স্বামীর অবাধ্য হলে স্ত্রীকে স্বামী মারতে পারবে কিনা এবিষয়ে অনেক ধর্মপ্রাণের মনেই প্রশ্ন রয়েছে। তবে অধিকাংশ পুরুষই মনে করে স্ত্রী কথা না শুনলে তাকে মারার অধিকার স্বামীর রয়েছে। এবিষয়ে একমত পোষণ করে মাঠে ময়দানেও ওয়াজিরা বয়ান করে থাকেন। একইসাথে স্ত্রীজাতিকেও স্বামীর অবাধ্য না হওয়ার এক রকম হুঁশিয়ারিই দিয়ে রাখেন। স্ত্রী প্রহারে অধিকাংশ পুরুষ মত দিলেও কতোজন নারী এর সমর্থনে রয়েছে?
দেশব্যাপী নারীর প্রতি সহিংসতার ওপর করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, অশিক্ষিত বা স্বল্প শিক্ষিত নারীরা উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা নারীদের তুলনায় স্বামীর মারধরকে আড়াইগুণ বেশি মেনে নেন।
ইউনিসেফের অর্থায়নে দেশব্যাপী মাল্টিপল ইনডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে-২০১৯ ডাটাবেজের তথ্যের ভিত্তিতে করা গবেষণা নিবন্ধটি গত ৪ জানুয়ারি যুক্তরাজ্যের ‘বায়োমেড সেন্ট্রাল সাইক্যাট্রি’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
দেশের আটটি বিভাগ থেকে ১৩ হাজার ৩৩ জন শহুরে এবং ৫১ হাজার গ্রাম্য নারীর কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারীরাও এতে অন্তর্ভুক্ত ছিল। যাদের বয়স ছিল ১৫ থেকে ৩৯ বছর।
‘প্রিভ্যালেন্স অ্যান্ড ডিটারমিন্যান্টস অব ওয়াইফ-বিটিং ইন বাংলাদেশ: এভিডেন্স ফ্রম এ ন্যাশনওয়াইড সার্ভে’ শীর্ষক গবেষণায় প্রধান ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. মোয়াজ্জেম হোসেন।
গবেষণায় উঠে আসে, শহুরে ১৭ শতাংশ ও গ্রাম্য ২২ শতাংশ নারী স্বামীর সঙ্গে তর্ক করার কারণে স্বামীর হাতে মারধরের শিকার হন। এছাড়া সন্তানের প্রতি অবহেলার কারণে শহুরে ১৩ শতাংশ এবং গ্রাম্য ১৬ শতাংশ, যৌনমিলনে অসম্মতির কারণে শহুরে ৮ শতাংশ ও গ্রাম্য ১০ শতাংশ, স্বামীকে না বলে বাইরে যাওয়ার কারণে শহুরে ১০ শতাংশ ও গ্রাম্য ১৪ শতাংশ নারী মারধরের শিকার হন। তবে গ্রাম্য ৬.৮ শতাংশ ও শহুরে ৫.১ শতাংশ নারী বিশ্বাস করেন, রান্নার সময় খাবার পুড়ে গেলে স্বামীর মারধর করার অধিকার আছে।
গবেষণায় বলা হয়, স্ত্রীকে মারধর করা বিশ্বব্যাপী দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা একটি সমস্যা। এটি ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর সহিংসতার একটি স্বাভাবিক রূপ। এই সহিংসতার কারণ হিসেবে বিয়ের সময়কার বয়স, স্বামী-স্ত্রীর বয়সের পার্থক্য, বিবাহের ধরন, শিক্ষাগত যোগ্যতা, দারিদ্রতা, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যোগাযোগের ঘাটতি, মাদক গ্রহণ, গৃহস্থালির কাজকর্মে ধরন ইত্যাদি দায়ী।
দেশে ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর কাছ থেকে পাওয়া সহিংসতার কারণে নারীরা অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণ, অধিক গর্ভপাত ও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।
গবেষণায় দাবি করা হয়, গ্রাম্য নারীদের ২৫ শতাংশ ও ২০ শতাংশ শহুরে নারী কোনো না কোনোভাবে সহিংসতার শিকার। বয়স্কদের তুলনায় ৩০ বছরের কম বয়সী নারীদের মধ্যে কম সহিংসতা দেখা গেছে। গার্হস্থ্য সহিংসতার কারণে নারীরা অবাঞ্চিত গর্ভধারণ, গর্ভস্রাব, গর্ভপাত ও যৌনরোগ, প্ররোচিত গর্ভপাত, এইডস, মানসিক চাপ, আত্মহত্যা, ভীতি, স্ত্রীরোগ বিষয়ক সমস্যায় ভোগেন।
গবেষণা বলছে, খাবার পোড়ানো নিয়ে স্বামীর মারধরের অধিকার আছে—বিষয়টি মানতে নারাজ সন্তানহীন বা দুইটি সন্তান আছে এমন নারীরা। তবে বেশি সন্তান আছে এমন নারীরা সহজেই মেনে নেন। এক্ষেত্রে অশিক্ষিত বা স্বল্প শিক্ষিত নারীরা উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা নারীদের তুলনায় স্বামীর মারধরকে আড়াইগুণ বেশি মেনে নেন।
