সম্প্রতি দেশে কনস্টেবল থেকে শুরু করে পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বেড়ে গেছে। এসব অপরাধ ও অপকর্মের মধ্যে ক্ষমতার অপব্যবহার, দায়িত্বে অবহেলা ও ঘুষ গ্রহণ ছাড়াও চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, এমনকি ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার মতো ঘৃণ্য অপরাধও আছে।
এরই ধারাবাহিকতায় ৩ লাখ টাকা ঘুষ দিতে না পারায় হেরোইন দিয়ে মিথ্যা মামলা ও হয়রানির অভিযোগে পল্লবী থানার এসআই কাজী রায়হানুর রহমান ও এসআই মাহাবুবের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে এক নারী।
রাজধানীর পল্লবীতে নিজ বাসায় গত ৯ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টা ৩০ মিনিটে মোবাইল ফোন মেরামত করছিলেন হাবিব শেখ। এ সময় পুলিশের সোর্স মিজানসহ পল্লবী থানার এসআই কাজী রায়হানুর রহমান ও এএসআই মাহাবুব আসেন। তারা হাতকড়া পরিয়ে হাবিবকে থানায় নিয়ে যান।
স্বামীকে ছাড়াতে স্ত্রী সাথী আক্তার ১০ হাজার টাকা নিয়ে থানায় যান। পরে তার কাছে ৩ লাখ টাকা দাবি করা হয়। সেই টাকা দিতে না পারায় হাবিবের বিরুদ্ধে মাদক মামলা দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তার স্ত্রী।
রাজধানীর সেগুনবাগিচায় রোববার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব অভিযোগ করেন হাবিবের স্ত্রী।
এ বিষয়ে পুলিশের ফর্মা হিসেবে পরিচিত মিজানের ভিডিও রেকর্ড রয়েছে হাবিবের স্ত্রী সাথী আক্তারের কাছে।
ঘটনার শুরু গত ৯ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১০টার দিকে। হঠাৎ করেই পল্লবীর ই-ব্লকের পাঁচ নম্বর লাইনের হাবিবের ৯ নম্বর ভাড়া বাসায় অভিযান চালায় পুলিশ। হাবিবের স্ত্রী সাথী আক্তার জানান, হাবিব তখন বাসায় মোবাইল ফোন মেরামত করছিলেন। কালশী এলাকায় পুরাতন অকেজো ফোন ক্রয় করে তা মেরামত করে বিক্রি করেন হাবিব। ওই সময় পুলিশের ফর্মা মিজানসহ অজ্ঞাত দুজন ফর্মাসহ পল্লবী থানার এসআই কাজী রায়হানুর রহমান ও এএসআই মাহবুবের নেতৃত্বে অভিযান চালায়। এ সময় বাসা থেকে পুরাতন, ভাঙা প্রায় দুই শ মোবাইল ফোন জব্দ করে নিয়ে যায় পুলিশ। অভিযোগ করা হয়, চোরাই মোবাইল মেরামত করে বিক্রি করেন হাবিব।
কিন্তু থানায় নিয়ে যাওয়ার পরই ভিন্ন ঘটনা। হাবিবকে দিয়েই তার স্ত্রী ও স্বজনদের ডেকে নেওয়া হয় থানায়। রাত তখন প্রায় ১২টা। থানা ভবনের চার তলার এক কর্নারে একটি চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয় হাবিবকে। তখন হাবিবের স্ত্রী সাথীর সঙ্গে ছিলেন তার শাশুড়ি, মামা বাহাদুর মিয়া, স্বামী হাবিরের বন্ধু হাসান। হাবিবের কাছে যেতে চাইলে সাথীকে বাধা দেয় পুলিশ। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয় হাবিব ও সাথীকে। বাধ্য হয়ে সাথী একটু দূরে সোফায় গিয়ে অন্যদের সঙ্গে বসেন। এর মধ্যেই হঠাৎ শুনতে পান মারের শব্দ। হাবিবের গালে থাপ্পড় দিচ্ছিলেন এএসআই মাহবুব। এর মধ্যেই ফ্লোরে শুইতে বলেন।
ফ্লোরে না শুইলে চেয়ার থেকে লাথি মেরে নিচে ফেলে দেন এএসআই মাহবুব। এসময় ফর্মা মিজান ও শামীমসহ তিন-চার পুলিশ সদস্য ছিলেন। পাশেই বসা ছিলেন এসআই কাজী রায়হানুর রহমান। ফ্লোরে ফেলে লাঠি দিয়ে পা, উরু, কোমরে পিটাতে থাকেন মাহবুব। মারধরের শিকার হাবিব হাউমাউ করে কাঁদছিলেন। মাহবুবের পা ধরে ক্ষমা চাচ্ছিলেন।
এ সময় কেন মারতেছেন জানতে চাইলে সাথীকে ধমক দেন মাহবুব। তিনি তখন হাবিবকে গালি দিয়ে বলেন, ওদের ৩ লাখ টাকা দিতে বল। নইলে হেরোইনের মামলা দেব। তিন বছরেও জেল থেকে ছাড়া পাবি না। সাথী তখন হেরোইন মামলা কেন দিবেন জানতে চাইলে ৩ লাখ না দিলে মাদক মামলাই দেওয়া হবে বলে জানান এএসআই মাহবুব। মিজান তখন সাথীকে বলছিলেন, টাকা নিয়ে আসেন।
টাকার জন্য অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছে আমার স্বামীকে। চোখের সামনে স্বামীকে এভাবে নির্যাতন করা কোনো নারী সহ্য করতে পারবে না। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন এই নারী।
