সংবিধানমতে, শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ তথা কর্মসূচি পালন করার অধিকার প্রতিটি দল ও সংগঠনের আছে। অথচ আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি হলো যখন যারা ক্ষমতায় থাকে, তখন তারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে থাকে কথিত আইনশৃঙ্খলার দোহাই দিয়ে।
আওয়ামী লীগের নেতারা এত দিন অভিযোগ করতেন যে বিএনপি জনজীবনের সমস্যা নিয়ে কথা বলে না, তারা আন্দোলন করে কেবল দলীয় প্রধানের মুক্তির দাবিতে। অথচ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠন যখন কর্মসূচি নিল, তখন হামলা, মামলা ও গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটল।
আবার চলতি মাসের শুরুতে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে ব্রিফিংকালে এদেশে বিএনপির রাজনীতি করার আর অধিকার নেই বলে মন্তব্য করেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ। এই কথার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে সর্বত্র।
গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত সবার সমানাধিকার। কিন্তু আমরা কী দেখছি? বিরোধী দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাতে গিয়ে বারবারই প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। গণতন্ত্রের জন্য তা মোটেও কল্যাণকর নয়।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনগুলো ১১ দিনব্যাপী কর্মসূচি পালন করছে, যা গত ২৬ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়েছে এবং ১৪ মার্চ শেষ হওয়ার কথা। তাদের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে রাজধানী ঢাকার পাশাপাশি সব বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা সদরে বিক্ষোভ সমাবেশ।
কিন্তু অনেক স্থানে বিএনপির কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হতে পারেনি পুলিশের বাধার কারণে। অন্যদিকে অনেক স্থানে ক্ষমতাসীন দলের একশ্রেণির নেতা-কর্মী বিএনপির সমাবেশে হামলা চালিয়েছেন। কোথাও কোথাও তাদের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ হয়েছে।
পত্রিকার খবর অনুযায়ী, পটুয়াখালী সদর, দুমকি, পিরোজপুর, নাটোর, ঝিনাইদহ, লালমনিরহাট, নোয়াখালী, শরীয়তপুর, বগুড়া, মৌলভীবাজার, চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রভৃতি জেলায় হামলার ঘটনায় বহু নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন। আমরা বিএনপির কর্মসূচি ভন্ডুলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চণ্ডনীতি ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের হামলার নিন্দা জানাই।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব বিরোধী দলের সভা-সমাবেশ ভেঙে দেওয়া নয়; কোথাও কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে যাতে বিশৃঙ্খলা না ঘটে, তা দেখা। আমরা আরও লক্ষ করেছি যেসব স্থানে বিএনপির নেতা-কর্মীদের শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন করতে দেওয়া হয়েছে, সেসব স্থানে কোনো সমস্যা হয়নি। কর্মসূচি পালনের পর নেতা-কর্মীরা ঘরে ফিরে গেছেন।
যেসব স্থানে পুলিশ বাধা দিয়েছে, ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা হামলা চালিয়েছেন, সেখানেই অঘটন ঘটেছে। জনজীবনের সমস্যা নিয়ে ক্ষমতাসীন দল ও এর সহযোগীদের কর্মসূচি নিতে দেখা যায় না। কিন্তু বিরোধী দল কোনো কর্মসূচি নিলে তাঁরা বাধা দেওয়াকে তাঁদের ‘নৈতিক দায়িত্ব’ বলে মনে করেন।
বিএনপির এ কর্মসূচি আগেই সংবাদ সম্মেলনে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তারপরও ছাত্রলীগ বা যুবলীগের একই দিন কর্মসূচি ঘোষণা দেওয়া পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া বাধানোর শামিল। এখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা কেবল প্রশ্নবিদ্ধ নয়, লজ্জাজনকভাবে পক্ষপাতমূলক। তারা আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ওপর চড়াও হয়েছে।
ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে যে বিভিন্ন স্থানে তাদের কর্মসূচি ছিল। কর্মসূচি পালনের অধিকার নিশ্চয়ই সবার আছে। তাই বলে বিরোধী দল রাজপথে কোনো কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের পক্ষ থেকে একই স্থানে, একই সময়ে কর্মসূচি ঘোষণা বা পালনের চেষ্টা করা উসকানি ছাড়া কিছু নয়। এর মাধ্যমে তারা নিজেদের গণবিরোধী অবস্থান আরও পরিষ্কার করল।
অথচ বিভিন্ন দল রাজনৈতিক কর্মসূচি দেবে, সুস্থ ধারার রাজনীতি চর্চা করবে- এটিই তো প্রত্যাশিত। কিন্তু আমরা যখন দেখি রাজনীতির নামে অপরাজনীতি কিংবা নানা রকম কদর্যতা সৃষ্টি হচ্ছে রাজনীতিকদেরই কারও কারও কারণে, তখন আশাহত না হয়ে পারি না। গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা প্রায় সর্বজনীন। গণতন্ত্র শুধু নির্দিষ্ট সময়ান্তে নির্বাচনের ব্যাপার নয়, গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতির ব্যাপার। প্রশ্ন হচ্ছে- রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক করবে কে এবং কীভাবে, সমাজে যদি গণতান্ত্রিক চেতনা ও মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা না ঘটে? প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য রাষ্ট্রের ওপর সমগ্র সমাজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন।
জনগণ ও গণতন্ত্রের প্রতি ন্যূনতম দায়বদ্ধতা ও শ্রদ্ধাবোধ থাকলে কোনো রাজনৈতিক দল বা তাদের সহযোগী সংগঠন এ ধরনের কাজ করতে পারে না। ভবিষ্যতে কোনো রাজনৈতিক দলের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধা দেওয়া হবে না, সেই নিশ্চয়তা দিতে হবে সরকারকেই।
এসডব্লিউ/এসএস/২০০০
আপনার মতামত জানানঃ