ওয়েব জগতের একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হলো সার্চ ইঞ্জিন। সার্চ ইঞ্জিন ব্যতীত ইন্টারনেট ব্রাউজিং এর কথা ভাবা যায় না। যদি সার্চ ইঞ্জিন না থাকত ইন্টারনেট এত বেশি শক্তিশালী হতে পারত না। গুগল, ইয়াহু, বিং ইত্যাদি সার্চ ইঞ্জিনসমূহ আপনাকে নির্দিষ্ট তথ্য দ্রুত খুজে পেতে সাহায্য করে।
এরা প্রত্যেকেই কার্যত একটি আরেকটি থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন এবং সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে জনপ্রিয়। কিন্তু গুগলের সাথে তুলনা করলে জনপ্রিয়তার দিক থেকে গুগলের ধারে কাছে নেই কেউ।
সার্চ ইঞ্জিন মূলত একটি প্রোগ্রাম যা তথ্য জমা করে এবং প্রয়োজনের সময় সেই তথ্য অনুসন্ধানকারীকে প্রদান করে। সার্চ ইঞ্জিন একটি প্রোগ্রামের মাধ্যমে চালু হয় এবং সার্চ করা তখ্য খুঁজে বেড়ায়। কোন তথ্যের জন্য সার্চ করলে এটি নিজের মধ্যে জমা করে রাখা কোটি কোটি ওয়েব পেইজগুলো থেকে বাছাই করে আপনার প্রয়োজনীয় তথ্যটি খুঁজে বের করে দিয়ে থাকে। এটি মাকড়সার জালের ন্যায় পুরো নেট দুনিয়ায় নিজের জাল ছড়িয়ে রেখে তথ্য সংগ্রহের করে অনুসন্ধানকারীকে প্রদান করে।
পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ যেসব তথ্য কিংবা ডাটা নিয়ে চিন্তা করে, গুগল সেসব তথ্যকে বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে সংগ্রহ করে সুবিন্যস্ত উপায়ে সাজিয়ে রাখে। যখনই কেউ কোনো বিষয় গুগলে সার্চ করে তখনই এটি তার তথ্যের বিশাল সংগ্রহশালা থেকে খুঁজে সবচেয়ে কাছাকাছি ফলাফল এনে দেয়।
অন্য সার্চ ইঞ্জিন থেকে গুগলের জনপ্রিয়তা বেশি হওয়ার রহস্য মূলত এখানেই। যেকোনো সার্চ রেজাল্ট প্রদর্শনের জন্য গুগল যে নীতি ব্যবহার করে তা হলো ‘ওয়ান বেস্ট এন্সার।’ অর্থাৎ গুগল চেষ্টা করে যা সার্চ করা হয়েছে তাই খুঁজে দিতে। অন্যথায়, সবচেয়ে কাছাকাছি উত্তরটাই এনে দেওয়ার চেষ্টা করে এটি।
কিন্তু গুগল যেভাবে অনুসন্ধানের ফলাফল দেখায় সেভাবেই কি সকল মানুষ চায়? ক্ষেত্রবিশেষে ব্যতিক্রম থাকতেই পারে। কারণ গুগল শুধুমাত্র কিছু ওয়েবসাইটের তালিকা ফলাফল হিসেবে প্রদর্শন করে।
আর এ বিষয়টি বিবেচনা করেই ইউ.কম নামক একটি কোম্পানি ভিন্ন কিছু নিয়ে আসার চেষ্টা করছে। তারা ফলাফল হিসেবে কোনো সুনির্দিষ্ট উত্তর না দিয়ে সম্ভাব্য ফলাফলগুলোকে ‘সর্ট’ বা বিন্যাস করে তাদের মধ্যে একটি তুলনা দেখায়।