একইভাবে এসআই রায়হান বলেন, টাকা নিয়ে আসেন। এএসআই মাহবুব বলেন, টাকা দে নইলে জামাইকে আরো পিটাব। নিরুপায় হয়ে সাথী তখন তাদের জানান, তার কাছে এত টাকা নেই। গরিব মানুষ এত টাকা দেওয়ার সাধ্য নেই। রাত আড়াইটার দিকে থানা থেকে বের হন হাবিবের স্ত্রী ও স্বজনরা। এ সময় তাদের সঙ্গে থানার পশ্চিম দিকে ফ্লাইওভারের নিচে গিয়ে কথা বলেন ফর্মা মিজান।
তিনি জানান, টাকা দিতে হবে নইলে মাদক মামলায় আসামি করা হবে। ১০ হাজার টাকা দিতে পারবেন জানালে অসন্তুষ্ট হয়ে ফিরে যান মিজান। সাথী অভিযোগ করেন, দাবিকৃত ৩ লাখ টাকা না দিতে পারায় হাবিবের হাত-পা বেঁধে নির্যাতন করা হয় থানায়। থানা ভবনের সিলিংয়ে ঝুলিয়ে নির্যাতন করা হয় তাকে। এ সময় বেশ কয়েকবার বমি করেছেন হাবিব।
খুদে ব্যবসায়ী হাবিবকে নির্যাতন ও মিথ্যা মামলার বিষয়ে গত ১২ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও মহাপুলিশ পরিদর্শক (আইজিপি) বরাবর পৃথক অভিযোগ দিয়েছেন তার স্ত্রী সাথী আক্তার।
সাথী আক্তার জানান, তারা নিন্ম আয়ের মানুষ। হাবিব জেলে থাকায় দুটি সন্তান নিয়ে অসহায়ভাবে দিনাতিপাত করছেন তিনি।
তিনি বলেন, টাকার জন্য অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছে আমার স্বামীকে। চোখের সামনে স্বামীকে এভাবে নির্যাতন করা কোনো নারী সহ্য করতে পারবে না। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন এই নারী।
স্বামীর মিথ্যা মামলার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছেও বিচার চান তিনি। শেখ হাসিনাকে ‘মমতাময়ী’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তিনি সবার মা। তিনি যেন বিষয়টা দেখেন।’
দুটো সন্তান আছে জানিয়ে সাথী বলেন, ‘আমাকে ব্ল্যাকমেইল করা হইল। গরিব হয়ে জন্মানো কি অপরাধ। আমরা তো এই দেশের নাগরিক। আমাদেরও বাঁচার অধিকার আছে।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অফিসে অভিযোগ জানিয়েছেন বলেও জানান সাথী।
অভিযোগ জানানোর পর কোনো সাড়া পেয়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, কেউ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে নাই। কোনো বিচার পাই নাই।’
হেরোইন মামলায় স্বামী বর্তমানে জেলে রয়েছেন বলে জানান তিনি। পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করায় তাদের নানা রকম হুমকি দেয়া হচ্ছে বলেও জানান।
সংবাদ সম্মেলনে হাবিব শেখের মা নাসিমা বেগম বলেন, ‘অনেক খারাপ কথা কইছে (বলছে), গালিগালাজ করছে। আমার পোলারে অনেক মারছে।’
অভিযোগের বিষয়ে পল্লবী থানার এসআই কাজী রায়হানুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে প্রথমে তিনি কথা বলতে রাজি হননি। পরে অভিযোগ শুনে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি গাড়ি চালাচ্ছি, পরে কথা বলেন। সরাসরি এসে কথা বলেন।’
এরপরই তিনি মুঠোফোনের সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করে দেন।
পল্লবী থানার পরিদর্শকের (তদন্ত) সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমি জানি না।’
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পুলিশের বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ার হার আশংকাজনক। প্রায় প্রতিদিনই পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে বিভিন্ন অপকর্মের। এবিষয়ে পুলিশের কর্তৃপক্ষসহ দেশের সরকাকেও নজর বাড়াতে হবে। কেননা, আইন রক্ষাকারী কর্তৃক একেরপর এক আইন বিরোধী কর্মকাণ্ডে দেশের আইনের প্রতি মানুষের অনাস্থা জন্মাবে। ফলশ্রুতিতে দেশে দেখা দিবে বিশৃঙ্খলা।
সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আইনের খড়্গ চালানোর আগে পুলিশের ওপর চালানো প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা। তারা বলেন, আগে পুলিশকে অপরাধমুক্তের চরিত্র অর্জন করতে হবে। নইলে সন্ত্রাসীদের নিকট পুলিশের যে ভাবমূর্তি সৃষ্টি হচ্ছে, এতে পুলিশ আর সন্তাসীদের মধ্যকার তফাৎ ঘুচে যায়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮১৯
আপনার মতামত জানানঃ