সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা কমে আসায় প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস নিয়ে জনমনে উদ্বেগ কিছুটা কমেছে। তবে গত দুই বছরে মানুষের মনের গভীরে যে ক্ষত তৈরি হয়েছে, তা থেকে পরিত্রাণ পেতে সময় লাগবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ কারোনাকালে অর্থনৈতিক সংকট বেড়েছে। চাকরি হারিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে ঘোর অনিশ্চয়তায় পড়েছেন অনেকে। প্রিয়জনের সংক্রমণ ও মৃত্যু, বেকারত্ব এবং জীবনযাপনের স্বাভাবিক পরিস্থিতি না থাকায় মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়েছে এই সময়ে।
করোনাকালের শুরু থেকেই অর্থনৈতিকভাবে সংকটে পড়া বা অনিশ্চিত জীবন নিয়ে ভীত হয়ে উদ্বেগ ও বিষণ্নতায় ভোগা মানুষদের কথা বহুবার আলোচনা হয়েছে। নানান শ্রেণি-পেশার মানুষকে নিয়ে এ বিষয়ে গবেষণাও হয়েছে বিস্তর। তবে দুই বছর পেরিয়ে গেলেও নতুন নতুন গবেষণা বলছে, মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ও বিষণ্নতা বাসা বাঁধছে নতুনভাবে। ঘুণ পোকার মতো তা ক্ষয় ধরাচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্যে। এই বিপর্যস্ত মানসিক অবস্থার বড় আঘাত পড়েছে বাংলাদেশেও। এক গবেষণা বলছে, করোনাকালে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে উদ্বেগ ও বিষণ্নতায় বাংলাদেশ শীর্ষে।
করোনাকালে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে উদ্বেগ ও বিষণ্নতার ওপর ‘প্রিভিলেন্স অব এনজাইটি অ্যান্ড ডিপ্রেশন ইন সাউথ এশিয়া ডিউরিং কোভিড-১৯: আ সিস্টেমেটিক রিভিউ অ্যান্ড মেটা-অ্যানালাইসিস’ শিরোনামে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উদ্বেগ ও বিষণ্নতার ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষে। অংশগ্রহণকারীদের ৫২ শতাংশ উদ্বেগে ও ৪৮ শতাংশ বিষণ্নতায় ভুগেছে। আগে থেকে মানসিক সমস্যায় ভুগছে, এমন ব্যক্তিদের তথ্য এই গবেষণা থেকে বাদ দেওয়া হয়।
খোদ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের জরিপও বলছে, করোনা-সম্পর্কিত উদ্বেগজনিত অসুস্থতার হার সাধারণ উদ্বেগজনিত অসুস্থতার হারের চেয়ে ৬ শতাংশ বেশি।
কোভিড-১৯-এর সময় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে উদ্বেগ ও বিষণ্নতার প্রাদুর্ভাবের ওপর ‘প্রিভিলেন্স অব এনজাইটি অ্যান্ড ডিপ্রেশন ইন সাউথ এশিয়া ডিউরিং কোভিড-১৯: আ সিস্টেমেটিক রিভিউ অ্যান্ড মেটা-অ্যানালাইসিস’ শিরোনামে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় গত বছরের এপ্রিল মাসে। নেদারল্যান্ডসভিত্তিক চিকিৎসা ও বিজ্ঞানবিষয়ক খ্যাতনামা প্রকাশনা সংস্থা এলসেভিয়েরের সেল প্রেসের হেলিয়ন সাময়িকীতে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়। এতে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার ৩৫টি গবেষণা প্রতিবেদনের জন্য অনলাইন, টেলিফোন ও সামনাসামনি জরিপে অংশ নেওয়া ৪১ হাজার ৪০২ জনের মানসিক অবস্থা পর্যালোচনা করা হয়। নেপাল ও শ্রীলঙ্কা থেকে অনেক কম প্রতিবেদন পাওয়া গেছে। ভুটান, মালদ্বীপ ও আফগানিস্তান থেকে এ-সংক্রান্ত কোনো প্রতিবেদন পায়নি গবেষক দল।
মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ও বিষণ্নতা বাসা বাঁধছে নতুনভাবে। ঘুণ পোকার মতো তা ক্ষয় ধরাচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্যে। এই বিপর্যস্ত মানসিক অবস্থার বড় আঘাত পড়েছে বাংলাদেশেও। এক গবেষণা বলছে, করোনাকালে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে উদ্বেগ ও বিষণ্নতায় বাংলাদেশ শীর্ষে।
২০২০ সালের আগস্ট থেকে অক্টোবরের তথ্য পর্যালোচনা করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ৩১টি গবেষণায় ২৮ হাজার ৮৭৭ জনের মধ্যে উদ্বেগের হার ছিল ৪১ শতাংশ। ২৮টি গবেষণায় অংশ নেওয়া ৩৭ হাজার ৪৩৭ জনের মধ্যে বিষণ্নতার মাত্রা ছিল ৩৪ শতাংশ।
সবচেয়ে বেশি গবেষণা ছিল ভারতের। তবে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে উদ্বেগ ও বিষণ্নতার মাত্রা ছিল সবচেয়ে বেশি। জরিপটিতে চাকরিজীবী, পেশাজীবী, ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, নার্স, শিক্ষার্থী, গৃহবধূ, অন্তঃসত্ত্বা নারী, রোগী, বেকার লোকজন অংশ নিয়েছিলেন। উদ্বেগ ও বিষণ্নতার দিক দিয়ে বাংলাদেশ শীর্ষে, যথাক্রমে ৫২ শতাংশ ও ৪৮ শতাংশ। প্রতিবেদনটিতে শ্রীলঙ্কার শুধু ২৫৭ জন অন্তঃসত্ত্বা নারীর ওপর জরিপের তথ্য উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, ওই নারীদের মধ্যে ১৮ শতাংশ উদ্বেগে এবং ২০ শতাংশ বিষণ্নতায় ভুগছিলেন।
অংশগ্রহণকারীদের গড় বয়স ২৬ থেকে ৪৩ বছরের মধ্যে ছিল। আর নারী অংশগ্রহণকারী ছিলেন ৪৫ শতাংশ। নারীদের ৪৬ শতাংশ এবং পুরুষদের ৪১ শতাংশ উদ্বেগে ভুগছিলেন।
