সম্প্রতি জাপানের জাতীয় পুলিশ এজেন্সি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর দেশে শিশু নির্যাতনের ২ হাজার ১৭০টি ঘটনা তদন্ত করে পুলিশ। আগের বছরের তুলনায় শিশু নির্যাতনের হার ১ দশমিক ৭ শতাংশ বেড়েছে।
তবে শিশুদের অধিকার ও বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি কয়েকটি সংগঠনের দাবি, পুলিশ এজেন্সির প্রতিবেদনে প্রকৃত সত্য উঠে আসেনি। সংগঠনগুলো বলছে, শিশু নির্যাতনের প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি।
পুলিশের তদন্ত করা ঘটনার বাইরেও দেশের শিশুকল্যাণ কেন্দ্রগুলোতে নির্যাতিত শিশুদের বহু অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই সংখ্যা ২০২১ সালে রেকর্ডসংখ্যক বেড়ে ১ লাখ ৮ হাজার ৫০টিতে দাঁড়িয়েছে। আগের বছরের চেয়ে অভিযোগ ১ শতাংশ বেশি। এ ছাড়া টানা দুই বছর ধরেই শিশু নির্যাতনের অভিযোগ এক লাখ ছাড়িয়েছে।
কেন এমন হচ্ছে, তার কারণ খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছেন দেশটির সমাজবিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, শারীরিক অসুস্থতা ছাড়াও করোনা মহামারির নেতিবাচক দিকগুলো মানুষের জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলেছে। এর মধ্যে রয়েছে আয় কমে যাওয়া, চাকরি নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণে নাগরিকদের ওপর মানসিক চাপ বৃদ্ধি। এসব কারণে শিশুদের ওপর নিপীড়নের পাশাপাশি বেড়েছে পারিবারিক সহিংসতাও। জাতীয় পুলিশ এজেন্সির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরে ৮৩ হাজার ৩৫টি পারিবারিক সহিসংতার ঘটনা ঘটেছে।
কিছুদিন আগে এক মাস বয়সী কন্যাশিশুর মাথায় আঘাত করে হত্যার অভিযোগে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ বলছে, অনেক ব্যক্তি কর্মস্থল থেকে ঘরে ফিরে ঘুমানোর সময় শিশুর কান্নাকাটি সইতে না পেরে প্রায়ই ছোট্ট শিশুকে আঘাত করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেই এসব ঘটনা প্রকাশ্যে আসে। জাপানে এ রকম শিশু নির্যাতনকে বলা হয় ‘পাপা মিশিরি’, যার অর্থ দাঁড়ায় বাবার বিরক্তি।
অপর দিকে ক্ষেত্র বিশেষে মায়েদের বিরুদ্ধেও শিশুর ওপর নির্যাতন চালানোর অভিযোগ পাওয়া যায়। গত সপ্তাহে পশ্চিম জাপানের তাকামৎসু শহরে ৩ মাস বয়সী পুত্র সন্তানকে মারধর করার অভিযোগে ২৩ বছর বয়সী এক নারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ পুলিশকে তিনি বলেছেন, কান্না থামাচ্ছিল না বলে শিশুটির মাথায় আঘাত করেন। একপর্যায়ে শিশুটির নিশ্বাস নেওয়া বন্ধ হয়ে গেলে ওই মা নিজেই হাসপাতালে ফোন করে অ্যাম্বুলেন্সের জন্য অনুরোধ করেন। হাসপাতালে নেওয়ার পরে শিশুটিকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
তবে এসব ঘটনাকে স্বাভাবিক জীবনের অংশ হিসেবে ধরে নেওয়ার সুযোগ নেই বলে মনে করছেন অনেক সমাজবিজ্ঞানী। এর কারণ, জাপানে পারিবারিক বন্ধন বিশ্বের উন্নত অনেক দেশের তুলনায় অনেক দৃঢ়। এ কারণেই দুর্দিনের এসব ছোটখাটো ব্যতিক্রমী বিচ্যুতি করোনা বিদায় নিলে আর দেখা যাবে না, এমন প্রত্যাশা সবার।
শারীরিক অসুস্থতা ছাড়াও করোনা মহামারির নেতিবাচক দিকগুলো মানুষের জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলেছে। এর মধ্যে রয়েছে আয় কমে যাওয়া, চাকরি নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণে নাগরিকদের ওপর মানসিক চাপ বৃদ্ধি। এসব কারণে শিশুদের ওপর নিপীড়নের পাশাপাশি বেড়েছে পারিবারিক সহিংসতাও।
