তাইওয়ান প্রণালিতে সামরিক তৎপরতা বাড়িয়েছে চীন। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে এটাই ছিল বিশ্ব গণমাধ্যমের শিরোনাম। কিন্তু হাজার হাজার মাইল পশ্চিমে চীনের আরেক সীমান্তে উত্তেজনা বাড়ছে। ধারণা করা হচ্ছে তাইওয়ানের আগে ওই সীমান্তেই বিরোধ উত্তপ্ত হয়ে ওঠার আশঙ্কা বেশি।
প্রায় ১৬ মাস আগে চীন ও ভারতের সেনারা প্রাণঘাতী এক সংঘর্ষে জড়ান। হিমালয়ের পাদদেশে দুর্গম এলাকায় দুই দেশের সীমানা বিভাজনকারী প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় (এলএসি) এই সংঘর্ষ কোনো অস্ত্র দিয়ে নয়, হয়েছিল পেশিশক্তি দিয়ে। পারমাণবিক ক্ষমতাধর দুই দেশের মধ্যে এই সীমান্ত বিতর্কিত এবং দুর্বলভাবে চিহ্নিত। এখন এটা নিয়ে উত্তেজনা আবার বাড়তে দেখা যাচ্ছে।
চীন সম্প্রতি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য অরুণাচল প্রদেশের ১৫টি স্থানের ‘নাম পরিবর্তন’ করেছে, যে অঞ্চলটিকে বেইজিং ‘দক্ষিণ তিব্বত’ বলে দাবি করে। রাষ্ট্র পরিচালিত গ্লোবাল টাইমস দৈনিকের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনের বেসামরিক বিষয়ক মন্ত্রণালয় ঘোষণা করেছে যে, তারা চীনা অক্ষর এবং তিব্বতি ও রোমান বর্ণমালায় জাংনান বা দক্ষিণ তিব্বতের ১৫টি স্থানের নাম ‘প্রমিত’ করেছে। খবর ভারতীয় গণমাধ্যম
জায়গাগুলোর মধ্যে আটটি আবাসিক এলাকা, চারটি পর্বত, দুটি নদী এবং একটি পর্বত গিরিপথ অন্তর্ভুক্ত ছিল।
আবাসিক স্থানগুলোর নামগুলো হল শানান প্রিফেকচারের কোনা কাউন্টির সেংকেজং এবং দাগ্লুংজং, মানিগ্যাং, নাইংচির মেডগ কাউন্টির ডুডিং এবং মিগপেইন, গোলিং, নাইংচির জায়ু কাউন্টির ডাম্বা এবং শানান প্রিফেকচারের লুঞ্জে কাউন্টির মেজাগ।
চারটি পর্বতের মধ্যে রয়েছে ওয়ামো রি, ডিউ রি, লুনঝুব রি এবং কুনমিংজিংজে ফেং এবং দুটি নদী হল জেনিওগমো হি এবং দুলাইন হে। মাউন্টেন পাস হল সে লা, কোনা কাউন্টিতে।
গ্লোবাল টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘স্টেট কাউন্সিল থেকে জারি করা ভৌগোলিক নামের প্রবিধান অনুসারে এ নামকরণ করা হয়েছে’।
বেইজিং-এর চায়না তিব্বতবিদ্যা গবেষণা কেন্দ্রের বিশেষজ্ঞ লিয়ান জিয়াংমিন বলেছেন, নামগুলোর আরো ‘প্রমিতকরণ’ আসতে চলেছে।
তিনি গ্লোবাল টাইমসকে বলেছেন যে, চীনের বেসামরিক বিষয়ক মন্ত্রণালয় একটি ‘বৈধ পদক্ষেপ’ নিয়েছে এবং এটি করা চীনের ‘সার্বভৌম অধিকার’। ‘এ অঞ্চলে আরো মানসম্মত স্থানের নাম ভবিষ্যতে ঘোষণা করা হবে’- বিশেষজ্ঞের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে।
তবে নয়াদিল্লি এর কঠোর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। বেইজিংয়ের এ পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা জানিয়ে ভারত বলেছে, অরুণাচল ভারতের প্রদেশ ছিল এবং থাকবে। নাম পরিবর্তন করে এ সত্য কখনো বদলে দেওয়া যাবে না।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি বলেছেন, ‘আমরা আগেও এমনটা দেখেছি। চীনের অরুণাচল প্রদেশের কোনো স্থানের নতুন নামকরণের ঘটনা এটাই প্রথম নয়; ২০১৭ সালের এপ্রিলেও চীন এভাবে অরুণাচল প্রদেশের কিছু স্থানের নতুন করে নামকরণ করেছিল।’
অরিন্দম বাগচি আরও বলেন, ‘অরুণাচল প্রদেশ ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল এবং থাকবে। অরুণাচলের নতুন নামকরণে সত্যটা বদলে যাবে না।’
চীন অরুণাচল প্রদেশের কিছু স্থানের নাম বদলে নিজেদের ভাষায় নামকরণ করেছে—সাংবাদিকেরা এ নিয়ে জানতে চাইলে অরিন্দম বাগচি এসব কথা বলেন।
তবে নয়াদিল্লি এর কঠোর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। বেইজিংয়ের এ পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা জানিয়ে ভারত বলেছে, অরুণাচল ভারতের প্রদেশ ছিল এবং থাকবে। নাম পরিবর্তন করে এ সত্য কখনো বদলে দেওয়া যাবে না।
চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত দৈনিক গ্লোবাল টাইমস এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হচ্ছে, চীনের বেসামরিক–বিষয়ক মন্ত্রণালয় গত বুধবার ঘোষণা দিয়ে জানায়, তারা চীনা অক্ষর, তিব্বতি ও রোমান বর্ণমালায় জাংনানের ১৫টি স্থানের মানসম্মত নাম দিয়েছে। জাংনান হলো অরুণাচল প্রদেশের চীনা নাম।
