পাক-ভারত সমীকরণ বদলে গেছে ভারত-চীন সীমান্ত উত্তেজনায়। আর এর কারণ সাম্প্রতিক বৈশ্বিক ভূরাজনীতি। ভারতের প্রতিরক্ষা প্রস্তুতির বেশিরভাগ হয়ে উঠেছে চীনকেন্দ্রিক। সাম্প্রতিক পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন দূরপাল্লার আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (আইসিবিএম) অগ্নি–৫ এর ‘প্রকাশ্য সফল উৎক্ষেপণের ঘোষণার’ নেপথ্য কারণও হয়তো চীনকে সতর্ক করাই।
প্রসঙ্গত, চীনের সংসদে নতুন স্থলসীমান্ত আইন রূপায়ণের আনুষ্ঠানিক বিরোধিতা করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ভারত অগ্নি–৫ ক্ষেপণাস্ত্রের সফল উৎক্ষেপণের কথা ঘোষণা করে। পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন এই ক্ষেপণাস্ত্রের আওতায় রয়েছে চীনের ভূখণ্ড।
চীন-ভারত সীমান্ত দ্বন্দ্বের কারণ
চলতি মাসেই ভারতীয় সীমানায় ঢুকে পড়েছিল চীনের সেনা। অরুণাচল প্রদেশে। উত্তেজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ফ্ল্যাগ মিটিংয়ের পর সমস্যা মেটে। লাদাখ, উত্তরাখণ্ডের পর এবার অরুণাচল প্রদেশে ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢুকেছিল চীনের সেনা। সূত্র মতে, তারা অরুণাচলের তাওয়াংয়ের কাছে লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল (এলএসি) পেরিয়ে ভারতে ঢুকে পড়ে। প্রায় দুইশ চীনা সেনা ঢুকেছিল বলে ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রের খবর। চীনের সেনা একটি বাঙ্কার ভাঙার চেষ্টায় ছিল।
গত বছর পাঁচ মেও লাদাখে দুই দেশের সেনার মধ্যে প্রবল সংঘর্ষ হয়। ভারতের অভিযোগ ছিল, চীনের সেনা ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢুকে পড়ে ও এলাকা দখল করে। আর চীন অভিযোগ করেছিল, ভারতীয় সেনা তাদের ভূখণ্ডে ঢুকে পড়েছে। ভারতের বেশ কিছু সেনার প্রাণ যায়। চীনের সেনাও মারা যায়। লাদাখের উত্তেজনা দীর্ঘদিন ধরে চলে। তারপর ছোটখাট সীমান্ত পার হওয়ার ঘটনা চলছেই।
সম্প্রতি বিশেষ করে পূর্ব লাদাখ ও ভুটান–তিব্বত লাগোয়া অরুণাচল সীমান্তে, যেখানে চীন ক্রমাগত ভারতীয় সেনাদের চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। আর এর কারণ চীনের সাম্প্রতিক কয়েকটি পদক্ষেপ। গত ২৩ অক্টোবর চীনের সংসদে নতুন স্থলসীমান্ত আইন পাস হওয়ার পর ভারত প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি। চীনের অভিসন্ধির প্রতি ভারতের সন্দিহান হওয়ার প্রথম লক্ষণ ছিল দোকলাম। ২০১৭ সালের জুনে চীন–ভুটান–ভারত সীমান্তের দোকলামকে কেন্দ্র করে চীনের তৎপরতার পর থেকে প্রতি বছরই চীন সংলগ্ন সীমান্ত নিয়ে ভারতকে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। দোকলামের পর ভারত–চীন সেনারা জড়িয়ে পরে পূর্ব লাদাখের গালওয়ানের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে। ২০২০ সালের সেই সংঘাতের পর বারবার সীমান্তে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে।
চীন কিছুদিন পরপর প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর বিভিন্ন এলাকায় নতুন নতুন দাবি জানিয়ে আসছে। অরুণাচল প্রদেশে ভারতীয় নেতাদের আসা যাওয়াকে কেন্দ্র করে আনুষ্ঠানিক আপত্তি জানিয়েছে দেশটি। সবচেয়ে বড় কথা, সেনাপর্যায়ে ১৩ দফা বৈঠক সত্ত্বেও পূর্ব লাদাখের বিবাদ অমীমাংসিত রেখেছে বেইজিং।
এই পরিস্থিতিতে সাম্প্রতিক দুটি ঘটনা উদ্বেগ বাড়িয়েছে। দুটি ঘটনাই ঘটেছে চলতি অক্টোবর মাসে। প্রথমটি মাসের মাঝামাঝি। এ সময় চীন ভুটানের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধ মীমাংসার জন্য সমঝোতা চুক্তি সই করে। ভারতের সঙ্গে ভুটানের নিরাপত্তাসংক্রান্ত চুক্তি রয়েছে। এখন ভুটানের সঙ্গে সীমান্ত চুক্তি করার মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয় যে, ভারতকে বাদ দিয়ে চীন এখন ভুটানের সঙ্গে সরাসরি সীমান্তসংক্রান্ত বিরোধ মিটিয়ে ফেলতে চাইছে।
এই চুক্তি সইয়ের ১৫ দিন না যেতে চীনা সংসদে পাস হয়েছে স্থলসীমান্ত আইন। এই আইন সীমান্তবর্তী এলাকায় চীনা লাল ফৌজকে প্রবল ক্ষমতাধর করে তুলবে। এই আইনের ফলে চীনা সেনাবাহিনী সীমান্তবর্তী এলাকায় সেনা অবকাঠামো উন্নয়ন ত্বরান্বিত করবে। প্রতিরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নতুন করে তৈরি করবে। সীমান্ত গ্রাম গড়ে তুলবে (তিব্বতে ইতিমধ্যেই ৬০০ এমন গ্রাম তৈরি হয়েছে) এবং সেই গ্রামবাসীদের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দেবে।
ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা
ভারত এই আইন পাসের পর আপত্তি জানিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাতে কতটা কাজের কাজ হবে ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের তা জানা নেই। সদ্য প্রণীত এই স্থলসীমান্ত আইন অনুযায়ী কোনো কিছু করতে চীনকে নিষেধ করেছে ভারত। নতুন আইন অনুযায়ী সীমান্তে অবকাঠামো তৈরিসহ অন্যান্য কাজ হাতে নিলে একতরফাভাবে সীমান্ত পরিস্থিতি বদলে যাবে বলে মনে করছে ভারত। চীনের উদ্দেশ্যে ভারতের বার্তা, দুই দেশের সীমান্তের বহু অঞ্চল এখনো বিতর্কিত। এই অবস্থায় নতুন আইন অনুযায়ী কিছু করলে তা সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় ব্যাঘাত ঘটাবে।
এসব কারণে ভারতের প্রতিরক্ষা প্রস্তুতির বেশিরভাগ এখন উত্তরের প্রতিবেশীর দিকে। ফ্রান্স থেকে কেনা অত্যাধুনিক রাফায়েল যুদ্ধবিমানের সিংহভাগ পূর্ব ভারতে মোতায়েন করা হয়েছে। অরুণাচল প্রদেশের সীমান্তে মোতায়েন করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি চিনুক যুদ্ধ হেলিকপ্টার, অত্যাধুনিক কামান, উন্নতমানের এল–৭০ এয়ার ডিফেন্স ব্যবস্থা এবং সুপারসনিক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র। জোরদার করা হয়েছে নজরদারি ব্যবস্থা।
শীতে বরফ ঢাকা পাহাড়ে যুদ্ধ করার জন্য যে নতুন মাউন্টেন স্ট্রাইক কোর গড়া হয়েছিল, যুদ্ধ প্রস্তুতি প্রশিক্ষণ পর্ব শেষ করে তা এখন কাজ শুরু করে দিয়েছে। এক হাজার ৩৫০ কিলোমিটারের সীমান্তজুড়ে অবকাঠামো নির্মাণের কাজ জোরদার করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সেতু, সড়ক, সুরঙ্গ ও যুদ্ধোপযোগী বিমানঘাঁটি তৈরির কাজ।
এর আগে চলতি বছরের শুরুর দিকে লাদাখের চীন সীমান্তে প্রথম দফায় কে নাইন বজ্র সেলফ প্রপেলড হাউইৎজার রেজিমেন্ট পাঠায় ভারত। তখনকার একটি ভিডিও ক্লিপে দেখা যায়, লাদাখে পার্বত্য অঞ্চলের ওপর দিয়ে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে কে নাইন বজ্র। ওই ট্যাঙ্ক ৫০ কিলোমিটার দূরে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পারে। গুজরাতে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্পে ওই ট্যাঙ্কগুলি তৈরি করেছে লার্সেন অ্যান্ড টুব্রো।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
ইনস্টিটিউট অব ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালিসিসের (আইডিএসএ) গবেষক ও চীন বিশেষজ্ঞ জগন্নাথ পান্ডা বলেন, ‘ভারত সম্পর্কে চীন বরাবরই সতর্ক ও সজাগ। ইদানিং তা বেড়েছে। এশিয়ায় ভারত শুধু চীনের প্রবল প্রতিপক্ষই নয় বরং পশ্চিমা জোটের অন্যতম বড় শক্তি ভারত। বেইজিং মনে করে, কোয়াড–এর মূল লক্ষ্য চীনের অগ্রগতি প্রতিহত করা। আর ভারত এই জোটের অন্যতম সদস্য। চীন সরকার এটাও মনে করে যে, সদ্যগঠিত ত্রিদেশীয় কৌশলগত নিরাপত্তা জোট অকাস–এর আসল লক্ষ্য চীন। এসব কারণে ভারতকে চাপে রাখতে চাইছে চীন।’
এই বিষয়ে জগন্নাথ পান্ডা আরও বলেন, ‘ভারতের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত বিপদ পাকিস্তানের দিক থেকে যতটা তার চেয়েও অনেক বেশি চীনের দিক থেকে। সেই কারণেই এত প্রস্তুতি দিল্লির।;
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন, চীনের বর্তমান শাসকের সম্প্রসারণবাদী মনোভাব আগামী দিনে বিশ্বশান্তির পক্ষে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আগামী ১৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যে চীন একে একে তিনটি ক্ষেত্রে নিজেদের প্রাধান্য প্রশ্নাতীত করতে চাইছে। প্রথমেই তাদের নজরে রয়েছে তাইওয়ানের সংযুক্তি। ২০২৫ সালের মধ্যে এই লক্ষপূরণ তারা করে ফেলতে চায়। এরপর তাদের নজরে রয়েছে দক্ষিণ চীন সাগরের ছোট ছোট কিছু দ্বীপ, যেগুলো সামরিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। এসব দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ কিছুতেই ছাড়তে চায় না চীন। তৃতীয় লক্ষ্য, পূর্ব লাদাখের কিছু অংশের সঙ্গে গোটা অরুণাচল প্রদেশ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া।
এসডব্লিউ/এসএস/১১৪৫
আপনার মতামত জানানঃ