নব্বই দশকের শেষ দিকে দেশে মাদক হিসেবে ইয়াবা সেবন চললেও ২০০২ সালের দিকে তা ধরা পড়ে। যদিও শুরুর দিকে এ নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না প্রশাসনের। সেই ইয়াবাই এখন মাথাব্যথার বড় কারণ। পুলিশ, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সবাই একমত যে দেশটিতে এ মুহূর্তে যে মাদকটি ব্যবহারের শীর্ষে আছে তা হল – ইয়াবা। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসেবে, ২০০৮ সালে যে পরিমাণ ইয়াবা ব্যবহার হতো ২০১৬ সালে এর ব্যবহার বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছিল। বর্তমানে এই মাদকটি নেতৃত্ব দিচ্ছে। এর বাইরে হেরোইন, গাঁজা ও ফেনসিডিল বহুকাল ধরেই এদেশে অনেক মাদকসেবী ব্যবহার করেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে নতুন যে মাদকের নাম শোনা যাচ্ছে তা হলো- ক্রিস্টাল মেথ বা আইস।
তথ্যপ্রযুক্তি ও আধুনিকায়নের নেতিবাচক প্রভাব, পারিবারিক-সামাজিক চাপসহ নানান কারণে তরুণদের মধ্যে হতাশা-বিষণ্নতা ভর করছে। এর জেরে ঘটছে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, যার চূড়ান্ত পরিণতিতে মাদকাসক্তিতেও ঝুঁকছেন অনেক তরুণ-তরুণী। দিন দিন এমন অবসাদগ্রস্ত তরুণ-তরুণীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় বাড়ছে মাদকের চাহিদা। সেই চাহিদার জোগান দিতে বাড়ছে চোরাচালানও। এই চাহিদার প্রয়োজন মেটাতেই মাদকের ধরনও পাল্টাচ্ছে বছর বছর।
একসময় দেশের মাদকের বাজারে গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইন, ইয়াবার আধিপত্য থাকলেও সম্প্রতি বিস্তার ঘটছে আলোচিত ক্ষতিকর মাদক আইস (মেথামফেটামিন) বা ক্রিস্টাল মেথের। বিভিন্ন সংস্থা ও অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, বছরে দেশে আসছে শত কোটি টাকার আইস বা ক্রিস্টাল মেথ। এর মধ্যে ধরা পড়ছে অর্ধশত কোটি টাকার আইস।
ইয়াবার পর এবার বাংলাদেশে ভয়াবহ মাদক ‘আইস’ পাঠাচ্ছে মিয়ানমারের চক্র। টাকা ছাড়া বাকিতেই গভীর সমুদ্রে আইস তুলে দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশি চক্রের হাতে।
আইস বিক্রির পর হুন্ডির মাধ্যমে বা হাতে হাতে টাকা চলে যাচ্ছে মিয়ানমারে।
বুধবার রাতে গোয়েন্দা শাখার সহায়তায় মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া থেকে প্রায় ৫০ কোটি টাকা মূল্যের ১২ কেজি আইসসহ ৫ জনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব-১৫। এটাই এযাবত জব্দ হওয়া আইসের সবচেয়ে বড় চালান।
গ্রেপ্তাররা হলেন—জসিম উদ্দিন ওরফে জসিম (৩২), মকসুদ মিয়া (২৯), মো রিয়াজ উদ্দিন (২৩), শাহিন আলম (২৮) ও মো সামছুল আলম (৩৫)।
এ সময় তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ আইস ছাড়াও ১ লাখ পিস ইয়াবা, ৪ হাজার ৬০০ পিস চেতনানাশক মাদক সিডাকটিভ ইনজেকশন, ২টি বিদেশি পিস্তল, ৯ রাউন্ড গোলাবারুদ, ২টি টর্চলাইট, ১ লাখ ৬৪ হাজার বাংলাদেশি টাকা, ১ লাখ বার্মিজ মুদ্রা ও ৫টি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়।
র্যাব জানায়, মিয়ানমার বাকিতেই দেশীয় মাদককারবারিদের আইস সরবরাহ করছে। আইসের চালান দেশে বিক্রি হওয়ার পর হুন্ডির মাধ্যমে বা হাতে হাতে মিয়ানমারে টাকা চলে যাচ্ছে।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখকে ফাঁকি দিয়ে সাগরপথ হয়ে নৌপথে ঢাকায় আইস নিয়ে আসছিল চক্রটি। পরে ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আইসের চালান পাঠানোর পরিকল্পনা করেছিল তারা।
বৃহস্পতিবার (৩ মার্চ) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
ইয়াবার পর এবার বাংলাদেশে ভয়াবহ মাদক ‘আইস’ পাঠাচ্ছে মিয়ানমারের চক্র। টাকা ছাড়া বাকিতেই গভীর সমুদ্রে আইস তুলে দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশি চক্রের হাতে।
