১৬৬৪ সালে সেই যে উজ্জ্বল ধূমকেতু দেখা গিয়েছিল, তার কয়েক মাসের মধ্যেই লন্ডনে শুরু হয় প্লেগ মহামারি। শহরে ৭০ হাজারের বেশি মানুষ মারা যান। ৬৪ সালেই লন্ডনে শোনা গেল, আমস্টারডাম ও রটারডামে প্লেগ শুরু হয়েছে। ৬৫-র শুরুতে রোগ এসে হাজির হল লন্ডনের দোরগোড়ায়। শুরুতে শহরের পাঁচিলের বাইরে গরিবদের বস্তিতে শুরু হলো মহামারি। রোজ কবরখানায় আগের চেয়ে বেশি মৃতদেহ সমাধি দেওয়া হতে লাগল। হেনরি ফো হিসেব রাখতেন, কবে কোন সমাধিক্ষেত্রে কত মড়া আনা হয়েছিল। তা থেকে আন্দাজ করা যেত, কীভাবে ছড়াচ্ছে প্লেগ।
প্লেগ রুখতে পৌরসভা জারি করেছিল লকডাউন। লন্ডন ভুতুড়ে শহরে পরিণত হয়েছিল। হাট-বাজার বন্ধ। ধনীরা আগেভাগে পালিয়ে গিয়েছে শহর ছেড়ে। প্রতিটি বাড়ির বাইরে তালা দিয়ে গিয়েছে পৌরসভার লোকজন। কেউ যাতে বাইরে বের হতে না পারে, সেজন্য ওই ব্যবস্থা। রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে ওয়াচম্যান।
বাড়ির ভেতর থেকে ভেসে আসত নারী ও শিশুদের আর্তনাদ। তার মানে সেই বাড়িতে হানা দিয়েছে প্লেগ। কেউ হয়ত মারা পড়েছে। কোনো কোনো বাড়ি একেবারে নিশ্চুপ। সেখানে সবাই মারা গিয়েছে।
শহরের ওয়াচম্যানরা রোজ প্রতিটি বাড়িতে উঁকি দিয়ে দেখত। কেউ মারা গিয়েছে জানলে ঘড়ঘড় শব্দে আসত মৃতদেহ বহন করার গাড়ি। কবরখানায় বিরাট বিরাট ট্রেঞ্চ খোঁড়া হয়েছিল। তাতে গাদা করে ফেলে দেওয়া হত মৃতদেহ। পৌরসভা নির্দেশ দিয়েছিল, প্রতিটি মরদেহ অন্তত মাটির ছয় ফুট নিচে কবর দিতে হবে। নইলে রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকবে।
একসময় মৃত্যুভয়ে মানুষ পাগল হয়ে উঠল। ভালোমন্দ বোধ লোপ পেল। অনেকে পৌরসভার পাহারাদারদের মেরেধরে বেরিয়ে এল রাস্তায়। এই সুযোগে ব্যবসা হলো প্রতারকদের। ভয়ে মানুষ বুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছে। তাদের ঠকানো তখন সবচেয়ে সোজা।
গোটা শহর প্লেগের নানা ‘ওষুধ’-এ ছেয়ে গেল। কেউ বেচতে লাগল পিল। কেউ বা বেচত ‘রহস্যময় দ্রবণ’। একদল লোক বলত, তারা ডাইনিবিদ্যার চর্চা করে এইসব ওষুধ শিখে এসেছে। ওষুধে আছে অল্প মাত্রার বিষ। সেই বিষ শরীরে প্রবেশ করলে পরে প্লেগের জীবাণু আর কিছু করতে পারবে না। শরীরে ঢোকা মাত্র মরে যাবে।
হাতুড়েরা শহরে রাস্তায় রাস্তায় লাগিয়ে দিল ওষুধের বিজ্ঞাপন। তাতে থাকত, ‘প্লেগের বিরুদ্ধে অব্যর্থ ওষুধ’, ‘বাতাসে ভাসমান জীবাণুর বিরুদ্ধে একমাত্র প্রতিষেধক’, ‘মহামারি প্রতিরোধী পিল’, ‘প্লেগ প্রতিরোধে পানীয়’, ‘প্লেগের চিরন্তন প্রতিষেধক’, ‘নির্ভেজাল প্লেগ ওয়াটার’ ইত্যাদি। প্লেগের ওষুধের এতরকম বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল যে, তা নিয়ে আলাদা একটা বই লেখা যায়।
বিজ্ঞাপনের সঙ্গে ছিল হ্যান্ডবিল। তার একটায় লেখা ছিল, ‘হল্যান্ড থেকে এসেছেন ধর্মান্তরিত চিকিৎসক। গত বছর আমস্টারডামে তিনি হাজারো প্লেগ রোগীকে সারিয়ে তুলেছেন।’ একটায় বলা হয়েছিল, ‘নাপোলি থেকে এসেছেন অভিজাত মহিলা চিকিৎসক। তিনি গুপ্তবিদ্যায় পারদর্শিনী। ইতালিতে যখন প্লেগে রোজ ২০ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছিল, তখন তিনি অনেকের জীবন বাঁচিয়েছেন।
অনেক প্রতারক পারদ বা ওই জাতীয় কোনো পদার্থ দিয়ে বানিয়েছিল মলম। সবাইকে বলত, সেই মলম গায়ে মেখে নিলে প্লেগ আর শরীরে ঢোকার পথ পাবে না।
একজন বড় বড় হরফে চারদিকে লিখেছিল, অমুক ডাক্তার বিনামূল্যে সবাইকে পরামর্শ দেন। সেই শুনে গরিবরা ভিড় করল তার চেম্বারে। তিনি অনেক ভালো উপদেশ দিলেন। প্লেগ থেকে বাঁচতে হলে কী কী ব্যায়াম করতে হবে বললেন। শেষে বললেন, ব্যায়ামের সঙ্গে খেতে হবে একরকম ওষুধ। তাহলে প্লেগ আর ছুঁতে পারবে না। এমনকি কেউ যদি প্লেগরোগীর সংস্পর্শে থাকে, তাহলেও তার কিছু হবে না। সেই ওষুধের এক শিশির দাম আধ ক্রাউন।
প্রচলিত আছে এক গল্প। ওই সময় এক গরিব মহিলা বললেন, ডাক্তারবাবু, আপনার যে বিনা পয়সায় চিকিৎসা করার কথা ছিল! ডাক্তার বললেন, আমার বিজ্ঞাপনটা ভালো করে পড়ে দেখ, লেখা আছে, বিনামূল্যে পরামর্শ দেওয়া হয়। ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ তো আমি বিনামূল্যেই দিলাম বাপু।
সেই মহিলা কপাল চাপড়ে বললেন, ‘হায় হায়! আগে যদি জানতাম আপনি এমন ফাঁদ পেতে রেখেছেন, তাহলে কি আসতাম। ফেরিওয়ালাও তো বিনা পয়সায় তার জিনিস কেনার পরামর্শ দিয়ে থাকে!’
এখন বিজ্ঞানের অনেক অগ্রগতি হয়েছে। দ্রুত ভ্যাকসিনও তৈরি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মানুষের স্বভাব বদলায়নি। ভুয়া প্রতিষেধক নিয়ে ফলাও ব্যবসা হচ্ছে এখনও।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭২৫
আপনার মতামত জানানঃ