এ নিয়ে দ্বিতীয়বার অরুণাচল প্রদেশের বিভিন্ন স্থানের নামকরণ করল চীন। এর আগে ২০১৬ সালে প্রদেশটির ছয়টি স্থানের নতুন নামকরণ করেছিল বেইজিং।
গত বছরের অক্টোবর মাসে ভারতীয় সীমানায় ঢুকে পড়েছিল চীনের সেনা। অরুণাচল প্রদেশে। উত্তেজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ফ্ল্যাগ মিটিংয়ের পর সমস্যা মেটে। লাদাখ, উত্তরাখণ্ডের পর এবার অরুণাচল প্রদেশে ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢুকেছিল চীনের সেনা। সূত্র মতে, তারা অরুণাচলের তাওয়াংয়ের কাছে লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল (এলএসি) পেরিয়ে ভারতে ঢুকে পড়ে। প্রায় দুইশ চীনা সেনা ঢুকেছিল বলে ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রের খবর। চীনের সেনা একটি বাঙ্কার ভাঙার চেষ্টায় ছিল।
এর আগের বছর পাঁচ মেও লাদাখে দুই দেশের সেনার মধ্যে প্রবল সংঘর্ষ হয়। ভারতের অভিযোগ ছিল, চীনের সেনা ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢুকে পড়ে ও এলাকা দখল করে। আর চীন অভিযোগ করেছিল, ভারতীয় সেনা তাদের ভূখণ্ডে ঢুকে পড়েছে। ভারতের বেশ কিছু সেনার প্রাণ যায়। চীনের সেনাও মারা যায়। লাদাখের উত্তেজনা দীর্ঘদিন ধরে চলে। তারপর ছোটখাট সীমান্ত পার হওয়ার ঘটনা চলছেই।
সম্প্রতি বিশেষ করে পূর্ব লাদাখ ও ভুটান–তিব্বত লাগোয়া অরুণাচল সীমান্তে, যেখানে চীন ক্রমাগত ভারতীয় সেনাদের চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। আর এর কারণ চীনের সাম্প্রতিক কয়েকটি পদক্ষেপ। গত ২৩ অক্টোবর চীনের সংসদে নতুন স্থলসীমান্ত আইন পাস হওয়ার পর ভারত প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি নেয়। চীনের অভিসন্ধির প্রতি ভারতের সন্দিহান হওয়ার প্রথম লক্ষণ ছিল দোকলাম। ২০১৭ সালের জুনে চীন–ভুটান–ভারত সীমান্তের দোকলামকে কেন্দ্র করে চীনের তৎপরতার পর থেকে প্রতি বছরই চীন সংলগ্ন সীমান্ত নিয়ে ভারতকে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। দোকলামের পর ভারত–চীন সেনারা জড়িয়ে পরে পূর্ব লাদাখের গালওয়ানের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে। ২০২০ সালের সেই সংঘাতের পর বারবার সীমান্তে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে।
চীন কিছুদিন পরপর প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর বিভিন্ন এলাকায় নতুন নতুন দাবি জানিয়ে আসছে। অরুণাচল প্রদেশে ভারতীয় নেতাদের আসা যাওয়াকে কেন্দ্র করে আনুষ্ঠানিক আপত্তি জানিয়েছে দেশটি। সবচেয়ে বড় কথা, সেনাপর্যায়ে ১৩ দফা বৈঠক সত্ত্বেও পূর্ব লাদাখের বিবাদ অমীমাংসিত রেখেছে বেইজিং।
এই পরিস্থিতিতে সাম্প্রতিক দুটি ঘটনা উদ্বেগ বাড়িয়েছে। দুটি ঘটনাই ঘটেছে গত বছরের অক্টোবর মাসে। প্রথমটি মাসের মাঝামাঝি। এ সময় চীন ভুটানের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধ মীমাংসার জন্য সমঝোতা চুক্তি সই করে। ভারতের সঙ্গে ভুটানের নিরাপত্তাসংক্রান্ত চুক্তি রয়েছে। এখন ভুটানের সঙ্গে সীমান্ত চুক্তি করার মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয় যে, ভারতকে বাদ দিয়ে চীন এখন ভুটানের সঙ্গে সরাসরি সীমান্তসংক্রান্ত বিরোধ মিটিয়ে ফেলতে চাইছে।
এই চুক্তি সইয়ের ১৫ দিন না যেতে চীনা সংসদে পাস হয়েছে স্থলসীমান্ত আইন। এই আইন সীমান্তবর্তী এলাকায় চীনা লাল ফৌজকে প্রবল ক্ষমতাধর করে তুলবে। এই আইনের ফলে চীনা সেনাবাহিনী সীমান্তবর্তী এলাকায় সেনা অবকাঠামো উন্নয়ন ত্বরান্বিত করবে। প্রতিরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নতুন করে তৈরি করবে। সীমান্ত গ্রাম গড়ে তুলবে (তিব্বতে ইতিমধ্যেই ৬০০ এমন গ্রাম তৈরি হয়েছে) এবং সেই গ্রামবাসীদের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দেবে।
২০২০ সালে চীনা সেনাবাহিনীর সঙ্গে প্রাণঘাতী সংঘাতের পর সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদারের পদক্ষেপ নেয় ভারত। গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ওই সংঘাতে অন্তত ২০ ভারতীয় এবং চার চীনা সেনা নিহত হয়। দুই পক্ষের মধ্যে দফায় দফায় আলোচনা চললেও সীমান্ত উত্তেজনা এখনও নিরসন হয়নি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭২৮
আপনার মতামত জানানঃ