পাঠক লাল গোলদার
গত বছরের কথা। প্রতিবেশির ভেড়া দেখতে গিয়েছিলাম। আমাদেরও ভেড়া পালনের ইচ্ছা, তাই এব্যাপারে জানতেই এক প্রতিবেশির বাড়িতে যাওয়া। ভদ্রমহিলা সবিনয়ে মাঠের দিকে দেখিয়ে দিলেন। বললেন, ভেড়া দেখে এলে তারপর ভেড়া পালন সংক্রান্ত বিভিন্ন ব্যাপারে কথা বলবেন। একটা ছোট টিলার ওপাশে ভেড়া চরে বেড়াচ্ছে, আমাকে সেখানেই যেতে হবে ভেড়া দেখতে। বিলের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে টিলাটার উপরে উঠতেই দেখলাম অনেকগুলো ভেড়া ঘাস খাচ্ছে। কয়েকটি ছোট বাচ্ছাও আছে। আমি আরো একটু এগুলাম ভেড়াগুলোর দিকে। আমার অবস্থান টের পেয়েই দেখি বাচ্চা ভেড়াগুলো দৌঁড় দিয়ে মা-ভেড়াগুলোর কাছে চলে গেলো! আমি তখনও আস্তে আস্তে ওদের দিকে আগাচ্ছি! এরপর দেখি সবকয়টি ভেড়া এক জায়গায় হয়ে গেলো। সব মিলিয়ে চল্লিশ-পঞ্চাশটি ভেড়া হবে হয়তো। কিন্তু একি? ভেড়াগুলো কি আমাকে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে? ওদের প্রস্তুতি দেখে বেশ ঘাবড়ে গেলাম! সাত-আটটা ভেড়া সামনে এক লাইনে দাঁড়িয়ে গেলো! বাকিগুলো এসে ওদের পেছনে গাদাগাদি করে দাঁড়ালো। সবার চোখ আমার দিকে। বড় বড় করে তাঁকাচ্ছে! যে বড় বড় ভেড়া, আমাকে যদি স্ব-দলবলে এ্যাটাক করে, বেঁচে ফেরা কঠিন হবে। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। বেশ ভয় হচ্ছে! চেষ্টা করছি দ্রুত কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার। পেছন ফিরে দৌড় লাগাবো না কি??
ইংরেজিতে একটা শব্দ আছে “শীপল” (Sheeple)। শীপ এবং পিপল-এর সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে এই শব্দটি। যে মানুষ ভেড়ার মতো আচরণ করে, ইংরেজিতে সেই মানুষদেরকেই শীপল বলা হয়। বিশেষ করে একজন মানুষ যখন কোন ব্যক্তি বা মতবাদকে অন্ধভাবে অনুসরণ করে, কোন চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই, সন্দেহাতীত বা প্রশ্নাতীতভাবে উক্ত ব্যক্তি বা মতবাদের নির্দেশনা মান্য করে বা অনুসরণ করে, তাদেরকেই শীপল বলা হয়। মানুষের মধ্যে বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের মধ্যে শীপলদের সংখ্যা এতো বেশি যে, আপনি একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই আপনার আশে-পাশে শীপলদের অতি-উপস্থিতি লক্ষ্য করতে পারবেন।
মোটাদাগে বাংলাদেশে দুই ধরণের শীপল-এর সংখ্যাধীক্য লক্ষ্য করা যায়। নাম্বার ওয়ান- ধর্মীয় শীপল এবং নাম্বার টু- রাজনৈতিক শীপল! ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক শীপল-এর মিশ্রণও চোখে পড়ার মতো। অর্থাৎ এক ব্যক্তি একই সাথে ধর্মীয় শীপল এবং রাজনৈতিক শীপল। তবে আপনি যদি নিজে শীপল হয়ে থাকেন তাহলে স্ব-জাতীয় শীপলদের উপস্থিতি টের না পাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে। তবে আশংকার কথা হচ্ছে, বিশ্বের অনেক দেশে শীপলদের সংখ্যা দিন দিন কমছে, আর বাংলাদেশে গত কয়েক দশক ধরে শীপলদের সংখ্যা বাড়ছে এবং বেশ দ্রুতগতীতে। শীপলদের সংখ্যা বৃদ্ধির এই গতি অব্যাহত থাকলে অদুর-ভবিষ্যতে বাংলাদেশ শীপলদের দেশে পরিণত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
