প্রথমে আফ্রিকা, এরপর ইউরোপ, আমেরিকা হয়ে এবার বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারতেও শনাক্ত হয়েছে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন। গত ৮ নভেম্বর প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকায় শনাক্ত হওয়া ভ্যারিয়েন্টটি এরই মধ্যে ২৬টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ঠেকানো যায়নি, ওমিক্রনও ঠেকানো যাবে না। সচেতন না হলে এশিয়া-প্যাসিফিক দেশগুলোতে ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন’ বা উদ্বেগজনক হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করোনাভাইরাসের এই ভ্যারিয়েন্টটি।
শুক্রবার (৩ ডিসেম্বর) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) কর্মকর্তারা বলেন, এশিয়া-প্যাসিফিক দেশগুলোর উচিত তাদের স্বাস্থ্যসেবার সক্ষমতা বৃদ্ধি করা এবং ওমিক্রনের আসন্ন প্রভাবের জন্য জনগণকে সম্পূর্ণরূপে টিকা দেওয়া।
মারাত্মক পরিবর্তিত করোনাভাইরাসের ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট দ্রুত দক্ষিণ আফ্রিকায় আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে। গত ১ ডিসেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর কমিউনিক্যাবল ডিজেসেস (এনআইসিডি) জানায়, দেশটিতে বিগত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে ৮ হাজার ৫৬১ জন সংক্রমিত হয়েছে। দেশটিতে এখন সবচেয়ে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন।
দক্ষিণ আফ্রিকান সংস্থাটি জানিয়েছে, গত মাসে জিনগতভাবে বিশ্লেষণ করা নমুনার ৭৪ শতাংশই ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট। এক সপ্তাহ আগে ভ্যারিয়েন্টটি শনাক্ত হওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। যে নমুনায় প্রথম এই ভ্যারিয়েন্টটি পাওয়া যায় তা দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে জনবহুল গৌতেং প্রদেশ থেকে ৮ নভেম্বর সংগ্রহ করা। গত মঙ্গলবারের তুলনায় দেশটিতে বুধবার আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে।
এএফপির খবরে বলা হয়েছে, দক্ষিণ আফ্রিকার বিজ্ঞানীরা এক প্রাথমিক গবেষণায় দেখেছেন, ডেলটা ও বেটা ধরনের তুলনায় ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টে পুনরায় সংক্রমিত করার ক্ষমতা তিনগুণ বেশি। স্থানীয় সময় গতকাল বৃহস্পতিবার প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়েছে, আগে করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে ওমিক্রনের। গবেষণাপত্রটি প্রকাশ হয়েছে অনলাইনে, তবে এর রিভিউ এখনও সম্পন্ন হয়নি।
অন্তত ২৬টি দেশে এ পর্যন্ত ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। অস্ট্রেলিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এবং ভারতের পর চলতি সপ্তাহে এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে নতুন এই ভ্যারিয়েন্ট। অনেক দেশের সরকার ইতোমধ্যে ভ্রমণে কঠোর সতর্কতা জারি করেছে।
পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ডব্লিউএইচও আঞ্চলিক পরিচালক তাকেশি কাসাই একটি ভার্চুয়াল মিডিয়া ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘সীমান্ত নিয়ন্ত্রণে আপাতত ওমিক্রণের বিস্তার রোধ করা গেলেও প্রতিটি দেশকে নতুন ঝুঁকির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। মানুষের কেবল সীমান্ত ব্যবস্থার উপর নির্ভর করা উচিত নয়। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য থেকে বোঝা যায় যে আমাদের চলমান পদ্ধতির পরিবর্তন করতে হবে না’।