খন্দকার আল মঈন বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তাররা জানায়, তারা মিয়ানমারের মাদক চক্রের যোগসাজশে দেশে অবৈধ আইস কারবারের সঙ্গে জড়িত। এই চক্রটি দেশে জসিমের নেতৃত্বে কার্যক্রম পরিচালনা করছিলেন। এই চক্রে ১২-১৫ জন সদস্য রয়েছেন। চক্রটি তাদের কার্যক্রম মূলত সোনাদিয়া থেকে পরিচালনা করতেন। তারা মিয়ানমার থেকে আইস ও ইয়াবা সংগ্রহ করে সোনাদিয়া হয়ে ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, বরিশালসহ বিভিন্ন এলাকায় নানা কৌশলে চালান দিতেন। চক্রটি মূলত নৌপথ ব্যবহার করে বিভিন্ন কৌশলে মিয়ানমার থেকে এই মাদক দেশে নিয়ে আসতেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য চক্রটি নৌপথকে বেছে নেয়।
আইস যেভাবে দেশে আসে
র্যাবের মুখপাত্র বলেন, চক্রের সদস্যরা মূলত মিয়ানমার থেকে দেশে আইস ও ইয়াবা সাগর পথে পাচার করতেন। সেন্টমার্টিন দ্বীপের দক্ষিণে গভীর সমুদ্রে ট্রলারের মাধ্যমে মিয়ানমারের মাদক চক্রের সদস্যরা এই চক্রের কাছে ইয়াবা ও আইসের চালান হস্তান্তর করতেন। সাগর পথে মাদকের চালান গ্রহণ ও নিরাপদ স্থলে পৌঁছানোর জন্য এ চক্রের সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে (২০/২৫ দিন) জেলেদের ছদ্মবেশ নিয়ে গভীর সমুদ্রে অবস্থান করতেন। মালামাল গ্রহণের পর সুবিধাজনক সময়ে তারা সোনাদিয়া দ্বীপে চলে আসতেন।
পরে ইয়াবা ও আইসের চালান সোনাদিয়া ও মহেশখালী দ্বীপের বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে রাখা হয়। সুবিধাজনক সময়ে চক্রটি সোনাদিয়া থেকে দুটি বোটের মাধ্যমে নোয়াখালীর হাতিয়াতে আইস ও ইয়াবার চালান নিয়ে আসতেন। হাতিয়া থেকে ইঞ্জিন চালিত নৌকায় মেঘনা নদী হয়ে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া/ঢাকার আশেপাশে অথবা সুবিধাজনক স্থানে আইস পৌঁছাত চক্রটি।
ঢাকা ছাড়াও বরিশাল, পটুয়াখালী ইত্যাদি অঞ্চলে মাদক সরবরাহ করতেন। মাদকের চালান মুন্সিগঞ্জে পৌঁছানোর পর রাজধানীর একটি চক্র আইস ও ইয়াবার চালান গ্রহণ করে এবং সড়কপথে বিভিন্ন মাধ্যমে কৌশলে মুন্সিগঞ্জ থেকে ঢাকায় নিয়ে আসতেন।
তিনি বলেন, চক্রটির নেতা জসিম দীর্ঘ ৫-৭ বছর ধরে মাদক চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। তিনি লবণ ব্যবসার আড়ালে আইসের কারবারে জড়িত। তিনি মূলত মিয়ানমারের মাদক সিন্ডিকেটের সঙ্গে সমন্বয় করতেন। জসিমের নেতৃত্বে চক্রটি প্রথমে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা নিয়ে আসতেন।
সম্প্রতি রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে আইসের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় গত বছর থেকে তারা মিয়ানমার থেকে আইস নিয়ে আসা শুরু করেন। এছাড়া জসিম রাজধানী থেকে কয়েকটি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চেতনানাশক মাদক সিডাকটিভ ইনজেকশন সংগ্রহ করে নৌপথে দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দিতেন।
মিয়ানমার থেকে আইস সংগ্রহ করার সময় দেশীয় মাদক কারবারিরা কীভাবে তাদের টাকা দেয় এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আইস বা মাদক নিয়ে আসার সময় মিয়ানমারের মাদক কারবারিদের দেশীয় কারবারিদের প্রাথমিকভাবে সব টাকা দিতে হয় না। নিয়ে আসা আইস বিক্রি হয়ে গেলে পরে হুন্ডি বা হাতে হাতে মিয়ানমারের মাদক কারবারিদের টাকা দেওয়া হয়।
মিয়ানমার বাকিতে মাদক দিচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সম্পূর্ণ অর্থের বিনিময়ে না, ২০-৩০ শতাংশ অর্থের মাধ্যমে তারা মাদক দিচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০ গ্রাম আইসের দাম দেশে ২৫-৩৫ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়। একই পরিমাণ আইস ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকায় দেশীয় ব্যবসায়ীরা মিয়ানমার থেকে কিনে নিয়ে আসে। সেই অর্থে ২০ শতাংশ খুব বেশি বড় অঙ্কের টাকা না।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের ধারণা ছিল যে ঢাকা থেকেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আইস পাঠানো হতো। কিন্তু আমরা এখন দেখেছি, হাতিয়া থেকে নৌপথ ব্যবহার করে মুন্সিগঞ্জ হয়ে ঢাকায় আইস আসছে। আবার হাতিয়া থেকে নৌপথে বরিশাল ও পটুয়াখালী পর্যন্ত আইস যাচ্ছে।