করোনাকালে কী ধরনের অসুস্থতায় রোগীরা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন, তা বুঝতে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল একটি জরিপ পরিচালনা করে। গত বছরের ডিসেম্বরে প্রকাশিত জরিপটির শিরোনাম ‘প্যাটার্ন অব সাইকিয়াট্রিক ডিজঅর্ডার অ্যামং ফেসিং দ্য কনসিকোয়েন্সেস অব কোভিড-১৯ প্যানডেমিক অ্যান্ড অ্যাটেন্ডেড ইন আ টারশিয়ারি কেয়ার সাইকিয়াট্রিক হসপিটাল’ (করোনাকালে তৃতীয় ধাপের মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ব্যক্তিদের মানসিক অসুস্থতার ধরন)।
জরিপ প্রতিবেদন অনুসারে, রোগীদের ২৭ শতাংশ আর্থিক সংকট বা চাকরি হারানোর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত। ৩৩ শতাংশের কোভিড-সম্পর্কিত দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগ ছিল, তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোভিডে ক্ষতিগ্রস্ত। উদ্বেগ ও বিষণ্নতাজনিত অসুস্থতায় ভোগা ব্যক্তির হার সমান, প্রায় ১১ শতাংশ। কোভিড-সম্পর্কিত উদ্বেগজনিত অসুস্থতার হার, কোভিড-সম্পর্কিত নয়, এমন উদ্বেগজনিত অসুস্থতার হারের চেয়ে ৬ শতাংশ বেশি, প্রায় ১৯ শতাংশ।
করোনাকালে প্রাপ্ত বয়স্কদের তুলনায় শিশু-কিশোররা অনেক বেশি মানসিক সমস্যায় পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা পরিস্থিতিতে শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সীদের মধ্যে কম বেশি নানা ধরণের মানসিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তবে বিষয়টিকে নীতিনির্ধারনী পর্যায় থেকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নিয়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারলে সহজে সমাধান করা সম্ভব হবে।
করোনা মহামারিকালে অনাকাঙ্খিত মৃত্যু, শোক, আইসোলেশন, চাকরি হারানো, আয় কমে যাওয়া, সংক্রামণের আতংক মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ফলে বেড়ে যাচ্ছে মানসিক অস্থিরতা। মাদকাসক্তও হয়ে পড়েছে অনেকে। মোটকথা বৈশ্বিক মহামারী করোনাকালে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য বিপর্যস্থ হয়ে পড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিভিন্ন সময়ের দেওয়া তথ্যানুযায়ী এই অবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্যে করোনার প্রভাব নিয়ে আরও ব্যাপকভাবে গবেষণা হওয়া দরকার। একই সাথে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা সমাধানে সরকারি-বেসরারি পর্যায়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহন করা জরুরি।
বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণের বিষয়েও চরম নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে। করোনা মহামারী কালে সেই সংকট আরও ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের তথ্যানুযায়ী, করোনা মহামারি শুরুর দিকে হাসপাতালের বর্হিবিভাগের রোগী সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়। তবে এই সংখ্যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদিও করোনাকালে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের বেশির ভাগই করোনা পরবর্তী মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত।
আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশনের ‘চিলড্রেন ভয়েসেস ইন দ্য টাইম অব কোভিড-১৯’ শিরোনামে প্রকাশিত এক জরিপে পাওয়া তথ্যানুযায়ী করোনাকালে প্রায় ৯১ শতাংশ শিশু, কিশোর ও তরুণরা মানসিক চাপ ও শঙ্কার মধ্যে রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে তাদের ঘুমের সমস্যা, অস্থিরতাসহ বিভিন্ন সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।
করোনাকালের ধকল কাটিয়ে সংকটে থাকা ব্যক্তিরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে তো- এ প্রশ্ন অনেকের। সঠিক পরিচর্যা পেলে মানসিক সংকটে থাকা ব্যক্তিরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, মানসিক সংকটে থাকা ব্যক্তিদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। এজন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।
তারা বলেন, করোনা সংক্রমণের আশঙ্কায় মানসিক চাপ বেড়ে যায়। পরিবারের সদস্যদের সংক্রমিত হওয়ার ভয়, নিজে সংক্রমিত হলে চিকিৎসার সুযোগ মিলবে কিনা, তা নিয়ে মানসিক চাপ তৈরি হয়। একই সঙ্গে সংক্রমিত হয়ে আইসোলেশনে থাকাকালীন একাকিত্ব নিয়েও ছিল আতঙ্ক। এ ছাড়া কাছের মানুষের মৃত্যু মনকে শোকাতুর করে তোলে। ভীতিকর চিত্র বা সংবাদ দেখে আতঙ্কবোধ করা। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন; এমন ব্যক্তি যখন দেখেন অধিকাংশ মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন না, তখন তিনি মানসিক চাপ অনুভব করেন।
আরও বলেন, চিকিৎসাসেবার কর্মীরা বাড়তি কাজের চাপের কারণে মানসিক সমস্যায় পড়েন। এ ছাড়া করোনাকালে অর্থনৈতিক সংকট বেড়েছে। অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। এতে মানসিক চাপ তৈরি হয়েছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া না হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৪৫
আপনার মতামত জানানঃ