এদিকে মহামারি করোনা ভাইরাসের ভয়াল তাণ্ডবের মাঝেই পূর্ব এশিয়ার দেশ জাপানে শিশুদের মধ্যে আত্মহত্যার সংখ্যা রেকর্ড পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে শিশুদের আত্মহত্যার সংখ্যা এতোটাই বেড়েছে যে— গেল চার দশকের মধ্যে এটি সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। দেশটির শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাতে জাপানি গণমাধ্যম তথ্যটি জানিয়েছে।
জাপানে আত্মহত্যার হার এমনিতেই বেশি। করোনার কারণে শিশুদের মাঝেও বেড়েছে এই হার। দেশটির শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জরিপে দেখা যায়, করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালে স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে শিশু শ্রেণি থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ের ৪১৫ জন শিশু শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে।
জাপানের সংবাদমাধ্যম আশাহি এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, করোনা মহামারির মধ্যে আত্মহত্যা করা শিশু শিক্ষার্থীদের এই সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১০০ জন বেশি। ১৯৭৪ সাল থেকেও সর্বোচ্চ। ১৯৭৪ সাল থেকে জাপানে শিশু শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার রেকর্ড রাখা হয় দেশটিতে।
জরিপে দেখা যায়, ২০২০ শিক্ষাবর্ষে জাপানে এলিমেন্টারি থেকে হাইস্কুল পড়ুয়া অন্তত ৪১৫ শিক্ষার্থী নিজের প্রাণ নিয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ১০০ জন বেশি। এই শিক্ষাবর্ষে জাপানে এলিমেন্টারি স্কুলের সাতজন, জুনিয়র হাইস্কুলের ১০৩ জন ও সিনিয়র হাইস্কুলের ৩০৫ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে।
উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে জাপানে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি। কয়েক দশক ধরে তা নিয়ন্ত্রণে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কয়েক বছর ধরে সেগুলোর ইতিবাচক ফলাফলও লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক মহামারি দেশটিতে আত্মহত্যার যে চিত্র তুলে ধরেছে তাতে বিগত সব হিসেবে ওলট-পালট হয়ে গেছে।
রোগের মহামারিতে কেবল শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে না, মানসিক স্বাস্থ্য সংকটও সৃষ্টি হয়। করোনা মহামারির ফলে বিশ্বজুড়ে বেকারের সংখ্যা এবং মানসিক অসুস্থতা বেড়েছে। জাপানে বেড়েছে আত্মহত্যা। করোনার জন্য বিশ্বজুড়ে যা ঘটেছে জাপানেও অনুরূপ ঘটনা ঘটেছে।
জাপানে আত্মহত্যার কারণগুলো বেশ জটিল। সেখানে মানসিক চাপ বাড়ার কিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করা এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা অন্যতম। জাপানের মতো উন্নত পুঁজিবাদী দেশে যখন মানুষকে বেশি সময় ধরে কাজ করতে হয়, তখন বুঝতে হবে হয় সেখানে কাজ করার মানুষের ঘাটতি আছে, অথবা পুঁজিপতিরা দীর্ঘ সময় কাজ করাতে বাধ্য করে যাতে মুনাফা বেশি হয়।
বিশ্লেষকরা বলেন, লোকজন কোভিড-১৯ নিয়ে উদ্বিগ্ন। কিন্তু অনেক মানুষ তাদের কাজ হারিয়ে, আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কোনো আশা দেখছেন না, তারা আত্মহত্যা করছেন। জাপানে আত্মহত্যার উচ্চহারের নানা জটিল কারণ রয়েছে। এর মধ্যে দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, স্কুলের চাপ, সামাজিক বিচ্ছিন্নতার মতো নানা বিষয় রয়েছে। করোনার নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ও অর্থনীতির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে বলে মনে করেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১২৪২
আপনার মতামত জানানঃ