পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় বেড়িবাঁধ সংস্কারের নামে উজাড় করা হচ্ছে সংরক্ষিত বনের হাজার হাজার গাছ। ৫০-৬০ বছরের এসব পুরনো বড় বড় গাছ স্কেভেটর (ভেকু) দিয়ে উপড়ে ফেলছে। বনের গাছ উপড়ে ফেলে কেটে নেয়া হচ্ছে বনের মাটি। বনের ভেতরে বড় বড় পুকুর বা দীঘি কাটা হয়েছে। বন ও পরিবেশ আইনের তোয়াক্কা না করেই বছর ধরে বন ধ্বংস করে আসলেও নির্বিকার বন বিভাগসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় বেড়িবাঁধ সংস্কারে মাটির পরিবর্তে বালু ব্যবহার করার অভিযোগ উঠেছে। ফলে বেড়িবাঁধের স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এলাকাবাসী। এমনকি বালুর ওপর মাটির প্রলেপ দিতে কাটা হচ্ছে সংরক্ষিত বনের মাটি। এতে বনের ৫০-৬০ বছরের পুরোনো শত শত গাছ উজাড় হচ্ছে। এক বছর ধরে বন ধ্বংস করা হলেও নির্বাক বনবিভাগের কর্তাব্যক্তিরা।
এদিকে ২০২১ সালের ১০ মার্চ গঙ্গামতি বিট কর্মকর্তা মহিপুর রেঞ্জ অফিস বরাবর একটি অভিযোগপত্র দায়ের করার মধ্যদিয়ে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য শেষ করেছেন। কিন্তু নেওয়া হয়নি কোনো আইনগত ব্যবস্থা।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না সিকো কোম্পানি ও বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সাল থেকে উপকূলীয় বেড়িবাঁধ সংস্কার কাজ চলে আসছে। বেড়িবাঁধ সংস্কারের মাধ্যমে উপকূলীয় এলাকায় সবুজ বেষ্টনি গড়ে তোলা প্রকল্পের উদ্দেশ্য। উপকূলীয় এলাকার মানুষকে জ্বলোচ্ছাস থেকে রক্ষা করাই এই প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বলে জানা গেছে। সেখানে হচ্ছে এর উল্টোটা। বনের বড় বড় গাছ উপড়ে ফেলা হচ্ছে। বনের মধ্যে বড় বড় পুকুর এবং দীঘি কেটে মাটি নিয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে বেড়িবাঁধে। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। এরপর চলতি বছরের জুন পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। ওই কোম্পানিটি কাজের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য দুই দফায় সময় নিয়েছে। ওই বর্ধিত মেয়াদের মধ্যে ৮০ ভাগ কাজ শেষ করতে না পারলে প্রকল্প বাতিল হয়ে যাবে। কাজ শেষ না করতে পারার শঙ্কায় ওই কোম্পানিটি স্থানীয় সাব ঠিকাদারদের কাজ ভাগ করে দিয়েছেন। সে কাজ নিয়েও রয়েছে ব্যাপক অনিয়ম।
বেড়িবাঁধ সংস্কারের কাজে নিয়োজিত সাব ঠিকাদার থেকে শুরু করে প্রকল্প প্রকৌশলীরা বলছেন, বনবিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করেই তারা বনের ভেতর থেকে মাটি কাটছেন। প্রতিদিনই বনবিভাগের কর্মকর্তারা উপড়ে ফেলা গাছ কেটে সরিয়ে নিচ্ছেন বলে মন্তব্য করেন ঠিকাদাররা। বন উজাড় করে মাটি কেটে নেওয়ার ফলে পরিবেশের ওপর মারাক্তক প্রভাবের আশঙ্কা করছেন পরিবেশ আইনবিদরা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কুয়াকাটার ৪৮ নং পোল্ডারের খাজুরা ও গঙ্গামতি সংরক্ষিত বনের মাঝখানে বড় বড় দিঘি কাটা হয়েছে। আবার কোথাও কোথাও খাল কেটে মাটি নেওয়া হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধের স্লোভ থেকে প্রায় ৪০০-৫০০ মিটার বনের ভেতর থেকে গাছ উপড়ে মাটি নেওয়া হয়েছে। এখনও চলমান রয়েছে এসব ধ্বংসযজ্ঞ।
