দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের গতি নিয়ে ব্যবসায়ীদের আত্মবিশ্বাস কমেছে। মূলত করোনাভাইরাসের ওমিক্রন ধরনের বাড়বাড়ন্তের কারণে তাদের আত্মবিশ্বাসে কিছুটা ভাটা পড়েছে।
নানা প্রতিকূলতা কাটিয়ে গেল বছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে আশানুরূপ ভালো করেছে দেশের রপ্তানি ও অভ্যন্তরীণ খাত। তবে তিন কারণে নতুন বছরের প্রথম প্রান্তিকে ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রবৃদ্ধির চলমান ধারা কিছুটা গতিহীন হবে বলে মনে করছেন শিল্পোদ্যোক্তারা।
কোভিড-১৯ মহামারীর প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের আস্থা ও প্রত্যাশার ওপরে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) উদ্যোগে পরিচালিত ত্রৈমাসিক জরিপের সপ্তম পর্যায়ে এমন ফলাফল উঠে এসেছে।
সোমবার জরিপের ফল তুলে ধরেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান।
দেশের আটটি বিভাগের ৩৮টি জেলার মোট ৫০২টি ক্ষুদ্র, ছোট, মাঝারি ও বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ওপর এই জরিপ করা হয়েছে।
কোভিড শুরুর পর থেকে ব্যবসায়িক আত্মবিশ্বাস নিয়ে সানেম মোট সাতটি জরিপ করেছে। উৎপাদন খাতের তৈরি পোশাক, টেক্সটাইল, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, ওষুধ প্রস্তুতকারক, হালকা প্রকৌশল ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের প্রতিষ্ঠানের ওপর এই জরিপ করা হয়েছে। সেবা খাতের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা, রেস্তোরাঁ, পরিবহন, আইসিটি, টেলিযোগাযোগ, আর্থিক খাত ও রিয়েল এস্টেট খাত জরিপের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের ৩ থেকে ২৪ তারিখের মধ্যে এই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত শীর্ষ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ফোনালাপের মাধ্যমে এই জরিপ করা হয়েছে।
মহামারি শুরু হওয়ার পর ব্যবসা-বাণিজ্যের আত্মবিশ্বাস নিয়ে মোট সাতটি জরিপ পরিচালনা করেছে সানেম। দেখা গেছে, যখন কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা একটু বেশি থাকে এবং নানা রকম বিধিনিষেধ থাকে, তখন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের আত্মবিশ্বাস কমে যায়। আবার যখন আক্রান্তের হার নিয়ন্ত্রণে (৫ শতাংশের নিচে) চলে আসে, তখন আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। বর্তমানে করোনাভাইরাসের ওমিক্রন ধরনের বাড়বাড়ন্তের কারণে ব্যবসায়ীদের আত্মবিশ্বাস কিছুটা নিচের দিকে।
জরিপে ৭১ শতাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বলেছে, ওমিক্রন সংক্রমণের প্রভাবে তাদের রপ্তানি বা বিক্রি কমেছে। ৭৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠান বলেছে, এ জন্য তাদের অতিরিক্ত স্বাস্থ্য-সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে এবং তাতে খরচ বাড়ছে। ৮২ শতাংশ বলেছে, ওমিক্রনের প্রভাবে সার্বিকভাবে পুঁজি ও শ্রমের খরচ বেড়েছে। রপ্তানি কমার ঝুঁকি বেড়েছে বলে জানিয়েছে ৮৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠান।
কোভিডের নতুন ধরন ওমিক্রনের কারণে ভাইরাস সংক্রমণের বিস্তার, জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়া এবং বিশ্ববাজারের নেতিবাচক ধারাকে প্রবৃদ্ধির পথে প্রতিবন্ধকতার তিন কারণ হিসেবে জরিপে উল্লেখ করেছেন ব্যবসায়ীরা।
জরিপে দেখা যায়, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও ওমিক্রন সংক্রমণের ফলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকাণ্ডে নানা নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও সার্বিকভাবে গত অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ব্যবসায় উন্নতি হয়েছে।
