বিভিন্ন সমাজে নারী নিগ্রহের আরেক হাতিয়ার হচ্ছে ‘ডাইনি’ অপবাদ। সাধারণত অনুন্নত, গ্রামীন ও আদিবাসী সমাজের নারীদের ওপরই এ জাতীয় অপরাধ ঘটনাগুলো বেশি দেখা যায়। তথাকথিত এসব ‘ডাইনি’ নারীদের ওপর চলে সীমাহীন নির্যাতন এবং অনেক সময় পিটিয়ে মেরে ফেলা হয় তাদেরকে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে নিত্যদিনই এসব ডাইনিদের শায়েস্তা করার ঘটনা ঘটতে দেখা যায়।
ভারতের মধ্য, পূর্ব ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ডাইনি অপবাদে নারীদের পিটিয়ে বা কুপিয়ে হত্যা করা হচ্ছে৷ পুলিশ-প্রশাসন, সরকার এ ধরনের কুসংস্কার প্রতিরোধে কড়া পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ৷ তাই সংখ্যাটা বাড়ছে৷
ভারত আধুনিক হচ্ছে, হরহামেশাই সে দাবি শোনা যায়। কিন্তু সেখানে এখনো চলছে ডাইনি অপবাদে হত্যা। শুধু একটি রাজ্যেই ২২ বছরে হত্যা করা হয়েছে সহস্রাধিক লোকজনকে, যাদের সিংহভাগই নারী। এমনকি এ বছরের প্রথম মাসেই এভাবে হত্যার শিকার হয়েছে পাঁচজন।
ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইডির রিপোর্টে বলা হয়েছে, ঝাড়খণ্ড রাজ্যে গত ২২ বছরে ডাইনি অপবাদে এক হাজারেরও বেশি মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। গত সাত বছর ধরে প্রতি বছর গড়ে ডাইনি অপবাদে খুনের ঘটনা ৩৫টি। ২০২২ সালের প্রথম মাসে এমন কুসংস্কারের কারণে আক্রান্ত হয়েছে পাঁচজন, যাদের মধ্যে চারজনের মৃত্যু হয়েছে।
সিআইডির রিপোর্টে বলা হয়, একবিংশ শতাব্দীতে এসেও রাজ্যে রাজ্যে ডাইনি অপবাদে পিটিয়ে খুন বা মারধরের অভিযোগ শোনা যায় প্রায়ই। এক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে ঝাড়খণ্ড। ২০০০ সালে বিহার থেকে পৃথক হয়ে স্বতন্ত্র রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ঝাড়খণ্ড। ২০২১ সালে শুধু এই অংশেই ২৪ জন এমন কুসংস্কারের শিকার হয়েছেন।
ডাইনির অপবাদ দিয়ে নারী হত্যার ঘটনা সমানে ঘটে চলেছে ভারতে। পুলিশ-প্রশাসন এবং সরকারের নিষ্ক্রিয়তায় দিনে দিনেই সংখ্যাটা বেড়ে চলেছে৷
গত ২ জানুয়ারি ঝাড়খণ্ডের গুমলা জেলার লুকিয়া গ্রামে এক নারীকে ডাইনি অপবাদে মারধর করেন স্থানীয়রা। মৃত্যু হয় তার। মাকে রক্ষা করতে ছুটে যান অজয় ও সঞ্জয় ওঁরাও নামে দুই ছেলে। রক্ষা পাননি তারাও। তাদের দড়ি দিয়ে বেঁধে চলে নির্মম নির্যাতন। দুই ভাই গুরুতর আহত হন। এখন অজয়ের চোখ নষ্ট হওয়ার পথে। এ ঘটনায় পুলিশ যে অভিযোগ দায়ের করে সেখানে মূল অভিযুক্তের তালিকায় রয়েছেন স্বয়ং পঞ্চায়েত প্রধান। সবমিলিয়ে ১০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছে পুলিশ।
ভারত আধুনিক হচ্ছে, হরহামেশাই সে দাবি শোনা যায়। কিন্তু সেখানে এখনো চলছে ডাইনি অপবাদে হত্যা। শুধু একটি রাজ্যেই ২২ বছরে হত্যা করা হয়েছে সহস্রাধিক লোকজনকে, যাদের সিংহভাগই নারী। এমনকি এ বছরের প্রথম মাসেই এভাবে হত্যার শিকার হয়েছে পাঁচজন।
২০২২ সালের ৫ জানুয়ারি খুনতি জেলার অদকি থানার তিরলা গ্রামে এক যুগলকে পিটিয়ে হত্যা করেন প্রতিবেশীরা। অভিযোগ, তারা ‘কালাজাদু’ জানতেন। যদিও পাঁচ দিন পর এ খবর প্রকাশ্যে আসে।
১২ জানুয়ারি। আবারও ডাইনি সন্দেহে মারধরের ঘটনা ঘটে ঝাড়খণ্ড রাজ্যে। থেতাই থানার কুড়পানি গ্রামে এক নারীকে ডাইনি অপবাদে মারধর করা হয়। অভিযুক্তের ভাষ্য অনুযায়ী, ঝড়িয়ো নামে এক প্রতিবেশীর ‘কুনজর’-এ অকালে মারা যান তার স্ত্রী। এখনও রাঁচির এক হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন ওই নারী।
