ডাচ উপকূলে সম্প্রতি পাওয়া গেছে এমন এক প্রাচীন রোমান দুর্গের সন্ধান যা ৪৩ খিস্টাব্দে ব্রিটেন দখলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল বলে মনে করা হচ্ছে।
গবেষণা থেকে জানা গেছে, হাজার হাজার সৈন্যের সমন্বয়ে গঠিত একটি রোমান সৈন্য দল আস্তানা গেড়েছিল আমস্টারডাম থেকে ২০ মাইল দূরে অবস্থিত ভেলসেন নগরীতে। রাইন নদীর উপনদী ওয়ের-আইজের তীরে ছিল তাদের সেনা ঘাঁটি।
প্রাচীন রোমান দুর্গটি অনুসন্ধানের পেছনে কাজ করছেন প্রত্নতাত্ত্বিক ডা. আর্হেন বসম্যান। তিনি জানান, ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রাপ্ত প্রমাণ ভেলসেন (লাতিন ভাষায় যার নাম ‘ফ্লেভাম’) শহরের দিকেই ইঙ্গিত করে।
রোমান সাম্রাজ্যের উত্তর দিকে এই দুর্গটি বানানো হয়েছিল ‘চওসি’ নামক একটি জার্মানিক আদিবাসী গোষ্ঠীকে দূরে রাখার জন্য। কারণ রোমানরা তখন ফ্রান্সের বুলগনা হয়ে ইংল্যান্ডের দক্ষিণ উপকূল জয় করার জন্য এগিয়ে আসছিলো।
৪০ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটানিয়া জয়ের লক্ষ্যে ডাচ উপকূলে এই সুরক্ষিত দুর্গটি তৈরি করেন রোমান সম্রাট ক্যালিগুলা (১২ খ্রিস্টাব্দ-৪১ খ্রিস্টাব্দ)। কিন্তু সে সময় তার এই স্বপ্ন তো সফল হয়নি, বরং তার উত্তরসূরি ক্লডিয়াস এখানে রাজত্ব করেন এবং ৪৩ খ্রিস্টাব্দে নিজ অভিযানে এই দুর্গটি ব্যবহার করেন।
প্রত্নতাত্ত্বিক বসম্যান বলেন, ‘আমরা নিশ্চিত যে ক্যালিগুলা নেদারল্যান্ডসে ছিলেন, কারণ অসংখ্য কাঠের ব্যারেলের উপরে সম্রাটের নামের আদ্যক্ষর খোদাই করা আছে। বোঝাই যাচ্ছে যে এগুলো রাজদরবার থেকেই এসেছে’।
‘ক্যালিগুলা এখানে এসেছিলেন মূলত ইংল্যান্ড বিজয়ের প্রস্তুতি নিতে। জুলিয়াস সিজারের মতোই সামরিক বিজয় চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ৪১ খ্রিস্টাব্দে ঘাতকের হাতে প্রাণ হারানোয় সেই কাজ আর সম্পন্ন করতে পারেননি তিনি। তাই ক্যালিগুলা যেখানে ইতি টেনেছিলেন, ৪৩ খ্রিস্টাব্দে ক্লডিয়াস সেখান থেকেই আরম্ভ করেছিলেন”, যোগ করেন বসম্যান।
আমরা নিশ্চিত যে ক্যালিগুলা নেদারল্যান্ডসে ছিলেন, কারণ অসংখ্য কাঠের ব্যারেলের উপরে সম্রাটের নামের আদ্যক্ষর খোদাই করা আছে। বোঝাই যাচ্ছে যে এগুলো রাজদরবার থেকেই এসেছে’।
ক্লডিয়াসের দখলদার বাহিনী সর্বপ্রথম ইংল্যান্ডের কেন্টে পা রাখে এবং ৪৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সম্রাটের মনে ব্রিটেনজুড়ে দাপিয়ে বেরানোর আত্মবিশ্বাস জাগে। পরবর্তী তিন বছরের মধ্যেই সম্পূর্ণ ব্রিটেনকে নিজেদের অধীনে নিয়ে নেয় রোমানরা।
বসম্যান বলেন, ‘প্রধান সৈন্যদল এসেছিল বুলগনা এবং কালাইস থেকে, কিন্তু উত্তর দিকের আক্রমণ সামাল দিয়েছিল ভেলসেনের এই দুর্গ। রোমান সাহিত্যেও এই জার্মানিক হুমকির কথা একাধিকবার উঠে এসেছে’।
ভেলসেন শহরে রোমান দুর্গের অস্তিত্ব ১৯৪৫ সালে প্রথম খুঁজে পায় স্কুলের শিশুরা। একটি পরিত্যক্ত জার্মান অ্যান্টি-ট্যাংক ট্রেঞ্চের ভেতরে রোমানদের ব্যবহৃত মাটির পাত্রের ভাঙা টুকরা আবিষ্কার করে তারা।
