গত কয়েক দশকে বৈশ্বিক পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে এশিয়া। বিশেষ করে কম্পিউটার, গাড়ি, ইলেক্ট্রনিক্স, পোশাকসহ বেশ কিছু পণ্যের অন্যতম প্রধান উৎপাদনকেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলো। কিন্তু এশিয়ার এ দেশগুলো পুরো বিশ্বের উপরোক্ত পণ্যের চাহিদা মিটিয়ে আসলেও চলতি সময়ে বড় রকমের বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে। বিশেষ করে অতিসংক্রামক ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর থেকে অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে।
ওমিক্রন প্রথম ধরা পড়ে দক্ষিণ আফ্রিকায়। এরপরই দেশে দেশে নতুনভাবে শুরু হয় ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা। থমকে যায় অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনা। বর্তমানে এর বড় প্রভাব পড়েছে এশিয়ার অর্থনীতিতে। প্রত্যাশা অনুযায়ী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)। মঙ্গলবার (১৪ ডিসেম্বর) আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
এডিবির সবশেষ তথ্য প্রকাশিত হয় মঙ্গলবার। এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২০২১ সালে ৭ শতাংশ এবং ২০২২ সালে পাঁচ দশমিক ৩ শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে ম্যানিলাভিত্তিক এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি। যা তাদের আগের অনুমান থেকে শূন্য দশমিক ১ শতাংশ কম। এর আগে সেপ্টেম্বরে ব্যাংকটি পূর্বাভাস দিয়েছিল এশিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক এক শতাংশ হবে। এপ্রিলে এই হার ছিল সাত দশমিক তিন শতাংশ। করোনার ডেল্টা ধরনের কারণে তখন এই পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল।
এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক জানিয়েছে, করোনাভাইরাসের নতুন ঢেউ অর্থাৎ ওমিক্রন এ অঞ্চলের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া চীনের আবাসন ব্যবসায় দীর্ঘমেয়াদি সংকট, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি ও সরবরাহ সমস্যা অর্থনীতির জন্য হুমকি।
চীনের প্রবৃদ্ধি ২০২১ সালে ৮ শতাংশ এবং ২০২২ সালে পাঁচ দশমিক তিন শতাংশে কাটছাট করা হয়েছে। পূর্বাভাস অনুযায়ী, যথাক্রমে শূন্য দশমিক এক শতাংশ ও শূন্য দশমিক দুই শতাংশ কম। অন্যদিকে ২০২১ সালে ভারতের প্রবৃদ্ধির ধরা হয়েছে ৯ দশমিক ৭ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে যা ছিল ১০ শতাংশ। তবে ২০২২ সালের অনুমান সাত দশমিক পাঁচ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অপরিবর্তিত রয়েছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জন্য ২০২১ সালের প্রবৃদ্ধি কমবে শূন্য দশমিক এক শতাংশ। তবে আগামী বছর এটি বেড়ে হবে পাঁচ দশমিক এক শতাংশ।
এডিবি জানিয়েছে, আঞ্চলিক মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণযোগ্য থাকবে। মূল্য বৃদ্ধির অনুমান ২০২১ সালের জন্য শূন্য দশমিক এক শতাংশ হলেও তা বেড়ে দুই দশমিক এক শতাংশ হবে। কিন্তু আগামী বছরের জন্য যে দুই দশমিক সাত শতাংশ অনুমান করা হয়েছিল তা অপরিবর্তিত থাকবে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জন্য ২০২১ সালের প্রবৃদ্ধি কমবে শূন্য দশমিক এক শতাংশ। তবে আগামী বছর এটি বেড়ে হবে পাঁচ দশমিক এক শতাংশ।
এদিকে করোনার টিকাদানে ধীরগতির কারণে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে বিশ্ব অর্থনীতি। ২০২২ সালের জুনের মধ্যে যেসব দেশ ৬০ শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে পারবে না, চার বছরে সেসব দেশের সম্মিলিত অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ১৯ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা (১৯.৭৮ ট্রিলিয়ন)। এ অর্থ ফ্রান্সের এক বছরের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির সমান। অর্থনৈতিক এ ক্ষতির দুই তৃতীয়াংশ হবে বিশ্বের উদীয়মান দেশগুলোর।
দ্য ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, বেশি সংখ্যক মানুষকে করোনার টিকা দিতে না পারার কারণে সারা বিশ্বের আর্থিক যে ক্ষতি হবে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এশিয়া মহাদেশ। এ মহাদেশের সম্মিলিত ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। তবে জিডিপির বিবেচনায় হিসাব করলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে সাব-সাহারা আফ্রিকা অঞ্চলের, ২০২২-২৫ সালে জিডিপির ৩ শতাংশ।
করোনা সংক্রমণ শুরুর পর খুবই দ্রুততম সময়ের মধ্যে উদ্ভাবিত হয়েছে টিকা। মহামারির এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই টিকাদান শুরু করে উন্নত দেশগুলো। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশগুলোর প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ টিকার আওতায় চলে এসেছে। কিন্তু সব দেশে টিকাদানের গতি এক নয়। এ কারণেই টিকাদানে পিছিয়ে থাকা দেশগুলো অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়বে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
মহামারির আগে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সামগ্রিক অর্থনীতি ছিল বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম জার্মানির পরেই। আর এখন মহামারির দাপটে এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ ইন্দোনেশিয়া এ বছরে তাদের জিডিপির পূর্বাভাসের সীমা অনেকটাই কাটছাঁট করতে বাধ্য হয়েছে। একই অবস্থা থাইল্যান্ড, ফিলিপাইনসহ এই অঞ্চলের বহু দেশের। গত অর্থবছরে উঠে দাঁড়ালেও ভিয়েতনামের অবস্থাও মহামারি পরিস্থিতিতে হুমকির মুখে।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এই সমস্যা থেকে খুব শিগগির বেরিয়ে আসার আলো দেখা যাচ্ছে না। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতে মূলত ইলেকট্রনিক পণ্যের রপ্তানিই ছিল এই দেশগুলোর অর্থনীতির মেরুদণ্ড। কিন্তু কঠোর বিধিনিষেধে সেই সব শিল্পকারখানা দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় ইলেকট্রনিক পণ্য রপ্তানির পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, টানা কঠোর বিধিনিষেধ চালিয়ে গেলে কাজ হবে না, বরং টিকাদানের গতি অনেক গুণ বাড়াতে হবে। তা না হলে সংক্রমণে তো রাশ টানা যাবেই না, অর্থনীতি আরও মুখ থুবড়ে পড়বে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯০৪
আপনার মতামত জানানঃ