করোনা মহামারির কারণে গোটা বিশ্ব নাজেহাল অবস্থায় । মহামারির ধাক্কায় বিশ্বের বহু দেশের স্বাস্থ্যখাত বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এতে করোনাকালে মৃত্যু বেড়ে ম্যালেরিয়াও আরেক মহামারিতে রূপ নিয়ে আছে। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে চিকিৎসাসেবায় বিঘ্ন ঘটায় ম্যালেরিয়ায় মৃত্যু বেড়েছে। ২০২০ সালে আগের বছরের চেয়ে প্রায় ৬৯ হাজার বেশি মানুষ ম্যালেরিয়ায় মারা গেছেন। ২০২০ সালে ম্যালেরিয়ায় ৬ লাখ ২৭ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। মৃতদের মধ্যে বেশির ভাগই আফ্রিকার দরিদ্র দেশের শিশু। গতকাল সোমবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে এমনটি বলা হয়েছে।
করোনায় বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়েছে এবং স্বাস্থ্যসেবায় বাড়তি চাপ তৈরি করেছে। যেসব দেশে ম্যালেরিয়া রোগ স্থানীয় বা সব সময় থাকে সেসব দেশের রোগীরা লকডাউন বা করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে দেওয়া বিভিন্ন বিধিনিষেধের কবলে পড়ে। কারণ লকডাউনে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা থাকায় প্রয়োজনের সময় মশারি বা ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা নিতে সঠিক সময়ে হাসপাতালে যেতে পারেননি।
ম্যালেরিয়া নিয়ে প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়, ২০২০ সালে ম্যালেরিয়ায় ৬ লাখ ২৭ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। মৃতদের মধ্যে বেশির ভাগই আফ্রিকার দরিদ্র দেশের শিশু। এর আগের বছর, অর্থাৎ ২০১৯ সালে বিশ্বে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ৫ লাখ ৫৮ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়, ম্যালেরিয়ায় দুই-তৃতীয়াংশ মৃত্যু করোনার বিধিনিষেধের কারণে হয়েছে। কারণ এ সময় রোগীরা পর্যাপ্ত সেবা পায়নি।
তবে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার বিধিনিষেধের মধ্যে পর্যাপ্ত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতকরণের প্রচেষ্টার ফলে আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চলে ম্যালেরিয়ায় মৃত্যু দ্বিগুণ হয়নি। যদিও এর আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সতর্কবার্তায় বলা হয়েছিল, ২০২০ সালে ওই অঞ্চলে ম্যালেরিয়ায় দ্বিগুণ মৃত্যু হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, ওই অঞ্চলে ২০১৯ সালের চেয়ে ম্যালেরিয়ায় মৃত্যুর সংখ্যা ১২ শতাংশ বেড়েছে।
ডব্লিউএইচও’র গ্লোবাল ম্যালেরিয়া প্রোগ্রামের পরিচালক পেদ্রো আলোনসো বলেন, ‘সময়োপযোগী পদক্ষেপ ও কঠোর প্রচেষ্টার ফলে আমরা এখন দাবি করতে পারি, বিশ্ব ম্যালেরিয়ায় মৃত্যুর সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি এড়াতে সফল হয়েছে’।
চলতি বছরের অক্টোবরে আফ্রিকার শিশুদের ওপর ব্যবহারের জন্য আরটিএস,এস বা মস্কুইরিস্ক টিকার আনুমোদন দেয় ডব্লিউএইচও। তাই বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন দ্রুতই ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আরও উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করবে বিশ্ব।
ইন্ড ম্যালেরিইয়া অ্যাডভোকেসি গ্রুপের আরবিএম পার্টনারশিপের প্রধান নির্বাহী আবদুরাহমান ডিয়ালো বলেন, ‘বর্ধিত তহবিল, জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জামের সহজপ্রাপ্যতা এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের নতুন ও শক্তিশালী উদ্ভাবনের মাধ্যমে আমরা এই প্রজন্মের মাঝেই ম্যালেরিয়া ভীতি শেষ করতে পারি’।
এছাড়া, ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তিনি এক বিবৃতিতে বিশ্ব নেতাদের প্রতি নতুন করে প্রতিশ্রুতি ও অর্থায়নের আহ্বান জানিয়েছেন।
ম্যালেরিয়ায় দুই-তৃতীয়াংশ মৃত্যু করোনার বিধিনিষেধের কারণে হয়েছে। কারণ এ সময় রোগীরা পর্যাপ্ত সেবা পায়নি।
