মাদরাসার শিক্ষক কর্তৃক মাদরাসাছাত্রদের ধর্ষণের অভিযোগ প্রায় নিয়মিত খবর হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাদরাসার কোমলমতি শিশুদের এহেন ধর্ষণে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে দেশ। মাদরাসা ও মাদরাসাশিক্ষকদের নিয়ে মানুষের মনেও জন্মেছে নেতিবাচক মনোভাব। এসব খবরের মধ্যে শোনা গেলো ধর্ষণচেষ্টাকালে এক হুজুরের গোপনাঙ্গ কেটে দিয়েছে এক মাদরাসাছাত্র।
ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার বেতাগৈর ইউনিয়নের পলাশিয়া গ্রামে এক ছাত্রকে অনৈতিক কাজ করতে চায় এক মাদরাসা শিক্ষক। এতে বাধা দেয় ভুক্তভোগী ছাত্র। কিন্তু বাধা না মেনে অনৈতিক কাজ করতে চাইলে ক্ষিপ্ত হয়ে নেইলকাটার দিয়ে শিক্ষকের গোপনাঙ্গ কেটে দেয় ওই ছাত্র।
বুধবার (১ ডিসেম্বর) রাতে এই ঘটনা ঘটে। গোপনাঙ্গ কাটা ওই শিক্ষককে আহতাবস্থায় চিকিৎসার জন্য ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। পুলিশ ছাত্রকে আটক করেছে।
স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, বুধবার দিবাগত রাতে উপজেলার খারুয়া ইউনিয়নের টাওয়াইল গ্রামে অবস্থিত এক মাদরাসার মাঠে ওয়াজ মাহফিল চলছিল। ওই মাহফিলে অংশ নেন মাদরাসাশিক্ষক মো. আতাবুর রহমান (৪২)। একই মাহফিলে ওয়াজ শুনতে যায় একই মাদরাসার আবাসিক এক ছাত্র (১৬)। সভা চলার সময় রাতের খাবারের জন্য পূর্বপরিচিত ছাত্রকে বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান শিক্ষক আতাবুর।
মাদরাসাছাত্র জানায়, দাওয়াত রক্ষার জন্য সে তার শিক্ষকের সঙ্গে বাড়ি যাচ্ছিল। পথিমধ্যে শিক্ষক আতাবুর রহমান তাকে (ছাত্র) কাছে টেনে নিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশে হাত দিতে থাকেন। একপর্যায়ে সে বাধা দিলে শিক্ষক তাকে জোরপূর্বক ধর্ষণে উদ্যত হন। এ সময় সে তার পাঞ্জাবির পকেটে থাকা নেইলকাটার বের করে শিক্ষকের বিশেষ অঙ্গে আঘাত করে ঘটনাস্থল থেকে চলে যেতে থাকে। শিক্ষক রক্তাক্ত অবস্থায় চিৎকার করলে লোকজন ছুটে এসে ছাত্রকে ধরে ফেলেন। পরে পুলিশ এসে ছাত্রকে থানায় নিয়ে যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই মাদরাসাশিক্ষকের এক আত্মীয় জানান, এটা খুবই লজ্জার কথা। যা ঘটেছে তা ওই ছাত্রের সঙ্গে অনৈতিক কাজ করতে গিয়েই ঘটেছে। এটা হুজুরের প্রাপ্য ছিল।
নান্দাইল মডেল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. বাবলু রহমান খান বাবলু জানান, ঘটনার তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এটা খুবই লজ্জার কথা। যা ঘটেছে তা ওই ছাত্রের সঙ্গে অনৈতিক কাজ করতে গিয়েই ঘটেছে। এটা হুজুরের প্রাপ্য ছিল।
মাদরাসায় শিশু ধর্ষণ নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন লেখক সাইফুল বাতেন টিটো। মাদরাসায় শিশু ধর্ষণ নিয়ে গবেষণা করে তিনি ‘বিষফোঁড়া’ নামের একটি উপন্যাস লিখেছেন। ধর্ষণচেষ্টাকালে মাদরাসাছাত্র কতৃক হুজুরের গোপনাঙ্গ কেটে দেওয়া প্রসঙ্গে বলেন, এটা হবার কথা ছিল। এরচেয়ে ভয়ংকর কোনো কিছু ঘটলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু এটা দিয়ে তো ধর্ষণের মতো অপরাধ কমানো যাবে না। বরং অপরাধের পরিমাণ বাড়বে।
তিনি বলেন, এক্ষেত্রে ছাত্রটিকে বাহবা দেওয়ার কিছু নেই। বরং আমাদের মুলে সমাধান খুঁজতে হবে। যে করেই হোক ধর্ষণ বন্ধ করতে হবে। তাতে যদি এই শিক্ষাব্যাবস্থা পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে হয় দিতে হবে। এতো বড় অন্যায় আর অবিচার মেনে নেয়া যায় না৷ যতো দ্রুত সম্ভব পূর্বের ঘটনাগুলোর বিচার করতে হবে, ধর্ষকদের কঠিন শাস্তি নিশ্চিৎ করতে হবে। অন্যথায় এই বিচারহীনতার ফলে ধর্ষিত শিশুরা মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। সেটাও আবার হতে দেয়া যাবে না।
সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন এলাকায় মাদরাসাশিক্ষকদের মাধ্যমে মাদরাসার ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের যৌন নিপীড়নের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। শিক্ষার্থীদের যৌন নিপীড়নের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে বেশ কয়েকজন মাদরাসাশিক্ষক গ্রেপ্তারও হয়েছেন। বিভিন্ন মাদরাসায় যৌন নিপীড়নের এই পরিস্থিতি উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করে বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের বিভিন্ন মাদরাসায় অনেক আগে থেকেই শিক্ষার্থীরা যৌন নিপীড়নের শিকার হলেও আগে এসব খবর গণমাধ্যমে আসত না।
বিকৃত মানসিকতার যৌনাসক্ত এসব শিক্ষকদের কামনার বলি হচ্ছে এসব ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা। এখন সারা দেশে ধর্ষণ-যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ সোচ্চার হওয়ার খবর সংবাদমাধ্যমে বেশি প্রকাশিত হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, শিশুদের ধর্ষণের ক্ষেত্রে এখনও বলাৎকার শব্দটি ব্যবহার করা হয়। তবে তা ঘটনাটিকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে। অনেকেই মনে করেন, এটা তো বলাৎকার, ধর্ষণ না। গুরুতর কোনো অপরাধ না। আসলে ধর্ষণ তো ধর্ষণই, তা সে ছেলে শিশুর সঙ্গে হোক বা মেয়ে শিশু। এর বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। তারা বলেন, আইনের মাধ্যমে সমস্যাটিকে শনাক্ত করে সমাধান খুঁজতে হবে। সব পক্ষকে সঙ্গে নিয়ে প্রচলিত আইন পর্যালোচনা করে শিশু ধর্ষণ বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, মাদরাসাগুলোয় দিনের পর দিন ধর্ষণের ঘটনা ঘটে চললেও তা বন্ধে এখনও তেমন কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে বিপথগামী কিছু শিক্ষক ও মাদরাসাসংশ্নিষ্টরা এটাকে অপরাধ বলেই গণ্য করেন না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিজেদের অপরাধ আড়াল করতে ধর্মের নানা অপব্যাখ্যা দেন জড়িতরা। আবার ধর্ষণের দৃশ্য ভিডিও করে রেখে তা ছড়ানোর ভয় দেখিয়ে শিশুদের জিম্মি করার ঘটনাও রয়েছে।
গত ৭ এপ্রিল সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার বাজারগ্রামের কফিল উদ্দিন হাফিজিয়া মাদরাসার শিক্ষক আনোয়ারুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তিনি এক শিশুর সঙ্গে বিকৃত যৌনাচারের ভিডিও ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। গ্রেপ্তারের পর তার মোবাইল ফোনে আরও কয়েক শিশুর সঙ্গে একই অপকর্মের ভিডিও পাওয়া যায়। পুলিশ জানায়, ধর্ষণের দৃশ্য তিনি মোবাইল ফোনে ধারণ করে ওই শিশুদের ভয় দেখিয়ে আবারও বিকৃত যৌনাচারে লিপ্ত হতে বাধ্য করতেন।
এর আগে গত বছরের ১৯ অক্টোবর চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার আহমদিয়া আজিজুল উলুম মাদরাসার হোস্টেল সুপার নাছির উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা জানান, কবে কোন ছাত্রকে ধর্ষণ করবেন রীতিমতো তার রুটিন তৈরি করেছিলেন তিনি। কোনো ছাত্র রাজি না হলে তার ওপর চালানো হতো নির্যাতন। পরে ভুক্তভোগীরা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। তাদের মধ্যে চার ছাত্র আদালতে ২২ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে নাছিরের পাশবিকতার বর্ণনা দেয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, এমন ঘটনা অনেক হচ্ছে, তবে তা জানা যাচ্ছে কম। যখন কেউ মারা যায় বা নির্যাতনে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে তখনই কেবল তা প্রকাশ্যে আসে। কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে শক্ত ভূমিকা রাখতে হবে। কেন এসব ঘটছে তা খুঁজে বের করতে হবে। জড়িতদের যথাযথ শাস্তি দিতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০৪১
আপনার মতামত জানানঃ