সাবেক সেনাপ্রধান এবং পুলিশের এলিট ফোর্স র্যাব ও এর কর্মকর্তাদের উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা দেবার ইস্যুটিকে বাংলাদেশের উপর আমেরিকার একটি চাপ সৃষ্টির কৌশল হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। পাশাপাশি ‘গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনমূলক কাজে জড়িত থাকার’ অভিযোগে র্যাব ও এর ছয়জন বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তার ফলে বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে কি ধরনের প্রভাব পড়তে পারে আগামীতে অনেকেই সেই প্রশ্ন তুলছেন।
বাংলাদেশের কোন নিরাপত্তা বাহিনী ও তার কর্মকর্তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘটনা এটাই প্রথম। এরই মধ্যে নিষেধাজ্ঞার কড়া প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে বাংলাদেশ। দেশটির রাষ্ট্রদূত আর্ল আর মিলারকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। এমনকি আমেরিকার এই নিষেধাজ্ঞাকে শনিবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন “লোক দেখানো অপচেষ্টা” বলে অভিহিত করেছেন।
নিষেধাজ্ঞা কি সম্পর্কের অধঃপতন?
সাম্প্রতিক এই নিষেধাজ্ঞার পেছনে চীন ও রাশিয়ার সাথে বাংলাদেশের ভাল সম্পর্ক, কোয়াড নামের মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটে বাংলাদেশের যোগ না দেয়া; এমন নানা কারণে আমেরিকার দৃষ্টিভঙ্গি বদলের সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রে পাবলিক ইউনিভার্সিটি সিস্টেমের স্কুল অফ সিকিউরিটি এন্ড গ্লোবাল স্টাডিজের অধ্যাপক সায়ীদ ইফতেখার আহমেদ।
এদিকে দু দেশের সম্পর্কের পরিণতি প্রসঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনের মতে, “ডিপেন্ডস অন ইউএসএ”, অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভর করে। কিন্তু অধ্যাপক ইফতেখার আহমেদ মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের এমন সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ইতিমধ্যেই সম্পর্কে প্রভাব পড়েছে এবং সেটা যে অধঃপতনের, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এমনকি ধারণা করা হচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি যদি আগামীতে চীন ও রাশিয়ার দিকে আরও ঝুঁকে পড়ে তাহলে “ভবিষ্যতে আরও কিছু নিষেধাজ্ঞার” মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কাও আছে।
অধ্যাপক ইফতেখার আহমেদ বলেন, পুরো বিষয়টি নির্ভর করবে আগামীতে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতির কার্যক্রমের উপর। বিশ্লেষকরা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের ব্যাপারে ওয়াশিংটনের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন ঘটেছে।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে অধ্যাপক ইফতেখার আহমেদ বলেন, এই দৃষ্টিভঙ্গি বদলের একটি বড় কারণ হতে পারে বাংলাদেশের সাথে চীন ও রাশিয়ার সম্পর্ক। বাংলাদেশের সাথে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে চীনের সুস্পষ্ট একটি প্রাধান্য রয়েছে। এই অঞ্চলে চীন একটি গুরুত্বপূর্ণ অ্যাক্টর হিসেবে ভূমিকা রাখছে।
তিনি বলেন, খেয়াল করুন এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা কোন রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে দেয়া হচ্ছে। রাশিয়া, চীন, মিয়ানমার বা উত্তর কোরিয়ার ক্ষেত্রে দেখেছি, যাদের যুক্তরাষ্ট্র মিত্র বলে মনে করে না। চাপ সৃষ্টি করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এটি ব্যবহার করে।
সায়ীদ ইফতেখার আহমেদ মনে করছেন, বিশেষ করে বাইডেন প্রশাসন দায়িত্ব নেবার পর বাংলাদেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সেটি হঠাৎ করে ঘটেছে এমন নয়।
যেকারণে সম্পর্কের এই টানাপোড়েন
ওবামা প্রশাসনের সময় বাংলাদেশের সাথে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গে একধরনের টানাপোড়েন দেখা দিয়েছিল বলে উল্লেখ করেন তিনি। গত বছর অক্টোবর মাসে ট্রাম্প প্রশাসনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও’র কাছে আটজন মার্কিন সিনেটর র্যাবের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ তুলে চিঠি দিয়েছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আহ্বানে ডিসেম্বর মাসে যে গণতন্ত্র সম্মেলন বা ‘সামিট ফর ডেমোক্রেসি’ শুরু হয়েছে, তাতে অংশগ্রহণকারীদের আনুষ্ঠানিক তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। এই সবকিছুর একটি ধারাবাহিকতা রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র কোন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিলে আনুষ্ঠানিকভাবে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে। তবে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি নেই এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রচুর অভিযোগ রয়েছে এমন অনেক দেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক রাখে। যেমন সৌদি আরব বা ইসরায়েল।
অধ্যাপক ইফতেখার আহমদ বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীন ও রাশিয়ার এক ধরনের শীতল যুদ্ধ চলছে। সে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ব্যাপারে কিছুটা নার্ভাস। তারই আলোকে এই দেশ দুটির সাথে সম্পর্কের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এমন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরে নৌ চলাচল ‘অবাধ ও স্বাধীন’ রাখার উপায় খোঁজার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের মধ্যে ‘কোয়াড’ নামে যে জোট রয়েছে তাতে বাংলাদেশকেও যুক্তরাষ্ট্র যুক্ত করতে চেয়েছিল বলে বিশ্লেষকরা মনে করে।
এরই মধ্যে এ বছরের মে মাসে বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত বলছিলেন, কোয়াডে যোগ দিলে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ‘যথেষ্ট খারাপ হবে’। যদিও ওই সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেছিলেন, কোয়াডের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে কোন প্রস্তাবই দেয়া হয়নি তখনো।
গত বছর অক্টোবরে মার্কিন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফান বিগুন এক তাৎপর্যপূর্ণ সফরে বাংলাদেশে আসেন। তিনি তখন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে (আইপিএস) মূল অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের দিকে তাকিয়ে আছে। তবে চীনের বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) সদস্য বাংলাদেশ অবশ্য তার প্রতিক্রিয়ায় সতর্ক ছিল। কারণ আইপিএস চীনা বিআরআইয়ের পাল্টা একটি পদক্ষেপ হিসেবে পরিচিত।
এর পর নিরাপত্তা ও কৌশলগত প্রভাব রয়েছে এমন একটি আন্তর্জাতিক উদ্যোগে যোগ দিতে বাংলাদেশ তাৎক্ষণিকভাবে আগ্রহ দেখায়নি। ঢাকার আশঙ্কা ছিল, ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় উদ্যোগে যোগদান দেশকে সঙ্ঘাতের দিকে নিয়ে যেতে পারে তবে যোগ না দেওয়ার পরিণতি হাড়ে হাড়ে এখন টের পাচ্ছে বাংলাদেশ। এখন দেখার বিষয়, কীভাবে ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬৩৫
আপনার মতামত জানানঃ