রাশিয়া কি অজেয়? বিশ্বের বৃহত্তম এই রাষ্ট্রটিকে যুদ্ধের আঁতুড়ঘর বললে ভুল হয় না তেমন। প্রাচীন মঙ্গল বাহিনী থেকে শুরু করেন পোলিশ জোট, সুইডেন, নেপোলিয়নের ফ্রান্স কিংবা হিটলারের জার্মানি— শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিশ্বের একাধিক শক্তিধর সভ্যতা ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে গেছে রুশ অধিগ্রহণের। তবে ক্রেমলিন কিংবা মস্কোয় পতাকা উত্তোলনে ব্যর্থ হয়েছে অধিকাংশ শক্তিই। বাধ্য হয়েছে বশ্যতা স্বীকার করতে।
‘জেনারেল উইন্টার’
রাশিয়া আক্রমণের ইতিহাসের কথা উঠলেই অবশ্যিকভাবেই চলে আসবে ‘জেনারেল উইন্টার’-এর প্রসঙ্গ। রুশ সেনাবাহিনীর বাইরেও হিমায়িত রাশিয়ান শীত যেন গোটা ভূখণ্ডের এক অতন্দ্র প্রহরী। এমন কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছে বহু যুগ আগে থেকেই।
অস্বীকার করার জায়গা নেই, রাশিয়ার ভয়ঙ্কর শীত শত্রুপক্ষের অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। নেপোলিয়ন কিংবা জার্মানির রুশ-আক্রমণের পরিণতির কথা নতুন করে বলে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। সেসময়ও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল রাশিয়ার ‘শীত-প্রহরী’-ই।
রাশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলই তুষারাবৃত থাকে বছরের বেশিরভাগ সময়। এই প্রতিকূল পরিবেশে নিজেদের খাপ খাইয়ে নেওয়াই সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ আক্রমণকারীদের কাছে। অন্যদিকে রাশিয়ার নাগরিকরা শীতযাপনে সাবলীল এবং চির-অভ্যস্ত। ফলে, তাদের সহনশীলতাও অন্যান্য দেশের নাগরিকদের থেকে অনেকটাই বেশি।
বিশ্বের বৃহত্তম রাষ্ট্র
কিন্তু শুধুই কি শীত? তাছাড়াও একাধিক কারণ লুকিয়ে রয়েছে রাশিয়ার ‘অজেয়’ তকমার পিছনে। তার মধ্যে রাশিয়ান ভূখণ্ডের দৈত্যাকার আয়তনও অন্যতম কারণ। হিসেব মতো দেখতে গেলে রাশিয়ার মধ্যে ঢুকে যেতে পারে দুটি যুক্তরাষ্ট্র। শুধু আয়তনেই নয়, প্রস্থেও প্রায় যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিগুণ রাশিয়া।
ফলে, রাশিয়ার মূল শক্তিকেন্দ্রগুলিও একে অপরের থেকে যথেষ্ট দূরবর্তী। শুধু সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকেই মস্কোর দূরত্ব ৪০০ মাইল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নরম্যান্ডি ও প্যারিস অধিগ্রহণেই মিত্র বাহিনীর সময় লেগেছিল প্রায় ২ মাস। এই দুই শহরের দূরত্ব মাত্র ১৬০ মাইল।
সেখানে ৪০০ মাইল পথ অতিক্রম করা যেকোনো শক্তির পক্ষেই বেশ চ্যালেঞ্জিং, তাতে আর নতুন কী? রুশ অধিগ্রহণ সময় সাপেক্ষ হওয়ায়, শীতের প্রকোপ এড়িয়ে রাশিয়া আক্রমণ করা তাই কার্যত অসম্ভব।
রাশিয়া অধিগ্রহণ সম্পর্কে কূটনীতিবিদ কনরাড মুজিকার অভিমত, ‘দেয়ার ইজ নাথিং দেয়ার’। অর্থাৎ, সমগ্র রাশিয়াকে মরুপ্রান্তরের সঙ্গে তুলনা করলেও ভুল হয় না বিন্দুমাত্র। মস্কো অতিক্রম করে গেলে বাকি রাশিয়া গোটাটাই প্রায় ‘ফ্লাইওভার কান্ট্রি’।
গোটা দেশজুড়েই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য শহর। কিন্তু তাদের মধ্যে যোগাযোগের পর্যাপ্ত পরিকাঠামো নেই বললেই চলে। নেই এয়ারফিল্ড বা ট্যাঙ্কের জন্য বিশেষ অবকাঠামোও। প্রদেশ ভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থার ওপরে দাঁড়িয়ে থাকায় তাতে রুশ শক্তির বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না। কিন্তু বহিরাগত শক্তির পক্ষে এই বিস্তীর্ণ ধূধূ প্রান্তরে টিকে থাকাই একটা বড়ো চ্যালেঞ্জ।