বেড়িবাঁধ সংস্কার করতে মাটি বাইরে থেকে না কিনে সাব ঠিকাদাররা বনবিভাগের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে বনের ভেতর থেকে মাটি নিয়ে ব্যবহার করছে। বনের লবণযুক্ত পলিমাটির সঙ্গে বালুযুক্ত এসব মাটি ব্যবহারে তৈরি হচ্ছে নাজুক বাঁধ। স্থানীয়দের মতে, এ বেড়িবাঁধ টেকসই হবে না। বেড়িবাঁধে বালু দিয়ে তার ওপরে মাটির প্রলেপ দেওয়া হচ্ছে।
কথা হয় সাব ঠিকাদার মহসিন ও জামালের সঙ্গে। তারা জানান, মাটির দাম ধরা হয়েছে খুবই কম। এ টাকা দিয়ে মাটি কেনা সম্ভব নয়। এই টাকা শুধু মাটি আনা-নেওয়ার কাজেই ব্যয় হয়।
তারা আরও জানায়, পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং বনবিভাগের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে বনের ভেতর থেকে মাটি কেটে নিচ্ছেন তারা। প্রতিনিয়ত বনবিভাগের কর্মকর্তারা দেখাশুনা করছেন। মাটির মান নিয়ে তিনি বলেন, মাটি পাওয়া যাচ্ছে না, তাই বনের পলিমাটি ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। এ মাটি ব্যবহারে প্রকল্প প্রকৌশলীদের সম্মতি আছে।
পটুয়াখালী বনবিভাগের মহিপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. আবুল কালাম বলেন, বন উজাড় করে মাটি কেটে বেড়িবাঁধে ব্যবহারের বিষয়ে স্থানীয় বিট কর্মকর্তা ২০২১ সালের ১০ মার্চ একটি লিখিত অভিযোগ তার কাছে দিয়েছেন। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করা হয়েছে। কোনো মামলা হয়েছে কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশনা পেলে মামলা করা হবে।
সবুজ বেষ্টনী প্রকল্পের প্রকৌশলী মো. মজিবুর রহমান বলেন, গাছ উপড়ে ফেলে বনের ভেতর থেকে মাটি কাটার বিষয়ে আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে কাজ বন্ধ করে দেওয়া হবে। কাজের অনিয়মের বিষয়ে তিনি বলেন, ঢাকা থেকে এসে প্রকল্পের সচিব, পরিচালকসহ একটি প্রতিনিধি দল পরিদর্শন করে গেছেন। পরিদর্শন রিপোর্ট দিলে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবেন তারা।
বনবিভাগ তাদের দায়িত্ব কর্তব্য পালন না করে এতে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ সমর্থন করে নৈতিকতাবিরোধী কাজ করছেন। সবুজ বেষ্টনী প্রকল্পের নামে এমন ধ্বংসযজ্ঞ পরিবেশের ওপর মারাত্মক হুমকি বয়ে আনবে।
পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়কারী লিংকন বায়েন বলেন, বন উজাড় করে মাটি নিয়ে বেড়িবাঁধ সংস্কার করা বন ও পরিবেশ আইনে কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। পরিবেশ-প্রকৃতি ধ্বংস করে বনের ভেতরে পুকুর বা দিঘি কাটা আইনবিরোধী কাজ। বনবিভাগ তাদের দায়িত্ব কর্তব্য পালন না করে এতে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ সমর্থন করে নৈতিকতাবিরোধী কাজ করছেন। সবুজ বেষ্টনী প্রকল্পের নামে এমন ধ্বংসযজ্ঞ পরিবেশের ওপর মারাত্মক হুমকি বয়ে আনবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফ হোসেন বলেন, বালু দিয়ে কাজ করার কোনো সুযোগ নেই। বেড়িবাঁধ মাটি দিয়ে হয়, মাটি দিয়েই হবে। কার্যাদেশ মানা না হলে ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কুয়াকাটা সৈকতের কোল ঘেঁষে রয়েছে বিশাল বনাঞ্চল। একসময় কুয়াকাটার সৈকত ঘেঁষা নারকেল বাগান, জাতীয় উদ্যানের ঝাউ বাগান, ম্যানগ্রোভ বন পর্যটকদের আকৃষ্ট করতো। কিন্তু সেই বনভূমি ক্রমশ দখল হয়ে যাচ্ছে। বনের গাছ কেটে সেখানে বসতি স্থাপন করছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। দেদারছে সংরক্ষিত বন ধ্বংস করে বনের জমিতে বাড়ি-ঘর তুলছে এক শ্রেণীর অসাধু মানুষ। বন বিভাগ চেষ্টা করেও থামাতে পারেনি। সম্প্রতি দখল হয়ে যাওয়া বনভূমি উদ্ধারে জেলা প্রশাসনের সহায়তা চেয়ে চিঠি দিয়েছে তারা।
