পাঠক লাল গোলদার
মদ হারাম, কারণ ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশ – ঠিকাছে! কিন্তু হারাম জিনিসের আবার লাইসেন্স হয় ক্যামনে? মুসলমানদের জন্য কি শুকরের মাংসের লাইসেন্স হয়? বা হিন্দুদের জন্য গরুর মাংস খাওয়ার লাইসেন্স? আমিও জানি হয় না! তাহলে মদ খাওয়ার লাইসেন্স কিভাবে হয়? বোট ক্লাব, পার্টি ক্লাব… কত কত নামে টাকাওয়ালাদের মদ খাওয়া, নারী নিয়ে মাস্তি করার জায়গা আছে। অন্যদিকে কিছু গরীব মানুষও মদ খায়। বিশেষ করে পরিবহন শ্রমিকদের মধ্যে মদ খাওয়ার বেশ চল আছে জানি। অন্ধকারে নর্দমার পাশে বা দুই ট্রাকের চিপায় গিয়ে সুরা পানের কাজটি সারেন কেউ কেউ। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে টাকাওয়ালাদের মদ খাওয়া বৈধ, তাদের লাইসেন্স আছে আর পরিবহন শ্রমিকদের মদ খাওয়া অবৈধ, হারাম, লাইসেন্স দেয়া বা নেয়ার প্রশ্নই আসে না।
যারা ইনিয়ে বিনিয়ে বলার চেষ্টা করবেন যে, এটা আইন, দেশের প্রচলিত আইন…. তাদের জন্য বলি, একটু চারিদিকে তাকান। আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর দিকে দেখেন। ভারত, মায়ানমার, নেপাল, শ্রীলংকা কোন দেশেই মদ নিষিদ্ধ নয়। কারণ তারা ইসলামিক রাষ্ট্র নয়। কিন্তু পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে মদ নিষিদ্ধ। কারণ এই দুটো দেশ ইসলামিক দেশ। আমি যতদুর জানি, ইসলামিক দেশগুলো বাদ দিলে দুনিয়ায় আর একটিও দেশ নাই যেখানে মদ নিষিদ্ধ। সুতরাং বাংলাদেশে আইন করে যে মদ নিষিদ্ধ করা হয়েছে এটা পুরোপুরি ধর্মীয় কারণে। আর আমার প্রশ্নটা ওইখানেই। ধর্মীয়ভাবে যেটি নিষিদ্ধ, সেটার লাইসেন্স কিভাবে দেয়, আর লাইসেন্স দিলেই কিভাবে একটা হারাম খাবার বৈধ বা হালাল হয়ে যায়? অন্যভাবে বলা যায় যে, হালাল জিনিসের লাইসেন্স দেয়া কেন ধর্মবীরোধী নয় বা লাইসেন্স দেনেওয়ালারা কোন যুক্তিতে ধর্মবিরোধী নয়?
ধর্মীয়ভাবে যেটি নিষিদ্ধ, সেটার লাইসেন্স কিভাবে দেয়, আর লাইসেন্স দিলেই কিভাবে একটা হারাম খাবার বৈধ বা হালাল হয়ে যায়? অন্যভাবে বলা যায় যে, হালাল জিনিসের লাইসেন্স দেয়া কেন ধর্মবীরোধী নয় বা লাইসেন্স দেনেওয়ালারা কোন যুক্তিতে ধর্মবিরোধী নয়?
ঢাকাতে আমি অসংখ্য নেশাখোর দেখেছি। এই নেশাখোরদের বেশিরভাগই অভাবী মানুষ। হাতেগোনা কয়েকজন টাকাওয়ালা নেশাখোরও দেখেছি। কিন্তু মাতাল দেখিনি একজনও। কারণ নেশাখোররা মদের নেশা করে না। এরা সব ডাল খোর (ফেন্সিডিলকে ঢাকায় অনেকেই ডাল বলে), ইয়াবা খোর বা হেরোইনচি। টোকাই বাচ্চাদেরকে নিত্যই দেখেছি প্লাস্টিকের ঠোঙ্গায় এক ধরণের আঠালো পদার্থ নিয়ে বেলুনে ফু দেয়ার মতো করে ঠোঙ্গায় ফু দিয়ে দিয়ে নেশা করতে। কিন্তু একজনও মাতাল দেখিনি। তারমানে বাংলাদেশে যে মদের অভাব আছে তা কিন্তু মোটেও নয়! শুধু পরিবহন শ্রমিকরা কেনো, আরো অনেক শ্রেণী-পেশার মানুষ দেদারসে মদ খায়। তবে মাতাল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে না বা মদ্যপানের ঘোরে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে না। মোদ্দা কথা নেশাখোর বলতে আমরা যাদেরকে বুঝি তারা মদখোর নয়। মাদকাশক্তদের সংশোধনাগারে গেলেও একই অবস্থা। নেশাখোর পাবেন কিন্তু মাতাল পাবেন না।
