বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কয়ারে গণহত্যাকাণ্ডে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে একটি ভাস্কর্য ছিল হংকং বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। ‘পিলার অব শেম’। সেই ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
রাতভর কাজ করে নির্মাণশ্রমিকেরা তামার তৈরি ৮ মিটার উচ্চতার (২৬ ফুট) ভাস্কর্যটি উপড়ে ফেলেন। রাতেই প্লাস্টিকে মুড়িয়ে মূর্তিগুলো অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়। খবর বিবিসির।
১৯৮৯ সালে চীনা কর্তৃপক্ষের হাতে নিহত গণতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভকারীদের স্মরণে স্তূপকৃত লাশের মূর্তি দিয়ে ‘পিলার অব শেম’ নামের এই ভাস্কর্যটি তৈরি করা হয়।
গত অক্টোবরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ভাস্কর্যটি সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয় ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা গতকাল বুধবার সেটি উপড়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন।
ভাস্কর্যটি উপড়ে ফেলার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তারা প্লাস্টিকের শিট দিয়ে এলাকাটি ঘিরে রাখেন। সাংবাদিকেরা সেখানে যেতে চাইলে নিরাপত্তাকর্মীরা বাধা দেন এবং ভিডিও ফুটেজ ধারণ করা থেকে সাংবাদিকদের বিরত রাখার চেষ্টা করেন।
হংকং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, উপড়ে ফেলা ভাস্কর্যটি সংরক্ষণ করে রাখা হবে।
তিয়ানআনমেন স্কয়ারে বেইজিংয়ের চালানো সেই হত্যাযজ্ঞ নিয়ে হংকংয়ে যে কয়েকটি স্মারক অবশিষ্ট রয়েছে তার একটি এই শিল্পকর্ম। ভাস্কর্যটিতে কয়েক ডজন বাঁকানো দেহ ও ব্যথিত মুখ দেখা যায়।
১৯৮৯ সালের ৪ জুন তিয়েনআনমেন স্কয়ারে গণতন্ত্রের দাবিতে জড়ো হয়ে বিক্ষোভে শত শত ছাত্র-শ্রমিককে গুলি করে হত্যা করে চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট সরকার।
ওই ঘটনা নিয়ে এরপর কোনো রকম আলোচনা নিষিদ্ধ করে চীন। বেইজিং সম্প্রতি হংকংয়ে তার শাসনের বিরোধিতাকারীদের দমনের পদক্ষেপ নিয়েছে।
ডেনমার্কের ভাস্কর জেনস গ্যালশিওটের ‘দ্য পিলার অব শেম’ নামের এ ভাস্কর্যটি গত দুই যুগ ধরে হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণে প্রদর্শন করে রাখা হয়েছে।
ভাস্কর্য অপসারণকে ‘সত্যিকারের নৃশংস’ ঘটনা হিসেবে অভিহিত করে গ্যালশিওট এটি উপড়ে ফেলার ঘটনাকে ‘সমাধির পাথর ধ্বংসের’ সঙ্গে তুলনা করেছেন।
বিবিসির নিউজ আওয়ার প্রোগ্রামে তিনি বলেন, ‘১৯৮৯ সালে বেইজিংয়ে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে এটি মৃত ব্যক্তিদের নিয়ে তৈরি একটি ভাস্কর্য। সুতরাং আপনি যখন এটিকে এভাবে ধ্বংস করবেন, তখন এটা একটা কবরস্থানে গিয়ে সবগুলো কবরের পাথরফলক ধ্বংস করার মতোই একটি বিষয়।’
কী ঘটেছিল ১৯৮৯ সালের ওই দিন?
১৯৮৯ সালের এপ্রিল থেকে সরকারের দুর্নীতি বন্ধ ও গণতন্ত্রের দাবিতে শিক্ষার্থীরা ঐতিহাসিক তিয়েনআনমেন স্কয়ারে অনশন শুরু করে। তার সঙ্গে যোগ দেন শ্রমিকেরা। বিক্ষোভকারীরা মাও সেতুংয়ের ছবির সামনে গণতন্ত্রের দেবীর মূর্তি খাড়া করে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় ক্ষমতাসীন সরকারকে।
৩ জুন রাতে সেনা ও ট্যাংক নামায় সরকার। ৪ জুন মধ্যরাতে তারা সব দিক থেকে ঘিরে ফেলে তিয়েনআনমেন। বেয়নেট হাতে সেনাদের সামনে সার বেঁধে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীরা তিয়েনআনমেন স্কয়ার ত্যাগ করে। তবে স্কয়ারের বাইরে সেনাদের নির্বিচার গুলিতে ততক্ষণে নিহত হন শত শত ছাত্র-শ্রমিক।
তিয়েনআনমেনের গণহত্যার কোনো সরকারি পরিসংখ্যান এখন পর্যন্ত প্রকাশ করেনি চীন। তবে প্রত্যক্ষদর্শী, মানবাধিকার সংস্থা ও গবেষকদের মতে, তিয়েনআনমেনে সেদিন হাজারের ওপর লোককে হত্যা করেছিল সেনারা। এ নিয়ে চীনা সরকারের কেউই এর আগে কখনো মুখ খোলেননি।
বিক্ষোভ নস্যাৎ করার পর সরকার বিক্ষোভকারী ও তাদের সহায়তাকারীদের গণহারে গ্রেফতার করতে থাকে। বিদেশী সাংবাদিকদেরকে তাদের দেশে ফেরত পাঠান ও ঘরোয়া গণমাধ্যমে এ বিষয়ে লেখার উপর কর্তৃত্ব আরোপ করেন।
পুলিশ ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাহিনীকে আরও শক্তিশালী করা হয়। বিক্ষোভকারীদের প্রতি কোনরূপ নমনীয়তা প্রদর্শন করা হয়নি।
গ্লোবাল টাইমস আরও বলেছে, ১৯৮৯ সালে তিয়েনআনমেনের ঘটনাই চীনের সঙ্গে অন্য সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর পার্থক্য গড়ে দিয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুগোস্লাভিয়া যেখানে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়েছে, চীন অখণ্ডতা ধরে রেখে উন্নতি করেছে।
চীনের ভিন্নমতাবলম্বী, পশ্চিমা রাজনীতিক ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো কী বলল, তা চীনের তেমন কিছু যায় আসে না। কারণ চীনা সমাজের ওপর এর প্রভাব খুবই নগণ্য।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৪৫
আপনার মতামত জানানঃ