‘সেলফোর্স’ নামক সফটওয়্যার কোম্পানির দুইজন প্রাক্তন কর্মচারী ২০২০ সালে ইউ.কম প্রতিষ্ঠা করেন। একই কোম্পানির সিইও মার্ক বেনিওফ ইউ.কমকে ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। একই দিনে অর্থাৎ ২০২১ সালের নভেম্বরের ৯ তারিখ ইউ.কম তাদের সার্চ ইঞ্জিনের বিটা ভার্সন সর্বপ্রথম প্রকাশ করে।
অন্যান্য সার্চ ইঞ্জিনের মতো ইউ.কম ফলাফল হিসেবে কোনো লিনিয়ার (সরলরৈখিক) তালিকা প্রদর্শন করে না, বরং একটি গ্রিডের মতো করে ফলাফল দেয় যাতে সহজেই সব ফলাফলের মাঝে তুলনা করা যায়।
গুগলের মতো নিউজ কিংবা ভিডিও ইউ.কম-এও আলাদা ক্যাটাগরি হিসেবে প্রদর্শন করা হয়, কিন্তু একইসাথে উইকিপিডিয়া, লিংকড-ইন বা টুইটারের লিংকও সার্চ রেজাল্ট হিসেবে দিয়ে দেওয়া হয়।
বিন্যাসগত এ পরিবর্তন ছাড়াও ইউ.কমের একটি প্রধান পার্থক্যকারী বৈশিষ্ট্য হলো সার্চ রেজাল্টকে ব্যবহারকারী প্রভাবিত করতে পারবে। সার্চ করার পর সার্চ রেজাল্টে যে ক্যাটাগরিগুলো আসে, সেগুলোকে ব্যবহারকারী ইচ্ছামতো ‘আপভোট’ কিংবা ‘ডাউনভোট’ করতে পারবে।
এর ফলে পরবর্তীতে যখন ঐ ব্যবহারকারী সার্চ করবে, তখন আপভোট করা ক্যাটাগরিগুলো সবার আগে, নিরপেক্ষ ক্যাটাগরিগুলো তার পরে এবং সর্বশেষে ডাউনভোট করা ক্যাটাগরিগুলো আসবে।
ইউ.কম নামক একটি কোম্পানি ভিন্ন কিছু নিয়ে আসার চেষ্টা করছে। তারা ফলাফল হিসেবে কোনো সুনির্দিষ্ট উত্তর না দিয়ে সম্ভাব্য ফলাফলগুলোকে ‘সর্ট’ বা বিন্যাস করে তাদের মধ্যে একটি তুলনা দেখায়।
ইউ.কমকে গুগলের মতো করে উত্তর দেওয়ার জন্য প্রক্রিয়া করা হয়নি। যেমন মাঝে মাঝেই আমরা এরকম কিছু লিখি সার্চ বারে যা আসলে সঠিক নয় অথবা ঐ তথ্য গুগলে নেই, তখন গুগল অনুমান করে উত্তর দেয়।
ইউ.কম এমনভাবে অপ্টিমাইজ করা হয়েছে যাতে করে আপনি ক্লিক করে বিভিন্ন পেজে যেয়ে আপনার চাওয়া তথ্য সংগ্রহ করেন। যেমন, কেউ যদি কোনো একটি সিনেমার অভিনেতার নাম জানতে চান তাহলে গুগল আপনাকে সেই সিনেমার সব অভিনেতার ছবির একটি গ্রিড দেখাবে, কিন্তু ইউ.কম কিছু লিংক প্রদর্শন করবে।
সার্চের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ মানুষের কাছে এরকম সিস্টেম পছন্দসই হবে না হয়তো। কিন্তু ইউ.কম তাদের সীমাবদ্ধতার ব্যাপারে গুগলের তুলনায় বেশ সৎ এবং সেগুলো স্বীকার করে নিয়েই কাজ করে চলেছে।
ইউ.কমের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান নির্বাহী রিচার্ড সোচার একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, প্রকৃতপক্ষে, কোম্পানিটির এই সময়ে অর্থ উপার্জনের কোনো পরিকল্পনা নেই, ফলে এটিতে বিজ্ঞাপন রাখার জন্য কোনো ধরনের জোরজবরদস্তি নেই। এটি আপাতত একটি ওয়েবপেজ, ইউ.কম এবং একটি ব্রাউজার এক্সটেনশন এবং এটি শুধুমাত্র ইংরেজিতে অনুসন্ধান করে৷
