দাবানল, দাবদাহ, খরা, বন্যা, মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও ঘূর্ণিঝড়ে বিশ্ব এখন বিপর্যস্ত। অঞ্চলভেদে বিভিন্ন দেশে এসব দুর্যোগ দেখা যাচ্ছে। চীন, ভারত ও জার্মানিতে চলতি মৌসুমে কয়েক দফা বন্যা, ঘূর্ণিঝড় হয়েছে। কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র স্মরণকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার মুখে পড়েছে। গ্রিস, তুরস্ক, ইতালিসহ দক্ষিণ ইউরোপ পুড়ছে দাবানলে। বেলজিয়ামসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশ রেকর্ড বৃষ্টিপাত দেখেছে। ব্রাজিল, মাদাগাস্কারসহ গোটা আফ্রিকা খরায় বিপর্যস্ত। জলবায়ুর এমন চরম বৈরিতার মুখে বিশ্ব।
বর্তমান বিশ্বে ব্যাপকভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীতে প্রতি বছর ত্বরিত গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে গড় তাপমাত্রার পরিমাণ। সাম্প্রতিক সময়ে অতিমাত্রা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এখন বিশ্বকে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের এই বিরূপ প্রভাবের কবলে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ।
কয়েক দশকের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ইউনিসের তাণ্ডবে লন্ডভন্ড ইউরোপের উত্তরপশ্চিমাঞ্চল। ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৯৬ কিলোমিটার গতিতে আঘাত হানা এ ঝড়ে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত নয়জন, বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন লক্ষাধিক মানুষ। চাল উড়ে গেছে বিখ্যাত ও২ অ্যারেনার। কার্যত পুরো ইউরোপকে থামিয়ে দিয়েছে ঘূর্ণিঝড় ইউনিস।
শুক্রবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) কর্নওয়ালে আছড়ে পড়ার পর পশ্চিম ইংল্যান্ডে রীতিমতো তাণ্ডব চালিয়েছে ইউনিস। ঝড়ের প্রভাবে উত্তাল হয়ে উঠেছিল সমুদ্র, তীরে একের পর এক আছড়ে পড়েছে বিশাল বিশাল ঢেউ।
যুক্তরাজ্যের আবহাওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী, আটলান্টিক মহাসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ইউনিস গতকাল অ্যাজোরস দ্বীপপুঞ্জ এলাকা হয়ে ইউরোপের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূলে আছড়ে পড়ে।
বার্তা সংস্থা এএফপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্রিটেনের আবহাওয়া অফিস রেড অ্যালার্ট জারি করার পর পুরো লন্ডন ফাঁকা হয়ে যায়। মানুষজন বুঝে যায় যে এখানে থাকাটা জীবনের জন্য বিপজ্জনক। পুলিশ জানায়, এত সতর্কতার পরেও লন্ডনের একটি রাস্তায় একটি গাড়ির ওপর গাছ পড়ে থাকতে দেখা যায়, যেখানে ৩০ বছর বয়সী এক নারীকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তিনি সম্ভবত গাড়ি নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে যাচ্ছিলেন।
এদিকে, মারসিসাইড পুলিশ জানিয়েছে, ৫০ বছর বয়সী এক ব্যক্তি উত্তর-পশ্চিম ইংল্যান্ডে একটি গাড়ির উইন্ডস্ক্রিনে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মারা গেছেন।
কয়েক দশকের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ইউনিসের তাণ্ডবে লন্ডভন্ড ইউরোপের উত্তরপশ্চিমাঞ্চল। ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৯৬ কিলোমিটার গতিতে আঘাত হানা এ ঝড়ে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত নয়জন, বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন লক্ষাধিক মানুষ। চাল উড়ে গেছে বিখ্যাত ও২ অ্যারেনার। কার্যত পুরো ইউরোপকে থামিয়ে দিয়েছে ঘূর্ণিঝড় ইউনিস।
ব্রিটেনের বাইরে গাছ পড়ে নেদারল্যান্ডসে তিনজন এবং দক্ষিণ-পূর্ব আয়ারল্যান্ডে ৬০ বছর বয়সী এক ব্যক্তি মারা গেছেন। এ ছাড়া বেলজিয়ামে ৭৯ বছর বয়সী একজন কানাডীয় লোক মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। নেদারল্যান্ডসের উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশ গ্রোনিংজেনের অ্যাডর্পের কাছে একটি রাস্তায় গাছের সঙ্গে গাড়ির ধাক্কা লেগে একজন মোটরচালক নিহত হয়েছেন। অন্যদিকে হেগ শহরে গির্জার চূড়া ভেঙে পড়ার আশঙ্কায় কয়েক ডজন বাড়ি খালি করা হয়েছে। একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, গির্জার খাঁড়া অংশটি নড়বড় করছে। এ ছাড়া একটি গাড়ির ওপর ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে।
ঘূর্ণিঝড় ইউনিসের পূর্বসতর্কতা হিসেবে লন্ডন ছাড়াও দক্ষিণ ইংল্যান্ড, সাউথ ওয়েলস এবং নেদারল্যান্ডসজুড়ে সর্বোচ্চ আবহাওয়া সতর্কতা জারি করা হয়েছিল। অনেক স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ইউনিসের আঘাতে সমুদ্র উপকূল ভেসে যায় এবং রেল চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