ম্যালেরিয়া একটি প্রাণঘাতী রোগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতিবছর ২০ কোটির বেশি মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়। ২০১৬ সালে বিশ্বজুড়ে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ ম্যালেরিয়ায় প্রাণ হারিয়েছে। মশাবাহিত এই রোগটির প্রাদুর্ভাব ১০ গুণ পর্যন্ত বেড়ে যায় মে থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত।
দুই প্রজাতির মশার মধ্যে স্ত্রী এনোফিলিস মশার কামড়ে দেহে প্রবেশ করে স্যালাইভা। তারপর প্রোটিস্ট নামক অনুজীবের মাধ্যমে রক্তে ছড়িয়ে পড়ে পরজীবি। এর ফলে দেখা দেয় ম্যালেরিয়া।
সাধারণত ফলমূলের রস মশার খাবার হলেও গর্ভকালে পুষ্টির জন্য দরকার হয় রক্তের। এক্ষেত্রে এনোফিলিসের প্রথম পছন্দ মানবদেহ। মশার কামড়ে এই রোগটি হয় এবং জ্বর এ রোগের প্রধান লক্ষণ। তাই ম্যালেরিয়া জ্বর নামেই প্রচলিত রোগটি।
ম্যালেরিয়া হচ্ছে মশাবাহিত প্লাজমোডিয়াম পরজীবী দ্বারা সৃষ্ট রোগ। এটি কেবল সংক্রমিত স্ত্রী অ্যানোফেলিস মশার কামড়ে হয়। এ পর্যন্ত ৬০ এর অধিক প্রজাতির ম্যালেরিয়া পরজীবী আবিষ্কার করা সম্ভব হলেও এর মধ্যে ৪টি প্রজাতি মানুষের ম্যালেরিয়ার জন্য দায়ী।
প্লাজমোডিয়াম ভাইভাক্স, ফ্যালসিপ্যারাম, ম্যালেরি ও ওভাল-এর যেকোনো একটি জীবাণু বহনকারী মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া হতে পারে। এর মধ্যে ফ্যালসিপ্যারাম ম্যালেরিয়ার সবচেয়ে মারাত্মক। যা মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলে। সংক্রমিত মশা যখন কোনো ব্যক্তিকে কামড়ায়; তখন ওই ব্যক্তির রক্তে ম্যালেরিয়ার জীবাণু প্রবেশ করে এবং সে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়।
মশার দ্বারা সংক্রমিত ম্যালেরিয়া রোগটি কিভাবে প্রাণঘাতী রোগ হয়ে উঠলো, এ বিষয়ের অজানা তথ্য উঠে এসেছে রোগটির ওপর জেনেটিক গবেষণায়। ক্যামব্রিজের ওয়েলকাম স্যাংগার ইন্সটিটিউটের গবেষকদের নেতৃত্বে এক গবেষণায় জানা যায়, এ পরজীবীটির বংশতালিকা অনুযায়ী ৭ ধরনের ম্যালেরিয়ার বিষয়ে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
সেখানে তারা দেখতে পেয়েছেন, প্রায় ৫০ হাজার বছর আগে এই জীবাণুটি রূপান্তরিত হয়ে রোগের নতুন একটি শাখায় রূপান্তরিত হয়। যা মানব জাতির জন্য মারাত্মক সংক্রমণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নেচার মাইক্রোবায়োলজি নামে জার্নালে এই গবেষণার তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।
এদিকে দেশে ১৩ জেলায় ১ কোটি ৮৭ লাখ জনগোষ্টি ম্যালেরিয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে, যা মোট জনসংখ্যার ১১.৩ শতাংশ। এসব এলাকায় ম্যালেরিয়া নির্মুলের কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এখন শতকরা ৯০ জন আক্রান্ত এবং মোট মৃত্যুর শতকরা ৮০ জনই মৃত্যুবরণ করেন ওই ১৩ জেলায়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘আমরা সবাই করোনায় মনোযোগ দিচ্ছি। শুধু এটাতে মনোযোগ দিতে গিয়ে ম্যালেরিয়া বা অন্য রোগের দিকে নজর কমে যাচ্ছে। আমরা যদি শুধু কভিড নিয়ে চিন্তা করি তাহলে হবে না। প্রতিটি রোগের ক্ষেত্রেই আমাদের অ্যাডাপটেশন লাগবে। বাংলাদেশের অনেক ম্যালেরিয়া রোগী এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে যাতায়াত করে। এই ভ্রমণ করার ফলে নির্দিষ্ট অঞ্চল থেকে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে ম্যালেরিয়া। এ ক্ষেত্রে আমাদের কমিউনিটি সিস্টেমকে কাজে লাগাতে হবে।’
তারা বলেন, ‘চলমান করোনা মহামারি পরিস্থিতিতে পার্বত্যাঞ্চলে মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। যারা জুম চাষি তারা আক্রান্ত হচ্ছেন। তাদের পাশাপাশি ওই অঞ্চলে বসবাসকারী প্রান্তিক মানুষও আক্রান্ত হচ্ছে, মারাও যাচ্ছে। ফলে এই পরিস্থিতি আমরা কিভাবে মোকাবেলা করব, সেটা নতুন করে ভাবতে হবে। এ ক্ষেত্রে মানুষের সচেতনতা সবচেয়ে বড় অস্ত্র এবং জরুরি বিষয়। মানুষ যত বেশি সচেতন হবে, তত আমরা রোগমুক্ত হব এবং রোগকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারব।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৩৩
আপনার মতামত জানানঃ