আমি এখন অস্ট্রেলিয়াতে থাকি। এখানেও গত এক দশকে আমি অনেক নেশাখোর দেখেছি। কিন্তু মাতাল দেখিনি। মুদি দোকানের মতোই এখানে মদের দোকান আছে। আর কিছু কিছু মদ অনেক সস্তা, একেবারে পানির দামে না পেলেও প্রায় সেরকমই সস্তা। কিন্তু এখানেও নেশাখোররা অন্য কিছু খায়। শুনেছি আইস নামের একটি মাদক এখানের নেশাখোরদের কাছে ভীষণ প্রিয়।
মদ-নারী বেহেস্তী চিজ। টাকাওয়ালারা বেহেস্তে যেতে পারবে না, তাই ইহকালেই স্বর্গের সুখ ভোগে ব্যস্ত তারা। গরীবদের জন্য কিছু দিনের অপেক্ষা, তারপর বেহেস্তে গিয়ে হুরদের হাত ধরে মদের সাগরে দিবে ঝাঁপ!… এগুলো ধর্মীয় মছলা এবং সহজবোধ্য। তবে দুর্বোদ্ধ বিষয়টি সম্প্রতি বারবার সামনে চলে আসছে। সম্প্রতি কয়েকজন নারীকে ধরা হয়েছে। ‘রাতের রাণী’সহ নানান নামে মিডিয়া তাদেরকে পাবলিকের সামনে উপস্থাপন করছে। ডিজে পার্টি বা নাইট ক্লাবে নাচ এবং সাথে সুরা পানের কথা উঠছে। কিন্তু যারা ডিজে পার্টি বা নাইট ক্লাবে নাচ বা অন্য বিনোদনের কাজ করে বা যারা মদ পরিবেশন করে তারা তো ওখানকার শ্রমিক, অর্থ উপার্জনে তারা কাজ করছে। তাদেরকে কেন আমরা অপরাধী বানাচ্ছি?? ওইসব ডিজে পার্টির আয়োজক, নাইট ক্লাবের মালিক, মদের লাইসেন্সধারী ব্যবসায়ী, এমনকি মাদক চোরাচালানী… তাদের নাম মিডিয়া কেন বলছে না? তাদের বাসায় র্যাব-পুলিশ কেনো তল্লাসি করে না?? পরীমণি যখন বোট ক্লাবের এক নেতার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অভিযোগ করেছিলেন, বাধ্য হয়েই প্রশাসন ওই নেতার বিরুদ্ধে কিছু ব্যবস্থাও নিয়েছিলো, তখনই আমার মনে হয়েছিলো পরীমণি এক অসম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেন। দুই পক্ষের মধ্যে ক্ষমতার আসমান-জমিন ফারাক। শুধু সময়ের অপেক্ষা, পরীমণিকে ফাঁসতেই হবে। এখন তো বোট ক্লাবের নেতার ক্ষমতা দেখাই যাচ্ছে। ‘রাতের রাণী’রা বরাবরই বলীর পাঁঠা হবেন, হয়রানি, নির্যাতনের শিকার হবেন। কিন্তু ‘রাতের রাজা’ বা ‘রাতের মহারাজা’দের ক্ষমতা এতই বেশি যে তাদের ডিজে পার্টি, নাইট ক্লাব, বোট ক্লাব, তাদের মাদকের ব্যবসা, চোরাচালানীর ব্যবসা, মদ খাওয়ার লাইসেন্স সবই ঠিকঠাক থাকবে, সবই হালাল উপায়ে পরিচালিত হবে। সেসবে ধর্ম বা রাষ্ট্র, কেউই বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না।
একটা উদাহরণ দিয়েই শেষ করি…. প্রাক্তন সাংসদ বদীর ইয়াবা সাম্রাজ্যের কোন ক্ষতি হয়েছে বলে কিন্তু আজও জানা যায় নি। টেকনাফের পৌর কমিশনারকে যখন ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়েছিলো তখন ইয়াবা-বদীকে নিয়ে মিডিয়া তোলপাড় হয়েছিলো। ঘটনা পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ বদীকে আবারও এমপি নমিনেশন দেওয়ার ক্ষেত্রে বেশ শরমের মধ্যে পড়ে যায়। তখন বদীর বউকে নৌকার টিকিট দিয়ে এমপি বানানো হয়। পরীমণির ঘটনায় যেমন বোট ক্লাবের নেতা কিছুটা অপদস্ত হয়েছেন তেমনি বদীর এমপিগিরিরও কিছুটা ক্ষতি হয়েছিলো তখন। কিন্তু বদীর ইয়াবা সাম্রাজ্যের কি কোন ক্ষতি হয়েছে?? অন্যদিকে প্রতিবাদ করতে গিয়ে কমিশনার একরামুল পরপারে!!! টাকাওয়ালা আর ক্ষমতাওয়ালাদের কাছে মাদকের ব্যবসা আর মদ্যপান দুটোই লাইসেন্সড। তাদের কাছে হারাম বলে কিছু নেই। ওটা শুধুই সাধারণ মানুষের জন্য নির্ধারিত।
মতামত ও বিশ্লেষন বিভাগে প্রকাশিত সকল মতামত লেখকের নিজস্ব এবং এটি State Watch এর সম্পাদকীয় নীতির আদর্শগত অবস্থান ধরে নেওয়া ঠিক হবে না। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, স্টেটওয়াচ কর্তৃপক্ষের নয়।
আপনার মতামত জানানঃ