অ্যাজটেক সমাজের তীব্র শ্রেণীবিভাগ চোখে পড়তো। এক শ্রেণী থেকে আরেক শ্রেণীর মানুষের মধ্যে ব্যাপক ব্যবধান লক্ষ্য করা যেতো। ফলে সাধারণ জনগণের সঙ্গে মেশার সুযোগ ছিল না রাজা বা প্রভাবশালীদের। এ শ্রেণী প্রথা স্বভাবতই ভালোভাবে নেয়নি অ্যাজটেক সমাজের সাধারণ মানুষ। ফলে সমাজ যত এগিয়েছে সাধারণ মানুষের সঙ্গে রাজাদের দূরত্ব ততই বেড়েছে। পরবর্তীকালে সংঘটিত বিভিন্ন বিদ্রোহ ও আন্দোলনের ইতিহাস সেসবরই সাক্ষ্য দেয়।
মূলত অ্যাজটেক সমাজের মানুষকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা যেতো। সবচেয়ে উঁচু শ্রেণীতে ছিল রাজা, পুরোহিত ও অভিজাত শ্রেণীর অবস্থান। মধ্যম স্তরে ছিল বনি অবস্থাপন্ন কৃষকসমাজ। আর সবচেয়ে নিচু স্তরে ছিল সাধারণ কৃষক বা যুদ্ধবন্দীদের অবস্থান।
ধর্মীয় বিশ্বাসের দিক থেকে অ্যাজটেকরা ছিল বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ জাতি। অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতার মতো অ্যাজটেক সভ্যতার সঙ্গে মিশে আছে বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী নির্ভর ধর্মবিশ্বাস। তাদের দুই প্রধান দেবতার নাম হলো হুইটজিলোপোচটলি এবং তলালোক। হুইটজিলোপোচটলি হলেন যুদ্ধ এবং সূর্যের দেবতা। আর তলালোক হলেন বৃষ্টির দেবতা।
জানা যায়, সূর্য দেবতার প্রভাবই অ্যাজটেকদের জীবনে ছিল সবচেয়ে বেশি। তারাও সূর্য দেবতাকে খুশি রাখার জন্য বিভিন্ন পূজার আয়োজন করতো। অ্যাজটেকরা বিশ্বাস করতো সূর্য দেবতার উদ্দেশ্যে পূজা না দিলে সূর্যদেবতা তাদের উপর নারাজ হবেন এবং পরের দিন আর সূর্য উঠবে না। ফলে সূর্য দেবতার উদ্দেশ্যে পূজা ও বলিদান সম্পন্ন হতো। নারকীয় পদ্ধতিতে সম্পন্ন হতো অ্যাজটেকদের এই বলিদান পর্ব।
সূর্য দেবতার উদ্দেশ্যে নরবলির আয়োজন ছিল অ্যাজটেক সমাজে নৈমিত্তিক ঘটনা। সাধারণত যুদ্ধবন্দি দাসদের নরবলির জন্য ব্যবহার করা হতো। অ্যাজটেকরা বিশ্বাস করতো মানুষ বলি হিসেবে দিলেই সূর্যদেবতা বেশি খুশি হন। দেবতার আরো অধিক প্রিয় জিনিস হলো কম্পায়মান হৃদপিণ্ড। ফলে একজন পুরোহিত সদ্যবলি দেয়া মানুষের শরীর থেকে হৃদপিণ্ডটি বের করে নিয়ে সূর্যের দিকে ধরতেন। কম্পায়মান হৃদপিণ্ড দেখিয়ে তারা সূর্য দেবতাকে প্রসন্ন করতেন। প্রতিদিন দেবতার উদ্দেশ্যে দেয়া এই নরবলি ছিল অ্যাজটেকদের এক ঘৃণ্য উপাখ্যান।
ধারণা করা হয়, তেনোচতিৎলানের প্রাণকেন্দ্রে টেম্পলো মেয়র পিরামিডের উপরে অবস্থিত সূর্য দেবতার মন্দিরে প্রায় ৮০ হাজার মানুষকে নরবলি দেয়া হয়েছিল। ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণেই অ্যাজটেক সমাজে পুরোহিতদের অবস্থান ছিল উচ্চশ্রেণীতে।
