বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন, চোরা শিকার, আবাসস্থল ধ্বংসসহ নানা কারণে শৌর্য-বীর্যের প্রতীক বাঘের অস্তিত্ব বিশ্বজুড়েই হুমকির মুখে রয়েছে। এর মধ্যে সুন্দরবনসহ ভারতের আরও কিছু অংশে পাওয়া যাওয়া রাজকীয় বাঘদের অবস্থা সবচেয়ে করুণ। দেশটিতে চলতি বছরে নানা কারণে মারা গিয়েছে ১২৬টি বাঘ। কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা ‘জাতীয় ব্যাঘ্র সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ’ (এনটিসিএ) বৃহস্পতিবার এই পরিসংখ্যান দিয়ে জানিয়েছে, গত এক দশকে বাঘের বার্ষিক মৃত্যুর রেকর্ড গড়েছে ২০২১।
২০১২ সাল থেকে বাঘের মৃত্যু নিয়ে কাজ শুরু করে কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা ‘জাতীয় ব্যাঘ্র সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ’ (এনটিসিএ)। তাদের রেকর্ড থেকে দেখা যাচ্ছে, গত দশ বছরের মধ্যে সব থেকে বেশি বাঘের মৃত্যু হয়েছে চলতি বছরে। চলতি বছরে অর্থাৎ ২০২১ সালে ১২৬টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। গত বছর যে সংখ্যাটা ছিল ১০৬। অর্থাৎ চলতি বছরে গত বছরের তুলনায় আরও ২০টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে।
সরকারি পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, চোরাশিকার, সড়ক দুর্ঘটনা, লোকালয়ে ঢুকে পড়ে গণপিটুনিতে মৃত্যু, প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো নানা কারণের বলি হয়েছে জাতীয় পশু। এর মধ্যে চোরাশিকারিদের গুলি, ফাঁদ এবং বিষে মৃত্যু হয়েছে ৬০টি বাঘের। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এই রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে।
২০১২ সাল থেকে ভারতে বাঘের সংখ্যা এবং মৃত্যু সংক্রান্ত বার্ষিক রিপোর্ট প্রকাশ করে এনটিসিএ। তা থেকে জানা যাচ্ছে, ২০১৬ সালে ভারতে ১২১টি মৃত্যু হয়েছিল। এতদিন পর্যন্ত সেটিই ছিল সেটিই ছিল সর্বোচ্চ।
২০২১ সালে বাঘের মৃত্যুতে শীর্ষে রয়েছে দেশের ‘টাইগার স্টেট’ মধ্যপ্রদেশ। গত ১২ মাসে ওই রাজ্য হারিয়েছে ৪১টি বাঘ। এ ছাড়া মহারাষ্ট্রে ২৫, কর্নাটকে ১৫ এবং উত্তরপ্রদেশ থেকে ৯টি মৃত্যুর খবর নথিভুক্ত হয়েছে।
২০১৮ সালের সুমারিতে ভারতের জঙ্গলগুলিতে ২,৯৬৭টি বাঘের অস্তিত্ব নথিভুক্ত হয়েছে। ১২৬টি বাঘের মৃত্যু সত্ত্বেও চলতি বছর সেই সংখ্যা ৩,০০০ পেরিয়ে গিয়েছে বলে অনুমান বাব বিশেষজ্ঞদের একাংশের। প্রসঙ্গত, পৃথিবী জুড়ে প্রাকৃতিক পরিবেশ টিকে থাকা বাঘের ৭৫ শতাংশই রয়েছে ভারতের জঙ্গলগুলিতে।
গত দশ বছরের মধ্যে সব থেকে বেশি বাঘের মৃত্যু হয়েছে চলতি বছরে। চলতি বছরে অর্থাৎ ২০২১ সালে ১২৬টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। গত বছর যে সংখ্যাটা ছিল ১০৬। অর্থাৎ চলতি বছরে গত বছরের তুলনায় আরও ২০টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে।
ভারতের সরকারি সংস্থাটি ২০১২ সাল থেকে বাঘের মৃত্যু বিষয়ক প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতে ২০১৬ সালে এর আগের সর্বোচ্চ সংখ্যক ১২১টি বাঘের মৃত্যু হয়েছিল।
এদিকে ২০০৬ সালে ভারতে বাঘের সংখ্যা ছিল এক হাজার ৪১১টি। ২০১৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় দুই হাজার ৯৬৭-তে।