ঘটনায় ফিরে আসি।
ভেড়াগুলো আমার দিকে চোখ পাকাচ্ছে। সিংওয়ালা ভেড়াগুলোর বেশিরভাগেরই বাঁকা শিং এবং শিংয়ের সুচালো অংশটা ঘুরে পিঠের দিকে বাঁকানো। কিন্তু সামনের সারির একটি ভেড়ার শিং অনেকটা গরুর শিংয়ের মতো একটু বাঁকিয়ে উপরের দিকে উঠে গেছে। ওই ভেড়াটাকেই বেশি ভয় হচ্ছে। এতবড়ো শিং দিয়ে একটা গুতা দিলেই তো আমার বারোটা বেজে যাবে। প্রতিবেশির ঘর থেকে বেশ দুরে চলে এসেছি। এখান থেকে খুব জোরে ডাক দিলে ভদ্রমহিলার ঘর পর্যন্ত পৌঁছালেও ঘরের ভীতরে আমার কন্ঠস্বর পৌঁছানোর কোন সম্ভাবনা নেই। অথএব যা করার আমাকেই করতে হবে।
আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করবো। আর ভেড়াগুলোও দাঁড়িয়ে আছে। আমি ভয়ে অনেকটা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। সময় কিছুতেই যেতে চায় না! কয়েক মিনিট পার হয়ে গেলো কিন্তু ভেড়াগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে আমার দিকেই চোখ পাকাচ্ছে। এরপর ঘটে গেলো এক অভূতপূর্ব ঘটনা! সামনের সারির ভেড়াগুলো থেকে একটা ভেড়া আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। হ্যা! একটা ভেড়া। বাকিগুলো দাঁড়িয়ে থাকলো। আমার ভয় বাড়তে লাগলো। এই ভেড়াটা এসেই কি আমাকে গুতা মারবে না কি? কিন্তু ভেড়াটা যেভাবে আমার দিকে আস্তে আস্তে আগাচ্ছে সেটা দেখে আমার কেনো যানি মনে হলো ও আক্রমণের জন্য নয়, আমার সাথে সন্ধি করতে আসছে। সিনেমায় দেখেছি যুদ্ধের ময়দানে সন্ধি করতে একটি সৈন্য ঘোড়ায় চড়ে সাদা পাতাকা নিয়ে প্রতিপক্ষের দিকে এগিয়ে যায়। আমার চোখের সামনে সেই রকম একটা ছবি ভেসে উঠলো। মনে মনে ভাবলাম আমি তো সন্ধি করতেই চাই, যুদ্ধ তো চাই না মোটেও। ততক্ষণে ভেড়াটি আমার বেশ কাছাকাছি চলে এসেছে। আমি আদর করে দেবো ভেবে হাত বাড়িয়ে দিলাম। ভেড়াটি গলা বাড়িয়ে আমার হাতটি নাক দিয়ে একটু শুকে নিলো। তারপর আরো একটু কাছে চলে এলো। আমি আস্তে আস্তে ওর গলার নিচে হাত নিয়ে চুলকানোর মতো করে একটু আদর করতে লাগলাম। তার তখনই দেখতে পেলাম অন্য সমস্ত ভেড়া আমার সামনে চলে আসছে। আমি এখন আর মোটেও ভয় পাচ্ছি না। আরো কয়েকটি ভেড়াকে আদর করে দিলাম।
ভেড়াদেরও নেতা থাকে। ভদ্রমহিলা বলছিলেন। আমি অনেকটা মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম প্রতিবেশি ভদ্রমহিলার কথা। তবে আমি আমাদের ভেড়ার পালের নেতা তৈরী করে দিয়েছি, বলে যাচ্ছিলেন ভদ্রমহিলা। ভেড়ার বাচ্চা জন্মের পরই নির্দিষ্ট করে এক বা একাধিক বাচ্চাকে বোতলে দুধ ভরে খাওয়াতে হয়। কয়েকদিন বোতলে করে দুধ খাওয়ালেই ও তোমাকে চিনে যাবে। আর যখনই তোমাকে ও দেখতে পাবে, ও দৌঁড়ে তোমার কাছে চলে আসবে দুধ খাওয়ার জন্য। আস্তে আস্তে তোমাকে ও বিশ্বাস করতে শিখবে এবং তোমার কাছ থেকে আদর প্রত্যাশা করবে। তারপর ও যখন একটু বড় হবে তখন থেকেই পালের অন্য ভেড়ারা ওকে নেতা মানতে শুরু করবে। যদি তুমি ভেড়ার পালকে অন্য কোন ক্ষেতে ঘাস খাওয়ানোর জন্য নিয়ে যেতে চাও, নেতাকে কাছে ডাকবে, একটু আদর করবে, আর তারপর যেখানে ওদেরকে নিয়ে যেতে চাও সেদিকে হাটা শুরু করবে। দেখবে ঐ নেতাভেড়াটার পিছনে পালের সমস্ত ভেড়া পড়িমরি করে দৌড়াচ্ছে। নেতাভেড়াটা যদি তোমার কথা শোনে তাহলে সব ভেড়াই তোমার কথা শুনবে। আর যদি তুমি নেতা তৈরী না করো তাহলে ওদেরকে কোথায়ও নিয়ে যাওয়া খুবই কঠিন কাজ।
