার বাদী মিল্টন খন্দকার অভিযোগ করেন, আসামিকে ‘জামাই আদরে’ আদালত থেকে একটি ব্যক্তিগত গাড়িতে করে থানায় আনা হয়। তার ছিল না কোনো হাতকড়া। পুলিশ তাদের হ্যান্ডমাইক আসামির হাতে তুলে দিয়ে যেভাবে বক্তৃতা দেওয়ালো, তাতে তিনি হত্যার বিচার পাবেন কি না, তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন। তিনি আসামির সঙ্গে পুলিশের এমন আচরণের তদন্তপূর্বক বিচার দাবি করেন।
মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে ঝিনাইদহের শৈলকূপা থানায় ঘটেছে ঘটনাটি। এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। ঘটনাটির ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
এদিকে পুলিশের পক্ষ থেকে ঘটনাটি নিয়ে ভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। শৈলকূপা সার্কেলের এএসপি অমিত বর্মন বলেছে, ৫ জন আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য জেলা কারাগার থেকে থানার আনার পরে সেখানে কয়েক শত জনতা জড়ো হন। এ সময় ওই আসামিদের মধ্য থেকে নব নির্বাচিত ১০নং বগুড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম শিমুল পরিস্থিতি শান্ত রাখার জন্য কথা বলেছেন।
পুলিশের এ কর্মকর্তা আরও বলেছেন, পরিস্থিতি বিবেচনায় এমনটি হয়েছে। ঘটনার জন্য পুলিশের দায়িত্ব অবহেলার কিছুই ঘটেনি বলে দাবি করেন শৈলকূপা সার্কেলের এএসপি।
কর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানান শিমুল এবং হ্যান্ডমাইকে বক্তব্য রাখার সময় নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন।
শৈলকূপা থানার ওসি মো. আমিনুল ইসলাম বুধবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে জাতীয় এক দৈনিককে বলেন, দুপুরের দিকে এক দিনের পুলিশ রিমান্ড শেষে আদালতের মাধ্যমে ইউপি চেয়ারম্যান শিমুলসহ ৫ আসামিকে জেলা কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
রিমান্ডের আসামি কীভাবে থানা চত্বরে হ্যান্ড মাইকে বক্তব্য দিলেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কাকতালীয়ভাবে ঘটনাটি ঘটেছে।
তিনি আরও বলেন, এলাকার শত শত মানুষ থানার গেটে আগে থেকেই ভিড় করে ছিল। তাদের শান্ত করতে শফিকুল ইসলাম শিমুল আইনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে জড়ো হওয়া নেতাকর্মী সমর্থকদের উদ্দেশ্যে কথা বলেছেন। এর জন্য পুলিশ তাকে উৎসাহিত করেনি বলে দাবি করেন ওসি।
সে সময় ওই আসামির (শিমুল) হাতে হ্যান্ডকাপ ছিল না বলে পরোক্ষভাবে স্বীকার করেছেন তিনি।
পঞ্চম ধাপে অনুষ্ঠিত ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার বগুড়া ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন বেশ কয়েকজন। তাদের একজন শফিকুল ইসলাম। তিনি দলীয় মনোনয়ন পেয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। তবে নির্বাচনের পর থেকেই স্থানীয় আওয়ামী লীগে নানা রকম বিরোধ দেখা দেয়। যার জেরে গত ৮ জানুয়ারি প্রকাশ্যে হাতুড়িপেটা ও কুপিয়ে হত্যা করা হয় কল্লোল খন্দকার নামের এক যুবককে। তিনি বগুড়া গ্রামের মৃত আকবর খন্দকারের ছেলে।
এ ঘটনায় নিহত ব্যক্তির ছোট ভাই মিল্টন খন্দকার ১২ জানুয়ারি ৮২ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় চেয়ারম্যান শফিকুলকে আসামি করা হয়।
মামলা দায়েরের পর বাদী একাধিকবার অভিযোগ করেন, আসামি গ্রেপ্তারে পুলিশের তৎপরতা নেই। বাদী তার পরিবারের নিরাপত্তাহীনতার কথা জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন।
পুলিশ অবশ্য আফান আলী ও সজীব হোসেন নামের দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করে। আসামি শফিকুল ইসলাম, নাসির বিশ্বাস, ফরিদ মুন্সি, আতিয়ার মিয়া ও আখির মুন্সি ২ মার্চ আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। পুলিশ তাদের পাঁচ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে আবেদন করলে আদালত এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। আসামি শফিকুলসহ অন্যদের মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আদালত থেকে পুলিশি পাহারায় শৈলকুপা থানায় নিয়ে আসা হয়।
সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা গেছে, রিমান্ডের আসামিরা মাইক্রোবাসসহ ৩টি প্রাইভেট কারে শৈলকূপা থানাতে ঢুকছেন। এ সময় শৈলকূপা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মহসীন হোসেনসহ অন্যান্যরা চলাফেরা করছেন।
অভিযোগ উঠেছে এক পর্যায়ে পরিদর্শক (তদন্ত) মহসীন হোসেন তার হ্যান্ডমাইক তুলে দেন রিমান্ডের আসামি চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম শিমুলের হাতে। কর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানান শিমুল এবং হ্যান্ডমাইকে বক্তব্য রাখার সময় নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন।
রিমান্ডের আসামিদের নিয়ে এমন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে হতাশা প্রকাশ করেছেন নিহত কল্লোল খন্দকারের ছোট ভাই (হত্যা মামলার বাদী) মিল্টন খন্দকার। তিনি অভিযোগ করেন, এমন ঘটনায় আমরা ন্যায় বিচার পাবো বলে মনে করছি না। কল্লোল খন্দকার খুন হওয়ার পর থেকে পরিবারের সদস্যসহ তিনিও বাড়ি ছাড়া বলে জানান মিল্টন।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, এদেশে প্রভাভশালীদের মামলা মোকদ্দমা বিষয়ে পূর্ব থেকে ধারণা করার অধিকাংশই সত্যে পরিণত হয়। কেননা এদেশে ক্ষমতাশালী ও প্রভাবশালীদের শাস্তি দেওয়ার তেমন একটা রেওয়াজ গড়ে ওঠেনি। অন্যায় অপরাধ করেও তারা যেকোনোভাবে পার পেয়ে যেতে পারেন। তারা মনে করেন, আমাদের রাষ্ট্রে বিচারের এই বৈষম্য দূর না হলে দেশ থেকে অন্যায় অপকর্মও হ্রাস পাবে না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১২৫৫
আপনার মতামত জানানঃ