পঞ্চাশের দশকে নর্ডজিকানালের নিচে ভেলসারটানেল নির্মাণের সময় রোমান দুর্গ নিয়ে গবেষণা করা হয় এবং ষাট ও সত্তরের দশকে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজ চালানো হয়।
১৯৯৭ সালে বসম্যান রোমানদের ৩টি পরিখা, একটি দেয়াল এবং গেট আবিষ্কার করেন। সে সময় এই অংশটুকুই সংরক্ষণ করার সিদ্ধান্ত হলেও, পরবর্তীতে দেখা যায় রোমানদের কার্যক্রম এখানে আরও বিস্তৃত ছিল।
কয়েক শত মিটারের ব্যবধানে পাশাপাশি দুটি দুর্গ থাকায় কয়েক দশক ধরে গবেষকদের ধারণা ছিল, এগুলো দুর্গ নয়; বরং ক্যাস্টেলাম বা সামরিক ক্যাম্প।
কিন্তু চলতি বছরের নভেম্বরে গবেষকরা একটি নতুন তত্ত্ব দেন। তারা সব মিলিয়ে প্রায় ১১ হেক্টর জায়গা জুড়ে ক্যালিগুলার দুর্গের সীমানার দেখা পান।
বসম্যানের মতে, ১১ হেক্টর জায়গায় ৫০০০-৬০০০ সৈন্যের জায়গা হওয়া সম্ভব নয়, তাই ধারণা করা হচ্ছে দুর্গের শেষ সীমানা আরও বড় হতে পারে।
ভেলসেন ২ দুর্গটি ৪৭ খ্রিস্টাব্দে পরিত্যক্ত ঘোষণা করেন ক্লডিয়াস। অভ্যন্তরীণ কোন্দল বেড়ে যাওয়ায় এবং জার্মানিক আদিবাসী গোষ্ঠীর ক্রমাগত আক্রমণের মুখে রোমান সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকে এবং ৪১০ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটেনে রোমান শাসনের সমাপ্তি ঘটে।
ক্যালিগুলা সিজারের আসল নাম ছিল গায়াস জুলিয়াস সিজার জার্মানিকাস। কেউ তাকে রোমের ঐতিহাসিক সম্রাট জুলিয়াস সিজারের সাথে মিলিয়ে ভুল করে থাকেন। কারণ, জুলিয়াস সিজার ছিলেন ক্যালিগুলার মহা-মহা-পিতামহ। ১২ খ্রিস্টাব্দের ৩১ আগস্ট রোমের সিজার ক্লডিয়ান পরিবারের নতুন সদস্য হিসেবে জন্ম নেন গায়াস সিজার। এই গায়াস সিজার পরবর্তীতে ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম পাকাপাকিভাবে লিখিয়ে নেন রোমের ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত এবং অত্যাচারি শাসক হিসেবে। তার শাসনামলের পুরোটা সময় জুড়ে তিনি জনতার মাঝে ত্রাস সৃষ্টি করে শাসন করেছিলেন। ‘মগের মুল্লুক’ কথাটির বাস্তবিক পরিণতি হয়েছিল ক্যালিগুলার রোমে। তিনি ছিলেন তার পিতা মহান জার্মানিকাস এবং মাতা আগ্রিপিনার ছয় সন্তানের মাঝে তৃতীয়। তিনি যখন জন্ম নেন তখন রোমের সম্রাট ছিলেন তার মহা পিতামহ অগাস্টাস সিজার।
তার পিতা জার্মানিকাস ছিলেন রোমান সাম্রাজ্যের জনপ্রিয় সেনাপতি। তাকে রোমের সাধারণ জনগণ মনেপ্রাণে ভালোবাসতো। জার্মানিকাস রোমান সেনাবাহিনী নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে অভিযানে বের হতেন। তার সাথে থাকতেন তিন বছর বয়সী শিশু ক্যালিগুলা। ছোট বাচ্চারা যা দেখে, তাই অনুকরণ করতে ভালোবাসে। তাই কিশোর ক্যালিগুলাও সৈন্যদের দেখাদেখি পোশাক পরার বায়না ধরেছিলেন। জার্মানিকাস ছেলের বায়না মঞ্জুর করে তাকে পোশাক বানিয়ে দেন। পায়ে পরিয়ে দেন ‘ক্যালিগা’ নামক রোমান জুতা। ক্যালিগা পায়ে সৈন্যদের মাঝে ডানপিটে গায়াস সিজারের ছুটোছুটি ছিল বেশ পরিচিত দৃশ্য। এই ক্যালিগা থেকেই তাকে ধীরে ধীরে সবাই ক্যালিগুলা ডাকতে থাকে। যা পরবর্তীতে তার প্রচলিত ডাক নামে পরিণত হয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩২৩
আপনার মতামত জানানঃ