বুড়িয়ে যাওয়াকে ভয় পান না এমন কি কেউ নেই। আসলে আমরা ভয় পাই বৃদ্ধ বয়সের কর্মতৎপরতায় শিথিলতাকে। দৈনন্দিন কাজে পরনির্ভরশীলতা, শরীরের কলকবজা দুর্বল হয়ে যাওয়ার কারণে চিকিৎসক, হাসপাতালের শরণাপন্ন হওয়া, মৃত্যুভয়, কপালে, গলায় চামড়ার ভাঁজ, সাদা চুল, আশপাশের লোকজনের অবজ্ঞা আর অবহেলা; এসব নিয়ে নানা আশঙ্কা। আর এটা যখন মনে গেঁথে বসে তখনই ভয়, উদ্বেগ, আড়ষ্টভাব দেখা দেয়। সেই সঙ্গে মানসিক রোগের আশঙ্কাও বেড়ে যায়।
এবার টিকা দিয়ে সারানো যাবে বয়সজনিত নানা ধরনের জটিল রোগ। বার্ধক্যের দিকে এগিয়ে চলার গতিতে টিকা এ বার লাগাম পরাতে পারবে বলে জানাচ্ছেন গবেষকরা। ইঁদুরের উপর একটি টিকার সফল পরীক্ষা সেই সম্ভাবনারই দরজা খুলে দিয়েছে। খবর ইউরো নিউজ, আনন্দবাজার পত্রিকা।
বিশেষজ্ঞদের একাংশ বলছেন, ‘মানুষের উপর সফল হলে এই টিকা একটি নতুন দিগন্ত খুলে দেবে। যার জন্য মানুষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সভ্যতা আধুনিক হয়ে ওঠার আগে থেকেই।’ আমেরিকার ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব এজিং (এনআইএ)’-এর বিজ্ঞানীদের ইঁদুরের উপর চালানো পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা ‘নেচার এজিং’-এ। গত ১০ ডিসেম্বর।
গবেষণাপত্রটি জানিয়েছে, পরীক্ষায় সফল টিকাটি ইঁদুরের শরীর থেকে বুড়ো, অথর্ব হয়ে পড়া কোষগুলোকে সরিয়ে দিতে পেরেছে। তার ফলে, ইঁদুরের আয়ু বেড়েছে। তাদের বার্ধক্যজনিত অনেক রোগ পুরোপুরি সেরেও গিয়েছে।
মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অন দ্য বায়োলজি অব এজিং অ্যান্ড মেটাবলিজমের সহকারী অধিকর্তা অধ্যাপক পল রবিন্স বলেছেন, ‘অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য গবেষণা। গবেষকরা যে পথ ধরে এগিয়েছেন তাতে তাত্ত্বিকভাবে এই টিকার পরীক্ষা মানুষের উপরেও সফল হওয়া উচিত। তবে মানুষের আগে আরও কয়েকটি স্তন্যপায়ীর উপর এই পরীক্ষা চালিয়ে দেখা উচিত’।
টিকা দিয়ে সারানো যাবে বয়সজনিত নানা ধরনের জটিল রোগ। বার্ধক্যের দিকে এগিয়ে চলার গতিতে টিকা এ বার লাগাম পরাতে পারবে বলে জানাচ্ছেন গবেষকরা।
এনআইএ জানিয়েছে, সেনেসেন্ট কোষ। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অত্যধিক চাপে বা অন্য কোনও ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ফলে এই কোষগুলির স্থিতিস্থাপকতা (‘ইলাস্টিসিটি’) পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। তখন কোষগুলির আর বিভাজন হয় না। কিন্তু তারা মরেও যায় না। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই সেনসেন্ট কোষের সংখ্যা বাড়তে থাকে। দেহে জমতে থাকে দ্রুত। এই কোষগুলোর ‘পাহাড়’ সরানো তখন অসম্ভব হয়ে পড়ে দেহের স্বাভাবিক প্রতিরোধ ব্যবস্থার কোষগুলির পক্ষে।