তবে কোভিডের নতুন ধাক্কার কারণে সামনের তিন মাসে (জানুয়ারি থেকে মার্চ) প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা তুলনামূলক কম।
জরিপে বাংলাদেশের সার্বিক ব্যবসা পরিস্থিতির ওপর জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি এবং ওমিক্রন ঢেউয়ের প্রভাব নিয়েও ব্যবসায়ীদের মতামত জানতে চাওয়া হয়।
এতে দেখা যায়, আগের বছরের তুলনায় অন্যান্য খাতের চেয়ে তৈরি পোশাক খাত, বস্ত্র, রেস্তোরাঁ, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও ঔষধ শিল্পের ব্যবসায় পুনরূদ্ধার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়েছে।
তবে চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রত্যাশা আগের চেয়ে কমেছে। বিশেষ করে টেক্সটাইল, ওষুধ শিল্প ও বিপণনখাত বছরের বছরের শুরুতে খুব বেশি ভালো করতে পারবে বলে আশা করছে না।
সপ্তম পর্যায়ের জরিপে ১৭ শতাংশ প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, তাদের মতে দেশের অর্থনৈতিক পুনরূদ্ধার জোরদার হয়েছে। যদিও ষষ্ঠ পর্যায়ে এমন মত দিয়েছিল ২১ শতাংশ।
অপরদিকে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার মোটামুটি বলে মনে করে ৪৪ শতাংশ, যেটি আগের পর্যায়ে ছিল ৫২%।
জ্বালানির দাম বৃদ্ধি এবং করোনাভাইরাসের নতুন ধাক্কার পরও প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসার ৬০.৬% (গড়) পুনরুদ্ধার হয়েছে, যা আগের জরিপে ছিল ৫৭.৪% (মার্চ ২০২১-এর ফলাফল)।
এর আগে অক্টোবর মাসে পরিচালিত একই জরিপে দেখা গেছে, পুনরুদ্ধার শক্তিশালী হচ্ছে মনে করত ২১ শতাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং দুর্বল হচ্ছে মনে করত ২৭ শতাংশ আর মধ্যম মানের হচ্ছে মনে করত ৫২ শতাংশ। অর্থাৎ, অক্টোবর মাসের তুলনায় এখন ১২ শতাংশ বেশি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান মনে করছে, পুনরুদ্ধারের প্রকৃতি দুর্বল।
যখন কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা একটু বেশি থাকে এবং নানা রকম বিধিনিষেধ থাকে, তখন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের আত্মবিশ্বাস কমে যায়। আবার যখন আক্রান্তের হার নিয়ন্ত্রণে (৫ শতাংশের নিচে) চলে আসে, তখন আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। বর্তমানে করোনাভাইরাসের ওমিক্রন ধরনের বাড়বাড়ন্তের কারণে ব্যবসায়ীদের আত্মবিশ্বাস কিছুটা নিচের দিকে।
জরিপে জানা গেছে, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এবং করোনার নতুন ধাক্কা সত্ত্বেও ব্যবসা পুনরুদ্ধারের হার গড়ে ৬০ দশমিক ৬ শতাংশ। তবে ২০২১ সালের জুন মাসের পর যে হারে পুনরুদ্ধার হচ্ছিল, এখন তার গতি কিছুটা কম।
জরিপের একটি বড় অংশ ছিল কোভিড মোকাবিলায় ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের কার্যকারিতা নিয়ে। বলা হয়েছে, জরিপ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৭৪ শতাংশ প্রণোদনা পায়নি—পেয়েছে মাত্র ২৩ শতাংশ। প্রণোদনা পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা পুনরুদ্ধারের হার ৭১ শতাংশ, আর প্রণোদনা না পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনরুদ্ধারের হার ৫৮ শতাংশ।
অন্যদিকে যে প্রতিষ্ঠানগুলো প্রণোদনা পেয়েছে, তাদের মধ্যে ৪০ শতাংশ জানিয়েছে, এই প্যাকেজ তাদের জন্য যথেষ্ট নয়। ৬৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, সরকারের পক্ষ থেকে আরও সাহায্য দরকার। সরকারের পক্ষ থেকে কী ধরনের সহায়তা দরকার—এমন প্রশ্নের জবাবে প্রতিষ্ঠানগুলো বলেছে, স্বল্প সুদে কার্যকরী পুঁজির ঋণ, রপ্তানিকারকদের জন্য শিপমেন্ট-পূর্ববর্তী পুনঃ অর্থায়ন সুবিধা ও শ্রমিকদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি।