সীমান্তরক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কীভাবে ঢাকায় মাদক আসছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নানা কৌশলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা মাদক নিয়ে আসছে। বেশি লাভের আশা তারা জীবনের মায়া ত্যাগ করে নিয়ে আসছে। মাদকসেবীদের সংখ্যা না কমাতে পারলে কোনো না কোনোভাবে মাদক দেশে আসবে। এ ক্ষেত্রে নানা কৌশল নিয়ে মাদক নিয়ে আসবে। সমুদ্র পথে হাজার হাজার নৌকা মাছ ধরে। এর মধ্যে মাদক বহনকারী একটি নৌকাকে শনাক্ত করা কিছুটা কঠিন।
মাদকের বাজার ধ্বংস করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ বিভিন্ন সংস্থা তৎপর থাকলেও পাশের দেশ থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে উচ্চমূল্যের এই মাদক আসছেই। অবশ্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আইসসহ মাদক ঠেকাতে অভিযান আরও জোরদার করার কথা বলছেন।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রথম আইস বা ক্রিস্টাল মেথ ধরা পড়ে ২০১৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। রাজধানীর জিগাতলার একটি বাসায় তখন ৫ গ্রাম আইস জব্দ করা হয়। ওই চালানের পর সেই বছরের জুন মাসে রাজধানীর খিলক্ষেতে ধরা পড়ে ৫২২ গ্রাম আইস। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নানা তৎপরতায় ওই বছর এবং তার পরের বছর ২০২০ সালে আইস আসা কমে যায়। ২০১৯ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর মোট ৫৬১ গ্রাম আইস জব্দ করে। পরের বছর ২০২০ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন ও কোস্ট গার্ডসহ সব সংস্থা জব্দ করে দশমিক ০৬৫ গ্রাম আইস।
কিন্তু ২০২১ সালে উদ্বেগজনক আকারে আসে এ মাদক। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন ও কোস্ট গার্ডসহ বিভিন্ন সংস্থা গত বছর ৩৬ কেজি ৭৯৪ গ্রাম আইস জব্দ করে। প্রতি গ্রামের দাম ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা ধরে জব্দ আইসের মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৬০ থেকে ৭০ কোটি টাকা। এসব মাদক জব্দ করার সময় ৩৫ কারবারিকেও আটক করা। তাদের বিরুদ্ধে করা হয় ৩২টি মামলা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সাড়ে ৩৬ কেজির বেশি আইস জব্দ করলেও দেশে ঢুকেছে আরও বেশি। সবমিলিয়ে গত বছর অন্তত শত কোটি টাকার আইস ঢুকেছে দেশে।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের তথ্য মতে, এ বছরের শুধু জানুয়ারি মাসেই সংস্থাটি ২১ কেজি ২৩৯ গ্রাম আইস ধরেছে। এক মাসেই জব্দ মাদকের এই পরিমাণ বলে দেয়, উচ্চমূল্যের মাদকটি কত দ্রুত বিস্তার করছে এদেশে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, সরকার ধারাবাহিকভাবে কঠোর অভিযান চালালেও মাদক থেকে বাঁচানো যাচ্ছে না দেশের যুবসমাজকে। জিরো টলারেন্স নীতি নেয়ার কারণে ওই সব অভিযানে মাদক কারবারিদের অনেকে প্রাণ হারিয়েছে। তার পরও এর বিস্তার রোধ করা যায়নি। বরং দেশে নতুন নতুন মাদকের দেখা মিলছে। এসব মাদক আগেরগুলোর চেয়ে আরো ভয়াবহ।
লক্ষণীয়, দেশে যতই কড়াকড়ি আরোপ করা হোক না কেন, এ ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশগুলোর ভূমিকাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সীমান্তের হাজার হাজার কিলোমিটার পথ যদি মাদক পাচারে ব্যবহৃত হয়, আর সেখানেই যদি গড়ে ওঠে মাদকের কারখানা; তাহলে আমাদের দেশের তরুণ-যুবকদের মাদকের হাত থেকে রক্ষার কোনো উপায় থাকে না।
তারা বলেন, সমাজে চরম নিষ্ঠুরতা-নির্মমতা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। তরুণ সমাজকে দ্রুত গ্রাস করে ফেলছে সর্বনাশা মাদক। তাই ভয়ংকর এই মাদক নির্মূলে এখনই সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯২৩
আপনার মতামত জানানঃ