জানা যায়, দখলদাররা ইতোমধ্যে ৩২৯.৬০ একর বনভূমি দখল করে ফেলেছে। তবে তাদের মধ্যে ৩৮৩ জনকে চিহ্নিত করে একটি তালিকা তৈরি করেছে বন বিভাগ।
সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা মনে করেন, বনভূমি বেদখল হয়ে যাওয়ার অর্থ শুধু এই নয় যে এভাবে রাষ্ট্রের সম্পত্তি ব্যক্তি–প্রতিষ্ঠানগুলোর দখলে চলে যাচ্ছে। এর অর্থ এটাও যে এইভাবে দেশের বনভূমি উজাড় হয়ে যাচ্ছে এবং তার ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। জাতিসংঘের বেঁধে দেওয়া লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্রতিটি রাষ্ট্রে মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে বনভূমি উজাড় হতে হতে এখন ১৫ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে; অবশ্য এই হিসাব সরকারের বন অধিদপ্তরের। বেসরকারিভাবে ধারণা করা হয়, আমাদের দেশে এখন প্রকৃত বনভূমির পরিমাণ এর চেয়ে কম।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানান, অবৈধ দখলদারেরা সাধারণত স্থানীয়ভাবে ক্ষমতাবান হয়ে থাকে, বিশেষত রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে এমন ব্যক্তিরা এসব তৎপরতায় লিপ্ত হয় এবং তাদের ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগের ব্যবস্থা যথাযথভাবে কাজ করে না। তাই রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী অবৈধ দখলদারদের দমন করার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। বন বিভাগের অসাধু অংশের সঙ্গে অবৈধ দখলদারদের যোগসাজশও ছিন্ন করতে হবে। আর অবিলম্বে বেদখলে থাকা বনভূমি পুনরুদ্ধারের জন্য কঠোর ও ব্যাপক অভিযান চালানো প্রয়োজন বলে জানান তারা।
বন ধ্বংস হওয়ার ফলে বিপন্ন হচ্ছে পশু-পাখির আশ্রয়স্থল। এর ফলে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য। দেশে এমনিতেই প্রয়োজনের তুলনায় বনাঞ্চল অনেক কম। এশিয়ার অনেক উন্নয়নশীল দেশ অথবা পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ এখনো যুগোপযোগী ও কল্যাণকর বন আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে।
শিল্পোন্নত দেশ জাপানের ভূখণ্ডের শতকরা ৭০ ভাগ এবং জনবহুল দেশ ইন্দোনেশিয়ার ৫০ ভাগ ভূখণ্ড বনে আচ্ছাদিত। সঠিক, বাস্তব ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও তার যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমাদের দেশেও বন সংরক্ষণ করা সম্ভব।
তারা বলেন, এজন্য নিতে হবে যথাযথ পদক্ষেপ। দেশে যে সামাজিক বনায়ন বিধিমালা করা হয়েছিল, সেটির ফলাফল আশাব্যঞ্জক নয়। গত শতকের আশির দশকে সামাজিক বনায়নের ভুল ও অপরিকল্পিত বাস্তবায়নের কারণে দেশের ‘শালবন’ প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। কাজেই দেশের বনাঞ্চল রক্ষায় একটি যথোপযোগী বন আইন প্রণয়ন ও এর বাস্তবায়ন জরুরি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৪৮
আপনার মতামত জানানঃ