জরিপে দেখা গেছে, ৯ শতাংশের মতো ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান প্রণোদনা ঋণ পেয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রণোদনা পাওয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকার কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে সেলিম রায়হান বলেন, বড় ও সংগঠিত খাতের সংগঠন শক্তিশালী। তারা সরকারের সঙ্গে দর-কষাকষি করতে পারে। সে জন্য সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে তারা এগিয়ে থাকে। সংগঠিত হওয়া নিশ্চয়ই খারাপ কিছু নয়, তবে অন্যায়ভাবে প্রভাব বিস্তার করা সমর্থনযোগ্য নয়। তিনি আরও বলেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাত অতটা সংগঠিত নয় বলে সুযোগ-সুবিধা আদায়ে পিছিয়ে থাকে—এটাই রাজনৈতিক-অর্থনীতি।
কোভিডের শুরুতেই সরকার বড় প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। তার আকারও নিতান্ত তুচ্ছ নয়—জিডিপির ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। সেখানে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের জন্যও পৃথক ব্যবস্থা রাখা হয়। কিন্তু সেটা বিতরণ করা যাচ্ছে না। ব্যাংক যে কাগজপত্র চায়, সেটা তারা অনেক ক্ষেত্রেই দিতে পারে না। সেখানে কিন্তু বড় বা সংগঠিত খাতের সংগঠনগুলো বাগড়া দিতে আসেনি।
সেলিম রায়হান মনে করেন, এ ক্ষেত্রে সরকারের বিশেষ উদ্যোগ থাকা দরকার হলেও সে রকম কিছু দেখা যায়নি। তবে উন্নত দেশগুলোর ক্ষুদ্র-মাঝারি ও অসংগঠিত খাত সরকারের অনেক সমর্থন পেয়েছে।
জরিপের উত্তরের ওপর ভিত্তি করে সানেম তিনটি সূচকের মাধ্যমে তাদের গবেষণাপত্রটি উপস্থাপন করেছে- প্রেজেন্ট বিজনেস স্ট্যাটাস ইনডেক্স বা পিবিএসআই (বার্ষিক), প্রেজেন্ট বিজনেস স্ট্যাটাস ইনডেক্স বা পিবিএসআই (ত্রৈমাসিক) এবং বিজনেস কনফিডেন্স ইনডেক্স বা পিবিআই (পরবর্তী তিন মাস)।
দেখা যায়, পিবিএসআই (বার্ষিক) সূচকের মান ৫৬.৭৯ থেকে ৬০ এ উন্নীত হয়েছে। একইভাবে পিবিএসআই (ত্রৈমাসিক)-এও ৫২ পয়েন্ট থেকে বেড়ে ৫৪ পয়েন্টে উন্নীত হয়েছে।
গেল বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সার্বিকভাবে ইবিআই সূচকে কিছুটা পতন হলেও, জরিপে দেখা যায় এই সূচকে বর্তমানে উন্নতি হয়েছে এবং গত সাত পর্যায়ের জরিপে এই সূচকে সর্বোচ্চ মান দেখা গেছে। অর্থাৎ ব্যবসার পরিবেশে গত দুই বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ উন্নতি হয়েছে।
তবে ইবিআই সূচকের কিছু কিছু উপাদান যেমন কর, দুর্নীতি, দক্ষ শ্রমশক্তি, যানবাহনের মান, বাণিজ্য কাঠামো এবং কোভিড ব্যবস্থাপনায় কিছু অবনতি দেখা গিয়েছে। এছাড়া, চামড়া, পাইকারী ও আবাসন খাতে ইবিআইয়ে কিছু অবনতি হয়েছে।
এক প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি একটি উদ্বেগজনক ইস্যু।
ওমিক্রণের কারণে রপ্তানি কমার ঝুঁকি বেড়েছে বলে জানিয়েছে ৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠান। ৯০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, ওমিক্রনের জন্য অতিরিক্ত স্বাস্থ্য-সতর্কতামূলক ব্যবস্থা এবং সে সংক্রান্ত খরচ বাড়ার ঝুঁকি বেড়েছে।
জরিপে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবটিও উঠে এসেছে। ৯৭ শতাংশ প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, এ কারণে যানবাহনের খরচ বেড়েছে এবং ৭৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে তাদের উৎপাদনের খরচ বেড়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮০১
আপনার মতামত জানানঃ