কফির মগে চুমুক দিয়ে ভদ্রমহিলা আবার বলতে শুরু করলেন! আমার ভেড়ার পালে সাতটি নেতাভেড়া আছে। তবে প্রয়োজন মতো ওরাই নিজেদের মধ্যে বড়নেতা, ছোটনেতা তৈরী করে নেয়। অনেকটা আমাদের মন্ত্রীপরিষদের মতো। নিজেরাই কেউ মন্ত্রী হয়, কেউ প্রতিমন্ত্রী। আর একটা কথা এখানে বলা খুবই দরকার, ভেড়ারা নেতাদের একেবারেই অন্ধভাবে অনুসরণ করে। এমনও উদাহরণ আছে যে, ভেড়া জবাই করার জন্য কসাই নেতাভেড়াকে সবার আগে হাঁড়িকাঠে দেয়। আর তারপর অন্য ভেড়ারা হাঁড়িকাঠে যাওয়ার জন্য লাইল লাগায়। কসাই একটা ভেড়া হত্যা করে, অন্যটা এসে নিজেই হাঁড়িকাঠে মাথা ঢুকিয়ে দেয়। এরচেয়ে ভয়ংকর নেতৃত্ব অনুসরণ কোন প্রাণীর মধ্যেই হয়তো নেই। ভেড়াদের অন্ধভক্তির আর একটা বহুল প্রচলিত উদাহরণ আছে। ভেড়ার পাল পাহাড়ের উপর চরে বেড়াচ্ছিল। হঠাৎ পালের একটি নেতাভেড়া পা পিছলে পাহাড়ের খাদে পড়ে যায়। অনেক উঁচু পাহাড়। ওখান থেকে খাদে পড়লে ভেড়াদের বেঁচে থাকার কোন সম্ভাবনাই নেই। কিন্তু ভেড়ারা নেতাদের এমন অন্ধভাবে অনুসরণ করে যে, পরিনামটা একেবারেই চিন্তা করে না। একে একে ওই পালের সব ভেড়াই পাহাড়ের উপর থেকে ঝাঁপ দিয়ে মারা যায়।
শীপল শব্দটাও আমি ওই ভদ্রমহিলার কাছ থেকেই জেনেছি। তবে আমার চিন্তা অন্য জায়গায়! ভেড়ার ছোট্ট ব্রেন, ভেড়ারা নিজের, তাদের সমাজের লাভ-ক্ষতি, ভবিষ্যৎ হয়তো চিন্তা করতে পারে না। গবেষণা করে বা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে নিজেদের অবস্থা বদলাতে পারে না। কিন্তু মানুষ তো তা পারে। মানুষের ব্রেন তো অনেক বড়, প্রাণীজগতের সবচেয়ে বড়। মানুষ তো নিজের ভাল-মন্দ চিন্তা করতে পারে। নিজেই নিজের প্রতিটা পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। নিজের ব্রেনকে কাজে লাগিয়ে মানুষ অন্যের মতামত, চিন্তা বা সিদ্ধান্তকে বিচার-বিশ্লেষণ করতে পারে। অন্যের চিন্তা, মতামত বা সিদ্ধান্ত মানুষ চ্যালেঞ্জ করতে পারে। ভিন্নমত পোষণ করতে পারে। কিন্ত তার পরেও কেনো মানুষ ধর্মীয় বা রাজনৈতিক নেতাদের অন্ধভাবে অনুসরণ করে?? ভেড়ার সাথে এই অন্ধভক্ত বা অন্ধভাবে অনুসরণকারীদের পার্থক্য কোথায়?? এই অন্ধ অনুসরণকারীরাই তো শীপল!!
এবার আপনার আশপাশে শীপলদের উপস্থিতি বোঝার চেষ্টা করুন! শীপলময় দুনিয়ায় যদি শীপলদের খুঁজে নিতে কষ্ট হয়, তাহলে…..!! তাহলে আপনার ব্রেনটিকে কাজে লাগান। চিন্তা করুন, গবেষণা করুন, প্রশ্ন করুন, প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা করুন! দেখতেই পারবেন আপনার চারপাশে শীপলদের উপস্থিতি!!
আপনার মতামত জানানঃ