কাসাই বলেন, দেশগুলোকে অবশ্যই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সময়কার পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিতে হবে। পাশাপাশি, মাস্ক পড়া ও সামাজিক দূরত্বের মতো নিয়ম বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
আন্তর্জাতিক ভ্রমণকারীদের উপর নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও, শুক্রবার ওমিক্রনের কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের রিপোর্ট করে অস্ট্রেলিয়া। এর একদিন আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাঁচটি রাজ্যে স্থানীয়ভাবে ধরা পড়ে ওমিক্রন।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্য সরকারের পরিচালিত দ্য কোভিড-ডিসপ্যারিটিস প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কৃষ্ণাঙ্গ ও দক্ষিণ এশিয়ার লোকজন, শহরে থাকা অধিক বঞ্চিত নাগরিকদের কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। কেন তাদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি তা ব্যাখ্যা করা জটিল।
অন্তত ২৬টি দেশে এ পর্যন্ত ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। অস্ট্রেলিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এবং ভারতের পর চলতি সপ্তাহে এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে নতুন এই ভ্যারিয়েন্ট। অনেক দেশের সরকার ইতোমধ্যে ভ্রমণে কঠোর সতর্কতা জারি করেছে।
এদিকে বাংলাদেশে ওমিক্রন সতর্কতায় নানা পদক্ষেপ নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির ওমিক্রন নিয়ে বৈঠকের পর এ বিষয়ে ১৫ নির্দেশনা দেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর। এরপর অধিদফতর দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ওমিক্রন শনাক্ত দেশ থেকে প্রবাসীদের এই মুহূর্তে দেশে না ফেরার আহ্বান জানিয়েছে। সেই সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ফ্লাইট বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
কিন্তু এতসব পদক্ষেপ ক্ষেত্রেও দেশের সবচেয়ে কাছের দেশে যখন অতিসংক্রমণশীল ওমিক্রন শনাক্ত হয়, তখন সেটা রীতিমতো শঙ্কার বিষয়। কেননা, এর আগে ভারত থেকে আসা ডেল্টার কারণেই গত মধ্য জুন থেকে আগস্ট মাসের শেষ পর্যন্ত এর ভয়ংকর বিধ্বংসী রূপ দেখতে হয়েছে দেশকে। এই সময়ের মধ্যেই করোনা মহামারিকালে একদিনে সর্বোচ্চ ২৬৪ জনের মৃত্যু হয়েছে, একদিনে সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ২৩০ জন রোগী শনাক্ত হয়, শনাক্তের হার ওঠে ৩২ শতাংশে।
দেশে গত ২৪ মে থেকে জানা যায়, সীমান্তবর্তী সাত এলাকায় বেড়েছে করোনার সংক্রমণ। তার আগেই বেপরোয়া ঈদযাত্রায় করোনার সংক্রমণ বাড়বে বলে সতর্ক করেছিলেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের অনুমান সঠিক প্রমাণ করেছে ঈদের পরপরই সংক্রমণের নতুন মাত্রা। দেশের সঙ্গে ভারতের সীমান্তবর্তী জেলা আছে ৩০টি। এরমধ্যে গত মে মাসে সংক্রমণ বাড়ার প্রবণতা দেখা গেছে সাত জেলায়। এই জেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ। এরপর সেখান থেকে পুরো দেশেই ছড়িয়ে পরে ডেল্টা।
জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, ডেল্টা ঠেকানো যায়নি, এবার ওমিক্রনও ঠেকানো যাবে না। সেটা আজ কিংবা কাল অবশ্যই বাংলাদেশে আসবে। আর এজন্য সীমান্ত ব্যবস্থাপনা জোরদার করতে হবে। এবারে যেন ডেল্টার মতো পদক্ষেপে গাফিলতি যেন না হয় এবং দেশের ভেতরে যেন স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত হয় সেই বিষয়ে নজরদারি জোরদার করতে হবে।