জমতে জমতে শুধুই যে পাহাড় হয়ে ওঠে তা-ই নয়। এই সেনেসেন্ট কোষগুলি থেকে এক ধরনের যৌগের ক্ষরণ হয়। যা নানা ধরনের প্রদাহ (‘ইনফ্ল্যামেশন’) সৃষ্টি করে। তার ফলে, সেনেসেন্ট কোষগুলির আশপাশে থাকা সুস্থ সবল কোষগুলির প্রচুর ক্ষতি হয়। এর আগে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে, শরীরে এই সেনেসেন্ট কোষগুলির বাড়-বৃদ্ধির জন্যই ক্যানসার, অ্যালঝাইমার্স এবং স্ক্লেরোসিসের মতো বার্ধক্যজনিত নানা জটিল রোগের সূত্রপাত হয়। ধমনীতে রক্ত চলাচল থমকে যায় সামনে বাধার দেয়াল (‘আর্টারি প্লেক্স’) তৈরি হয়ে যাওয়ায়। এগুলি সারানো আর সম্ভব হয় না।
সেনেসেন্ট কোষগুলিকে সরানোর জন্য নানা ধরনের ওষুধ আবিষ্কারের চেষ্টা গত এক দশক ধরেই চলছে। তাদের কোনও কোনওটি এখন হিউম্যান ট্রায়ালে রয়েছে।
রবিন্স বলেছেন, ‘তবে ওই সব ওষুধের চেয়ে টিকার কার্যকারিতা অনেক বেশি হবে বলেই আশা করছি। কারণ, ওষুধ তো ব্যবহৃত হবে দেহে সেনেসেন্ট কোষ জমতে জমতে পাহাড়ে পরিণত হওয়ার পর। তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। দেহের সুস্থ কোষগুলির ততক্ষণে অনেকটাই ক্ষতি হয়ে গিয়েছে। আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে প্রতিরোধ ব্যবস্থার কোষগুলিও। কিন্তু ৫০ বছর বয়স হলেই যদি এই টিকা দেওয়া সম্ভব হয়, তা হলে শরীরে এই সেনেসেন্ট কোষ গড়েই উঠতে পারবে না। জমতে জমতে পাহাড় হয়ে ওঠা তো অনেক দূরের কথা। টিকা দিয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থার কোষগুলিকে এমন ভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া যাবে যাতে সেনেসেন্ট কোষ তৈরি হচ্ছে দেখলেই তারা তাদের নিকেশ করে দিতে পারে’।
কিন্তু সমস্যাটা অন্যত্র। এই সেনেসেন্ট কোষগুলি দেহের সর্বত্রই তৈরি হয়। এক জায়গার সেনেসেন্ট কোষের সঙ্গে দেহের অন্য জায়গার সেনেসেন্ট কোষের আচার-আচরণে মিলও থাকে না। গবেষকরা একটি বিশেষ ধরনের সেনেসেন্ট কোষের উপর নজর রেখেছিলেন। যেগুলি তৈরি হয় ধমনী, শিরা ও রক্তজালিকার একেবারে ভিতরের দিকে থাকা এন্ডোথেলিয়াল কোষগুলিতে। এগুলিকে বলা হয়— সেনেসেন্ট ভাসক্যুলার এন্ডোথেলিয়াল কোষ।
তার পর তারা খুঁজে বার করেন সেই কোষগুলির উপরের স্তরে কোন প্রোটিনটিকে বেশি পরিমাণে দেখা যাচ্ছে। কারণ, গবেষকরা চেয়েছিলেন সেই প্রোটিনটিকেই তাদের বানানো টিকার লক্ষ্যবস্তু করতে। গবেষকরা তেমন একটি প্রোটিন খুঁজে পান। যার নাম— ‘গ্লাইকোপ্রোটিন ননমেটাস্ট্যাটিক মেলানোমা প্রোটিন বি ’ (জিপিএনএমবি)। বার্ধক্যজনিত বেশ কয়েকটি জটিল রোগ, মেলানোমা-সহ কয়েক ধরনের ক্যানসারের ক্ষেত্রে এই প্রোটিনটিকে বেশি পরিমাণে সেনেসেন্ট কোষে জমতে দেখা যায়।
মানব দেহকোষ নিয়ে পরীক্ষা চালিয়েও গবেষকরা দেখেছেন, এই প্রোটিনটি স্ক্লেরোসিস রোগীদের সেনেসেন্ট কোষে অনেক বেশি পরিমাণে দেখা যায়। এই প্রোটিনের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্যই বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধমনীতে রক্ত সংবহন বাধাপ্রাপ্ত হয়। পরীক্ষাটি চালানো হয় মধ্যবয়সি ইঁদুরের উপর, যাতে তাদের বার্ধক্য ও বার্ধক্যজনিত রোগের গতিতে লাগাম পরানো সম্ভব হচ্ছে কি না বোঝা যায়। দেখা গিয়েছে, টিকা ৯৫ শতাংশ সফল হয়েছে ইঁদুরের ক্ষেত্রে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯১৫
আপনার মতামত জানানঃ