সিলেট বিভাগের শহুরে নারীদের চেয়ে রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিভাগের শহুরের নারীরা স্বামীর মারধরকে অনেকটা বৈধ মনে করে। তবে রংপুর ও খুলনা বিভাগের গ্রাম্য নারীরা স্বামীর মারধরকে বৈধ মনে করলেও সিলেটের গ্রাম্য নারীরা ঠিক উল্টো। বরিশাল বিভাগের নারীরা তুলনামূলক কম মাত্রায় স্বামীর মারধরকে মেনে নেন।
এ বিষয়ে নিবন্ধটির প্রধান গবেষক সহযোগী অধ্যাপক মো. মোয়াজ্জেম হোসেন জাগো নিউকে বলেন, ‘দ্বন্দ্ব-সংঘাত পারিবারিক জীবনেরই অংশ। ঘনিষ্ঠ সঙ্গীদের কাছে একে অপরের প্রত্যাশা অনেক বেশি থাকায় সামান্য উঁচুনিচুতেই অনেক সময় সেটি সহিংসতার রূপ নেয়। দাম্পত্যজীবনে সঙ্গীদের মধ্যে ছাড় দেওয়ার মানসিক কমে যাওয়ায় এ ঘটনাগুলো ঘটছে। পারস্পরিক বোঝাপড়াই এ সমস্যার সমাধান দিতে পারে।’
স্ত্রী নির্যাতনের পিছনে যে সকল কারণগুলো রয়েছে তার মধ্যে স্বামীর আদেশ অমান্য করা, সন্তানদের যত্ন না করা, স্বামীকে না বলে ঘরের বাইরে যাওয়া, ধর্মীয় আচার না মানা, স্বামীর পরকীয়ায় বাঁধা প্রদান, স্বামীর যৌন আগ্রহে সাড়া না দেয়া এবং স্বামীর সঙ্গে সাংসারিক ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়া।
অন্য একটি জরিপ থেকে জানা যায় যে, বাংলাদেশের বেশির ভাগ পুরুষই মনে করেন স্ত্রীকে মার দেওয়া যায়। গ্রামের ৮৯ শতাংশ পুরুষ মনে করেন স্ত্রী অন্যায় কিছু করলে স্বামীর মার দেওয়ার অধিকার আছে। এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই শহরের পুরুষেরাও, তাদের ক্ষেত্রে এ হার ৮৩ শতাংশ।
রিপোর্টে এ ছাড়াও রয়েছে, শহরের ৯৩ শতাংশ এবং গ্রামের ৯৮ শতাংশ পুরুষই বিশ্বাস করেন পুরুষ হতে হলে তাকে কঠোর হতেই হবে। আবার শহরের ৫০ শতাংশ এবং গ্রামের ৬৫ শতাংশ পুরুষ বিশ্বাস করেন, পরিবারকে রক্ষা করার জন্য নারীদের নির্যাতন সহ্য করা উচিত।
জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট এর এক জরিপে দেখা গেছে, স্ত্রী নির্যাতনের পিছনে যে সকল কারণগুলো রয়েছে তার মধ্যে স্বামীর আদেশ অমান্য করা, সন্তানদের যত্ন না করা, স্বামীকে না বলে ঘরের বাইরে যাওয়া, ধর্মীয় আচার না মানা, স্বামীর পরকীয়ায় বাঁধা প্রদান, স্বামীর যৌন আগ্রহে সাড়া না দেয়া এবং স্বামীর সঙ্গে সাংসারিক ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়া।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, স্বামী কর্তৃক শারিরীক আঘাত আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন যে কোন নারীর মনেই যেমন কঠিন অপমানবোধ সৃষ্টি করে তেমনি আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন কোনো পুরুষই তার স্ত্রীকে শারীরিক আঘাত করতে পারে না। সভ্য সমাজে এটা নিয়ে বোধ হয় তর্ক করার অবকাশ নেই। গবেষণার প্রাপ্ত তথ্য যে রীতিমত ভয়ংকর তা আরেকবার স্মরণ না করে উপায় নেই। এই গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যে শহর এবং গ্রামে নারী নির্যাতনের যে চিত্র এবং ভয়াবহতা তা রীতিমত ভদ্র সমাজের নির্লজ্ব মুখোসটাই যেন উন্মোচিত হয়েছে। তাই এই চিত্রটি সমাজ এবং সমাজের যে কোনো বিবেকবান মানুষের জন্যই যথেষ্ট আতঙ্ক ও শঙ্কিত হওয়ার কারণ রয়েছে। গবেষণায় যে তথ্য বের হয়ে আসছে তাতে মনে হয় বউ পেটানো প্রথা আমাদের সমাজে গভীরভাবে মিশে আছে এবং ভদ্র পোশাকের আড়ালে এমন ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটেই যাচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯২৬
আপনার মতামত জানানঃ