ভৌগলিক গঠন
রাশিয়ার এই দৈত্যাকার আয়তনের আরও এক দোসর তার প্রতিকূল ভৌগলিক গঠন। রাশিয়ায় সবমিলিয়ে অস্তিত্ব রয়েছে ১১টি টাইম জোনের। আর খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রায় সমস্ত রকমের জলবায়ুর উপস্থিতিই লক্ষণীয় রাশিয়ায়।
একদিকে যেমন রয়েছে ক্রান্তীয় অরণ্যের উপস্থিতি, তেমনই কাজাখ মরুভূমির কিছুটা অংশও রাশিয়ার অন্তর্গত। একাধিক প্রাকৃতিক পরিবেশে লড়াই করার মানসিকতা তৈরি করাও বেশ কঠিন যেকোনো শত্রুর কাছেই।
যুদ্ধবাজ জাতি
আর রাশিয়ান সেনাবাহিনীর শক্তি? সামরিক ক্ষমতার দিক থেকে দেখতে গেলে রাশিয়ার তুলনায় ধারে-ভারে কয়েকগুণ এগিয়ে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। শুধু প্রযুক্তিগত দিক থেকেই নয়, আমেরিকার সেনা সংখ্যাও অনেকটাই বেশি রাশিয়ার তুলনায়। কিন্তু জরুরি অবস্থায় প্রায় সকল রাশিয়ান নাগরিকই হাজির হতে পারেন যুদ্ধক্ষেত্রে। অন্তত ইতিহাস তেমন কথাই বলছে।
বিশ্বের সবচেয়ে ‘যুদ্ধবাজ জাত’ হিসাবে পরিচিত রুশরা। এমনকি রুশ ভাষাকেও বলা হয় ‘সবচেয়ে আগ্রাসী ভাষা’। উগ্র জাতীয়তাবাদ তার অন্যতম কারণ। ফলে, সাধারণ নাগরিকরা হাতে যুদ্ধাস্ত্র তুলে নিলে সেনাবাহিনীর সমীকরণ অনেকটাই ওলটপালট হয়ে যাবে, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। এবং সবচেয়ে বড়ো কথা হল, রাশিয়ার রুশ নাগরিকদের সহনশীলতা কিংবা রণকৌশলও প্রায় সহজাত।
প্রতিকূল পরিবেশের জন্যই অধিকাংশ রুশ নাগরিকই নির্ভর করে থাকে শিকারের ওপরে। ‘ওয়ান শট ওয়ান কিল’— সীমিত সরবরাহের কারণে অনেকটা এমন চিন্তাধারাতেই বিশ্বাসী তারা। সাধারণ রাশিয়ান নাগরিকদের এই শিকারি সত্তাই জয় এনে দিয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও।
জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা
পাশাপাশি জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ রুশদের কাছে নিজের দেশের পরিকাঠামো ও নগর ধ্বংস করে ফেলাও খুব একটা আশ্চর্যকর নয়। প্রাচীন যুগ থেকে বার বার এমনই ঘটে আসছে রুশ অধিগ্রহণের সময়। ফ্রান্স কিংবা জার্মানির আক্রমণের সময় থেকে বার বার রুশ নগরীগুলিতে অগ্নিসংযোগ করেছে স্বয়ং রাশিয়ানরাই।
শত্রুপক্ষের হাতে বশ্যতা স্বীকার না করে নিজেরাই ধ্বংস করেছে নিজেদের পরিকাঠামো। তাতে বিপক্ষের টিকে থাকা আরও দুরূহ হয়ে উঠেছে যেন। অন্যদিকে রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে শত্রুপক্ষের কাছে। কাজেই শত্রুকে জব্দ করতে নিজের দেশের অভ্যন্তরে পারমাণবিক হামলা চালাতেও বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করবে না রাশিয়া। কেননা আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হলেও, বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড থাকার কারণে তাতে রুশ নাগরিকদের হতাহতের সংখ্যা থাকবে সীমিতই।
সবমিলিয়ে দেখতে গেলে রাশিয়া অধিগ্রহণ চিন কিংবা ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির মতো শক্তিশালী প্রতিবেশীদের পক্ষেও প্রায় অসাধ্যসাধণ। সেখানে আমেরিকার কাছে আরও একটি বড়ো প্রতিবন্ধকতা রাশিয়ার ভূখণ্ড থেকে তার দূরত্ব। ফলে, রুশ আক্রমণ অসম্ভব না হলেও, রুশ সাম্রাজ্যে বহিরাগত শক্তির প্রভাব টিকিয়ে রাখা এক প্রকার অসম্ভব। আর ঠিক এই কারণেই ‘রাশিয়া জয়’ একপ্রকার মিথ হয়েই রয়ে গেছে যুগের পর যুগ ধরে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬৫৫
আপনার মতামত জানানঃ