নতুন সার্চ কোম্পানি হিসাবে সমস্যাটা হলো, গুগল ইতিমধ্যে বাজার জেঁকে বসে আছে। তার মধ্যে অপরিচিত একটি সার্চ ইঞ্জিন অনেকটা ফেরারি গাড়ির সাথে প্লাস্টিকের এক খেলনা গাড়ির তুলনাই।
স্টেটকাউন্টারের তথ্য মতে, গুগল এতদিন ধরে বাজারে আধিপত্য বিস্তার করেছে। ২৩ বছর বয়সী সার্চ ইঞ্জিনটি ধারাবাহিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাজারের প্রায় ৯০ শতাংশ শেয়ার করেছে, যেখানে মাইক্রোসফ্টের বিং প্রায় ৬ শতাংশের সাথে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে।
নিচের প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি সার্চ ইঞ্জিন গুগলের দুর্বলতা নিয়ে বলছে যে, গুগলের প্রাইভেসি নিয়ে দিনদিন উদ্বেগ বাড়ছে।
মানুষের ডেটা সংগ্রহ না করার জন্য উল্লেখযোগ্য সবচেয়ে সুপরিচিত সার্চ ইঞ্জিন হলো ডাকডাকগো (DuckDuckGo)। সাইটটি প্রায় ১৩ বছর ধরে রয়েছে কিন্তু তারা গুগল এবং ফেসবুকের মতো ‘বিনামূল্যে’ ইন্টারনেট পরিষেবাগুলো থাকা সত্বেও মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে। গোপনীয়তাকে প্রাধান্য দেওয়া অন্যান্য বিকল্পগুলির মধ্যে রয়েছে ব্রেভ(Brave), যেটি এই বছরের শুরুতে তার ব্রাউজারে চালানোর জন্য একটি গোপনীয়তা-কেন্দ্রিক সার্চ ইঞ্জিন চালু করেছে এবং ইকোশিয়া (Ecosia), যারা দাবি করে যে এটি ‘প্রাইভেসি বান্ধব’।
ফরেস্টারের একজন সিনিয়র বিশ্লেষক কলিন কলবার্ন ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেছেন, ‘আমরা জানি ভোক্তারা ক্রমবর্ধমান গোপনীয়তা-সচেতন এবং গোপনীয়তা-সংবেদনশীল হয়ে উঠছে, কিন্তু দিনের শেষে আমি মনে করি ভোক্তারা যে হিসাব করে তা হলো, আমার কাছে গুগলের ইউটিলিটি গোপনীয়তার ঝুঁকির চেয়ে বেশি’।
কলবার্ন বলেন, গুগলের কাছে কতগুলো কম্পিউটার, স্মার্টফোন এবং ব্রাউজার সেটিংস ডিফল্ট হওয়ার কারণে এটি করা কঠিন এবং আমরা গুগল যেভাবে তথ্য উপস্থাপন করে তাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি।
তিনি বলেন, গুগলের মোকাবিলা করার জন্য, একজন প্রতিযোগীকে হয় গুগল ইতিমধ্যে যা করেছে তা অনুকরণ করার বাইরেও সত্যিকারের উদ্ভাবন করতে হবে অথবা এমন একটি কোম্পানি হতে হবে যার ভোক্তারা ইতিমধ্যে যা করছে তার উপর বিশাল পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, যেমন ‘অ্যাপল’। ততক্ষণ পর্যন্ত, বিকল্প ইঞ্জিনগুলি যথাসাধ্য চেষ্টা করছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৫০
আপনার মতামত জানানঃ