অ্যাজটেক সাম্রাজ্য সমসাময়িককালের চেয়ে প্রভাবশালী সাম্রাজ্যগুলোর একটি ছিল। তবে এই সাম্রাজ্যের কপাল পোড়ে ষোড়শ শতাব্দীতে। স্পিং তখন আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে আক্রমণ করে নিজেদের উপনিবেশ স্থাপন করছে। এসময় স্প্যানিশ জেনারেল হার্নান কর্টেসের অধীনে ৪০০ সৈনিকের একটি ক্ষুদ্র দল মেক্সিকোর উদ্দেশ্যে যাত্রা করে।
অ্যাজটেক সাম্রাজ্যের বেশ নামডাক পূর্বে শুনেছিলেন কর্টেস। ছোট সংখ্যাই হলেও তারা ছিল আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত। ফলে অ্যাজটেকদের নিয়ে মাথা ব্যাথার বিশেষ কারণ ছিল না তাদের। তার উপর সাপে বড় হয়ে আসে এই অ্যাজটেক সমাজের শ্রেণীবৈষম্য। সাম্রাজ্যের ব্যাপক শ্রেণীভেদ থাকায় প্রচুর ফায়দা লুটতে সক্ষম হয় স্প্যানিশরা।
তারা সমাজের নিচু শ্রেণীর মানুষের ক্ষোভ কাজে লাগিয়েই তাদের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করে। এই স্থানীয় নিচের সম্প্রদায়ের লোকেরাই স্প্যানিশ ও অ্যাজটেক বিরোধীদের একত্র করার মতো দুর্ধর্ষ কাজ সম্পাদন করেছিল। ১৫১৯ সালে তার বাহিনী কর্টেস ও তার বাহিনী তেনোচতিৎলানে পৌঁছায়। তৎকালীন রাজা মোকটেজুমা ও তার পরিষদবৃন্দ অ্যাজটেক রীতি মেনে কর্টেসকে বিদেশী দূত হিসেবে আতিথ্য দেয়।
এই আতিথ্য অনুষ্ঠানেই উন্নত অস্ত্রশস্ত্রের সাহায্যে স্প্যানিশরা মোকটেজুমাকে বন্দি করে ফেলে এবং তেনোচতিৎলানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এই বন্দী অবস্থাতেই মৃত্যু ঘটে রাজা মোকটেজুমার। এরপর তার অল্প বয়সী ভাতিজা কুয়াহটেমোক সম্রাট হিসেবে দায়িত্ব নেন এবং স্প্যানিশদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে থাকেন।
এর মধ্যে আবার স্প্যানিশদের সঙ্গে আসা ইউরোপীয় রোগ ব্যাধি যেমন গুটিবসন্ত, হাম ইত্যাদিতে ছেয়ে যেতে থাকে লোকালয়ের পর লোকালয়। এক বছরের ব্যবধানে তেনোচতিৎলানের জনসংখ্যা ৪০ শতাংশ কমে যায়। অন্যদিকে আধুনিক স্প্যানিশ অস্ত্রশস্ত্রের সামনে দুর্বল হতে থাকে অ্যাজটেকদের প্রতিরোধ। অবশেষে ১৫২১ সালের ১৩ই আগস্ট কুয়াহটেমোকের প্রতিরোধ ভেঙে যায়। স্প্যানিশরা পরাজিত করতে সক্ষম হয় অ্যাজটেকদের শেষ সম্রাটকে।
এরপর তেনোচতিৎলানের দ্বারা গঠন করে মেক্সিকো সিটি। আর এর মধ্য দিয়ে পতন ঘটে মেসো-আমেরিকান ইতিহাসের অন্যতম প্রভাবশালী অ্যাজটেক সভ্যতার।
বর্তমানে মেক্সিকো সিটি এবং তারা আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অ্যাজটেক সভ্যতার অনেক নজরকাড়া স্থাপত্যকর্ম। টেম্পলো মেয়র পিরামিড ছাড়াও টিওটিহুয়াকানে অবস্থিত চন্দ্র এবং সূর্য দেবের মন্দির দুটো অ্যাজটেক স্থাপত্যকলার অনুপম নিদর্শন হিসেবে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে। স্প্যানিশদের হাতে অ্যাজটেকদের পতন হলেও এসব স্থাপত্যকর্ম মনে করিয়ে দিতে পারে অ্যাজটেকদের সোনালি দিনগুলোর কথা।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯৩০
আপনার মতামত জানানঃ