পরিষেবা প্রতিষ্ঠানগুলো জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড় ইউনিসের কারণে ইংল্যান্ডের ১ লাখ ৪০ হাজারেরও বেশি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
যুক্তরাজ্যের রাজধানীর আশপাশে ঝড়ের আঘাতে আহত হওয়ার পরে তিনজনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, ঘণ্টায় ১৯৬ কিলোমিটার বেগে ঘূর্ণিঝড় ইউনিস প্রবাহিত হয়েছে। এটিই ইংল্যান্ডে রেকর্ড করা সর্বোচ্চ দমকা হাওয়া।
গতকাল বিকেলে যুক্তরাজ্যের আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড়টি স্ক্যান্ডিনেভিয়া ও ইউরোপের উত্তরাঞ্চলীয় মূল ভূখণ্ডের দিকে ধেয়ে যাচ্ছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে স্থানীয় সময় গত বৃহস্পতিবার পাঁচ কোটির বেশি মানুষ বিপজ্জনক আবহাওয়ার ব্যাপারে দেওয়া সতর্কতার মধ্যে পার করেছে। দেশটির জাতীয় আবহাওয়া বিভাগ (এনডাব্লিউএস) জানিয়েছে, দুটি ঝড় আলাবামার টাসকালোসা থেকে প্রায় ৩০ মাইল উত্তরে বয়ে গেছে। ঝড়ের কারণে রাস্তার মাঝখানে গাছ ভেঙে পড়েছে এবং অবকাঠামোগত ক্ষতির খবরও পাওয়া গেছে।
এছাড়া বার্মিংহামের পূর্বাঞ্চলের পেল সিটি এবং শহরটির দক্ষিণ-পূর্বে শেলবি কাউন্টিতে ঝড়ের খবর পাওয়া গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ঝড়ের পূর্বাভাস পর্যবেক্ষণ সংস্থা জানিয়েছে- আলাবামা, কেন্টাকি, মিসিসিপি এবং টেনেসিতে গাছ এবং বিদ্যুতের লাইন ভেঙে পড়ার খবর পাওয়া গেছে।
আলাবামাতে বৃহস্পতিবার রাতে প্রায় ২৪ হাজার গ্রাহক বিদ্যুৎহীন ছিলেন। টেনেসিতে ১৬ হাজার বাড়ি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎহীন ছিল। অন্যদিকে কেন্টাকি এবং ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ায় ১০ হাজারের বেশি গ্রাহক ছিলেন অন্ধকারে।
এদিকে আবারও শক্তিশালী শীতকালীন ঝড় আঘাত হানতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলে। এরই মধ্যে মার্কিন কর্তৃপক্ষ এই ঝড়ের কারণে এক হাজারের বেশি ফ্লাইট বাতিল করেছে। দেশটির আবহাওয়া বিভাগ বলছে, ওকলাহোমাসহ বেশ কয়েকটি অঞ্চলে এরইমধ্যে তুষার ঝড়, প্রচন্ড বাতাসসহ বজ্রপাতের সতর্কতা জারি করেছে।
এছাড়া শুক্রবার পর্যন্ত বেশ কয়েকটি টর্নেডো অঞ্চলগুলোতে আঘাত হানতে পারে বলেও সতর্ক করা হয়েছে। এর মধ্যে মিসিসিপি, মিশিগান ও টেনেসিতে বজ্রসহ বৃষ্টিপাতের সতর্কতা জারি করা হয়েছে। এসময় অঞ্চলগুলোতে ভারি তুষারপাতের কারণে সড়ক, মহাসড়কে দুর্ঘটনার পরিমাণ বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে প্রশাসন।
অন্যদিকে, ঝড়ের সতর্কতা জারি করা হয়েছে নেদারল্যান্ড, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশেও। ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে দেড় শতাধিক ফ্লাইট বাতিল করেছে ডাচ কর্তৃপক্ষ। আর আয়ারল্যান্ডে আঘাত হেনেছে ঝড় ‘ডাডলি’। নাগরিকদের ঘরে থাকার আহ্বান জানিয়েছে দেশটির আবহাওয়া বিভাগ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, উন্নত দেশগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে যেভাবে প্রকৃতির সঙ্গে যথেচ্ছাচার করেছে, তাতে প্রকৃতি রুষ্ট হয়ে উঠেছে। কারণ, প্রকৃতি একটি জীবন্ত সত্তা, তাকে শুধু সম্পদ লাভের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। অথচ এ বিষয়টিকে আমলে না নিয়ে উন্নত দেশগুলো নিজেদের তথাকথিত উন্নয়নের স্বার্থে জলবায়ু তহবিল, কার্বন ট্রেড প্রভৃতি তৈরি করে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে টোপ দিয়ে যাচ্ছে।
তারা বলেন, জলবায়ু সম্মেলনগুলোর মূল সুরে সমস্যা সমাধানের কোনো ব্যাপার থাকে না। কারণ, এর মধ্য দিয়ে কার্বন নিঃসরণ কমানোর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। কিন্তু এমন একটা ভাব করা হয় যে সমস্যাটি আমলে নেওয়া হয়েছে। কথা হচ্ছে, দুনিয়ার উন্নয়নের মডেল যেন প্রকৃতির ওপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা না করে প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়, সেটাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাটি যেমন পরিবেশগত, তেমনি একই সঙ্গে তা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকও বটে। উন্নত দেশগুলোর কারণেই এই জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, ফলে তাদের কার্বন উদ্গিরণ হ্রাসে বাধ্য করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন সদিচ্ছা, কার্যকর কূটনীতি ও রাজনীতি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮১৯
আপনার মতামত জানানঃ