২৭ জানুয়ারি। ডাইনি সন্দেহে আবারও একটি হত্যার ঘটনা ঝাড়খণ্ডে। খুনের বীভৎসতা চমকে দেওয়ার মতো। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ওই নারীকে হত্যার পর গাড়িতে তার দেহ লুকিয়ে রাখেন অভিযুক্তরা। তারপর গাড়িটিকে খুনতি থানা এলাকার একটি নির্জন জঙ্গলে ফেলে রাখেন চার অভিযুক্ত।
এই হত্যার ঘটনায় মূল অভিযুক্ত পেশায় নার্স। পুলিশি জেরায় সালোমি মিজ নামে ওই নার্স জানান, হঠাৎ তার ছেলের মৃত্যু হয়। নার্সের সন্দেহ, নোরা লকড়া নামে তার ভাড়াটে ডাকিনী বিদ্যা করে তার ছেলেকে মেরে ফেলেছেন।
২০২০ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। গুমলা জেলায় পাঁচ জনকে ধারাল অস্ত্র দিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠে আট জনের বিরুদ্ধে। সেখানেও কারণ সেই এক-ডাইনি অপবাদ। তার আগের দুই মাসে তিন জন এই কুসংস্কারের বলি হন।
ঝাড়খণ্ড পুলিশের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত সাত বছর ধরে প্রতি বছর গড়ে ডাইনি সন্দেহে খুনের ঘটনা ঘটে ৩৫টি।
সিআইডির প্রতিবেদন বলছে, ২০১৫ সালে ডাইনি সন্দেহে ৪৬ জন নারীকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ২০১৬ সালে ৩৯, ২০১৭ সালে ৪২, ২০১৮ সালে ২৫, ২০১৯ সালে ২৭ এবং ২০২০ সালে ২৮ জন এই কুসংস্কারের বলি হয়েছেন। ২০২১ সালের পুরো তালিকা এখনও আসেনি। তবে পুলিশের খাতায় এমন ২৪টি খুনের মামলা হয়েছে। গত সাত বছরে ঝাড়খণ্ডে ২৩০ জনের মৃত্যুর কারণ হলো ডাইনি অপবাদ। গত ২২ বছরে সংখ্যাটা এক হাজারের বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব হামলার পেছনে কুসংস্কার ও অন্ধ-বিশ্বাস কাজ করে। তবে কখনো কখনো সম্পত্তির জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে ডাকিনীবিদ্যা চর্চার অভিযোগ এনে বিধবাদের হত্যা করার মতো ঘটনাও ঘটে।
‘ডাইনি অপবাদে’ হত্যা প্রতিরোধে ভারতে জাতীয় স্তরে কোনও পৃথক ও সুনির্দিষ্ট আইন নেই। একই সঙ্গে এই ধরনের অপরাধগুলো দলবদ্ধভাবে হওয়ার কারণে উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ জোগাড় করাও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ফলে অপরাধীরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে; শাস্তি তো অনেক দূরের বিষয়। ফলে ভারতে যুগের পর যুগ ধরে অবলীলায় চলে আসছে এসব হত্যাযজ্ঞ। অনেক সময় ব্যক্তিগত প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যও সমাজের ক্ষমতাবানরা নারী ও প্রতিপক্ষকে ‘ডাইনি’ অপবাদ দিয়ে পরাস্থ করে থাকে।
এর প্রতিকার হিসাবে বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ভারতীয় অর্থনীতির সুফল দেশের প্রান্তিক আদিবাসী অঞ্চলে পৌঁছায়নি৷ পিতৃতন্ত্র, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, প্রশাসনের উপেক্ষা এবং সামাজিক সচেতনতার অভাবের মিলিত কারণ এই ডাইনি অপবাদ৷ তাই প্রতিকারের জন্য দরকার লিঙ্গ বৈষম্য দূর করা, তৃণমূল স্তর থেকে নীতি প্রণয়ন, প্রচার অভিযান জোরদার করা, শিক্ষা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করা এবং সর্বোপরি, কড়া আইন প্রণয়ন করা৷
সারা বিশ্ব যখন মানবাধিকার বিশেষ করে নারী অধিকার রক্ষায় সোচ্চার তখন ভারতের মতো উদার গণতান্ত্রিক দেশে এভাবে অসহায় নারীদের ওপর চালানো বর্বরতা রোধে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার তড়িৎ পদক্ষেপ নিবে সেটাই কামনা সবার।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫৮
আপনার মতামত জানানঃ