ডেল্টার মতো ওমিক্রন বাংলাদেশের কতটা কাছে জানতে চাইলে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমাদের এখন ‘রিস্ক বেসইড অ্যাপ্রোচ’ অর্থাৎ ঝুঁকি বিবেচনা করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিশ্লেষকরা বলেন, ডেল্টাকে ঠেকানো যায়নি, ওমিক্রনও ঠেকানো যাবে না। ভারতে শনাক্ত হওয়া মানে আমরা ওমিক্রনের খুব কাছাকাছি।
করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন গত ২৪ নভেম্বর শনাক্ত হয় সাউথ আফ্রিকায়। দ্রুত এটি ছড়িয়ে পড়ে যুক্তরাজ্য, বেলজিয়াম, বতসোয়ানা, হংকং ও ইসরায়েলসহ বিশ্বের অনেক দেশে। যেসব দেশে এই ধরন পাওয়া গেছে সেসব দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া হতে পারে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এরই মধ্যে সাউথ আফ্রিকার সঙ্গে স্থগিত করা হয়েছে যোগাযোগ।
এমন প্রেক্ষাপটে আফ্রিকা অঞ্চল থেকে গত এক মাসে দেশে ফেরেন ২৪০ বাংলাদেশি। দেশের তিনটি বিমানবন্দর দিয়ে দেশে আসা এই বাংলাদেশিরা এসেছেন সাউথ আফ্রিকা, নামিবিয়া ও জিম্বাবুয়ে থেকে। কিন্তু তারা এখনও বাড়ি ফেরেননি। আর এতেই শঙ্কিত করোনা কমিটি।
সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বাংলাদেশে আসা ২৪০ জনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
মন্ত্রী বলেন, ডেল্টার চেয়েও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন। ওমিক্রনের সংক্রমণ রোধে সরকার সতর্ক অবস্থানে আছে। তবে দুঃখের বিষয় গত এক মাসে ২৪০ জন আফ্রিকা থেকে এসেছেন। এখন তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের ফোনও বন্ধ।
কদিন আগে ভারতীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হালনাগাদ করা ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম ছিল। তালিকায় বাংলাদেশে ছাড়াও রয়েছে ইউরোপের সব দেশ, ব্রিটেন, দক্ষিণ আফ্রিকা, বতসোয়ানা, চীন, মরিশাস, নিউজিল্যান্ড, জিম্বাবুয়ে, সিঙ্গাপুর, হংকং ও ইসরাইল।
এর ফলে পূর্ণডোজ টিকা নেওয়া ভ্রমণকারীদের জন্য ভারত সরকার যে ছাড় দিয়েছিল, তা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এছাড়া তালিকাভুক্ত দেশগুলোর যাত্রীদের ভারতে প্রবেশের ক্ষেত্রে নিজ খরচে আরটি-পিসিআর পরীক্ষাসহ অতিরিক্ত ব্যবস্থা অনুসরণ করতে হবে বলেও জানিয়েছিল। তবে পরে বাংলাদেশের অনুরোধে তালিকা থেকে ভারত বাংলাদেশের নাম সরিয়ে নেয়।
এরইমধ্যে এশিয়া, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপের অনেক দেশ ও দক্ষিণ আফ্রিকার নয়টি প্রদেশের সাতটিতেই ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বিশ্বের অনেক দেশের সরকারই ভ্রমণে কড়াকড়ি আরোপ করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন যেসব দেশে দক্ষিণ আফ্রিকা এবং এর প্রতিবেশী দেশে ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে ব্যাপকভাবে সেসব দেশ, যাদের সঙ্গে আমাদের সরাসরি বর্ডার নেই, সেসব দেশ থেকে কেউ এলে তাদের বাধ্যতামূলক প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে নিতে হবে। কিন্তু যেসব দেশে একজন দুই জন করে শনাক্ত হয়েছে সেসব দেশ থেকে এলে হয় হোম কোয়ারেন্টিন অথবা তিন থেকে সাত দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে নিতে হবে। এরপর তাদের করোনা টেস্ট করে নেগেটিভ হলে ছেড়ে দিতে হবে।
তারা বলেন, করোনা প্রতিরোধে টিকার বিকল্প নেই। যত বেশি মানুষকে টিকার আওতায় আনা যাবে, তত বেশি জীবন রক্ষা করা যাবে। নিজেকে ও নিজের পরিবারকে সুরক্ষিত করতে টিকার বিকল্প নেই।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৪৫
আপনার মতামত জানানঃ