ভারতে বাঘের মৃত্যুর সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। জঙ্গলের অনেক জায়গা বেশি দুর্গম হওয়ার কারণে ক্যামেরার পর্যবেক্ষণের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বন্যপ্রাণী সংরক্ষণবিদ টাইমস অব ইন্ডিয়াকে জানিয়েছেন, ভারতে সামনের দিনগুলোতে বাঘ সংরক্ষণ ও এই প্রাণীগুলোকে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে।
তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক দু-তিন বছরে ভারতে বাঘের জন্মহার কিছুটা বেড়েছে— এটি সত্য, কিন্তু একই সঙ্গে ভারতে প্রতিদিন বনাঞ্চল কমে আসছে— সেটিও সত্য। বনাঞ্চল হ্রাসের এই হার যদি অব্যাহত থাকে, সেক্ষেত্রে অদূর ভবিষ্যতে খাদ্য ও আবাস সংকটের মুখে পড়বে ভারতের বাঘ।’
‘ফলে বাধ্য হয়ে তারা লোকালয়ে আসা শুরু করবে এবং মানুষের সঙ্গে বাঘের সংঘাত আরও তীব্র হয়ে উঠবে।’
সর্বশেষ ২০১৯ সালে ভারতের দিল্লিতে অনুষ্ঠিত বাঘসমৃদ্ধ ১৩টি দেশের সম্মেলন উপলক্ষে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেশের বাঘ সুরক্ষা কার্যক্রমের অগ্রগতির তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, বিশ্বে ৩ হাজার ৮৯০টি বাঘ রয়েছে। এর মধ্যে ভারত বাঘের সংখ্যা দেড় হাজার থেকে বাড়িয়ে ২ হাজার ২২৬টি করেছে। নেপাল ১০০টি থেকে বাড়িয়ে ১৯৮টি, ভুটান ৫০টি থেকে ১০৩টি করেছে। থাইল্যান্ড বাঘের সংখ্যা ৯০টি থেকে ১৮৯টি করেছে। আর চীনে বাঘের সংখ্যা সাতটি, লাওসে দুটি, ভিয়েতনামে পাঁচটিতে নেমে এসেছে। আর কম্বোডিয়া ও মিয়ানমারে বাঘ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
বাংলাদেশে ২০০৪ সালের পায়ের ছাপ গুনে করা জরিপে ৪৪০টি বাঘ থাকার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু ২০১৫ সালে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো ক্যামেরা ফাঁদের মাধ্যমে করা জরিপে বাঘের সংখ্যা বেরিয়ে আসে ১০৬টি। এরপর ২০১৮ সালে বাংলাদেশ আরেকটি শুমারি করে জানায়, বাঘের সংখ্যা ১১৪টি। ২০২১ সালে বাংলাদেশের আরেকটি জরিপ করার কথা থাকলেও তা এ বছর না–ও হতে পারে।
সংশ্নিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনের পার্শ্ববর্তী এলাকায় গড়ে তোলা শতাধিক ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান, ফুড সাইলো এবং বনের মধ্য দিয়ে চলাচল করা জাহাজের দূষণ বাঘের ক্ষতি করছে। গাছ কাটা, খাদ্য সংকট, বিষ দিয়ে মাছ ধরা ও অপরিকল্পিত পর্যটনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে বাঘের ওপর। এ ছাড়া লোকালয়ে চলে আসায় পিটিয়ে হত্যার পাশাপাশি রয়েছে পাচারের উদ্দেশ্যে বাঘ শিকার।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সংকট সমাধানে এখনই বাঘ শিকার রোধ করতে হবে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন এবং সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি রোধেও কাজ করতে হবে। সুন্দরবনের মতো এ রকম জায়গা বিশ্বের আর কোথাও নেই। তাই বাঘকে বাঁচাতে হলে সুন্দরবনের ইকোসিস্টেম সংরক্ষণ করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮১৪
আপনার মতামত জানানঃ