উইঘুর মুসলিম অধ্যুষিক অঞ্চলের আগের নাম ‘পূর্ব তুর্কিস্তান’। এটির বর্তমান জিনজিয়াং প্রদেশে। চীন সরকার এ অঞ্চলকে জিনজিয়াং নাম দিয়েছে। ৯০ লাখ মুসলিম অধ্যুষিত এ অঞ্চলের প্রায় ১০ লাখ উইঘুর নারী-পুরুষ বন্দী রয়েছে সুরক্ষিত বন্দি শিবিরে।
চীন সরকার এ বন্দি শিবিরকে ‘চরিত্র সংশোধনাগার’ নাম দিয়েছে। চীন সরকারের দাবি, উশৃংঙ্খল অবস্থা থেকে নিরাপদ ও সুরক্ষা দিতেই তাদের এ কার্যক্রম। চরিত্র সংশোধনাগারের নামে চীন সরকার এ সব মুসলিমদের প্রতি চরম অত্যাচার ও নির্যাতন করছে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তা উঠে এসেছে। আর এসব দমন-পীড়নের ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংসহ অন্য চীনা নেতাদের সরাসরি সংশ্লিষ্টতার তথ্য ফাঁস হয়েছে। নতুন ফাঁস হওয়া ওই নথিগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে জিনজিয়াং পেপারস। বিবিসির প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে সংখ্যালঘু উইঘুর জাতিসত্তার লোকজনের ওপর দেশটির কর্তৃপক্ষ দীর্ঘদিন ধরে দমন-পীড়ন চালাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগ, বন্দিশিবিরে আটকে রেখে উইঘুর মুসলিমদের ওপর ভয়ংকর নির্যাতন চালাচ্ছে চীন। এ ছাড়া লাখ লাখ মানুষের ওপর নজরদারি করছে দেশটি। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, নেদারল্যান্ডসসহ বেশ কয়েকটি দেশ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের জন্য বেইজিংকে দায়ী করে থাকে। তবে চীন জোরালোভাবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। দেশটির দাবি, সন্ত্রাসবাদ দমন ও ইসলামি উগ্রপন্থা নির্মূল করতে জিনজিয়াংয়ে কঠোর পদক্ষেপ জরুরি। সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের অংশ হিসেবে বন্দীদের ‘পুনঃশিক্ষণ’ দিতে বন্দিশিবির কার্যকর উপায় বলে দাবি করে তারা।
নতুন ফাঁস হওয়া নথিতে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংসহ অন্য নেতাদের বিভিন্ন বক্তব্য আছে। সেগুলো বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উইঘুর মুসলিমদের জন্য বন্দিশিবির স্থাপন ও তাদের কাছ থেকে জোরপূর্বক শ্রম আদায়ের ঘটনায় চীনের জ্যেষ্ঠ সরকারি নেতারা জড়িত। উইঘুর মুসলিমদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং, প্রধানমন্ত্রী লি কেছিয়াংসহ চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা বিভিন্ন বক্তব্য দিয়েছিলেন। আর সেসব বক্তব্যের ভিত্তিতে উইঘুর ও অন্য মুসলিমদের লক্ষ্য করে কঠোর নীতিমালা তৈরি হয়েছে। এসব নীতিমালার মধ্যে রয়েছে জোরপূর্বক বন্দী রাখা, গণহারে বন্ধ্যত্বকরণ, সংখ্যাগরিষ্ঠদের সংস্কৃতি অনুসরণে বাধ্য করা, পুনঃশিক্ষণ এবং আটক উইঘুরদের বিভিন্ন কারখানায় কাজ করতে বাধ্য করা।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, নতুন ফাঁস হওয়া নথির কিছু কিছু তথ্য আগেও প্রকাশ করা হয়েছিল। তবে এবারের নথিতে এমন কিছু তথ্য আছে, যা আগে কখনো প্রকাশ্যে আসেনি।
এ নথিগুলো যুক্তরাজ্যে উইঘুর ট্রাইব্যুনাল নামে গঠিত স্বাধীন ট্রাইব্যুনালের কাছে গত সেপ্টেম্বরে উপস্থাপন করা হয়েছিল। তবে এর আগে তা পুরোপুরি প্রকাশ করা হয়নি। নথিগুলোর সত্যতা যাচাই করতে তিন বিশেষজ্ঞকে দায়িত্ব দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। তারা হলেন ড. আড্রিয়ান জেঞ্জ, ডেভিড টোবিন ও জেমস মিলওয়ার্ড। নতুন ফাঁস হওয়া নথিগুলোর ব্যাপারে জেঞ্জ বলেন, সেখানকার বক্তব্যগুলো বিশ্লেষণ করেছেন তিনি। এতে দেখা গেছে, চীন সরকারের শীর্ষ নেতারা যে বক্তব্য দিয়েছেন এবং পরবর্তী সময়ে উইঘুরদের বিরুদ্ধে যে নীতিমালা বাস্তবায়ন করা হয়েছে, তার মধ্যে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এ তথ্যগুলো আগের চেয় অনেক বেশি বিস্তারিত ও তাৎপর্যপূর্ণ।
এর আগে ২০১৯ সালে নিউইয়র্ক টাইমস উইঘুর মুসলিমদের ওপর চীনা সরকারের আচরণ নিয়ে ফাঁস হওয়া কিছু নথি হাতে পাওয়ার কথা বলেছিল। তবে তখন সে নথিগুলোর সব কটি জনসাধারণের জন্য প্রকাশ করা হয়নি।
চরিত্র সংশোধনাগারের নামে চীন সরকার এ সব মুসলিমদের প্রতি চরম অত্যাচার ও নির্যাতন করছে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তা উঠে এসেছে। আর এসব দমন-পীড়নের ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংসহ অন্য চীনা নেতাদের সরাসরি সংশ্লিষ্টতার তথ্য ফাঁস হয়েছে। নতুন ফাঁস হওয়া ওই নথিগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে জিনজিয়াং পেপারস।
চলতি বছরের গোড়াতে কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা চীন সরকারদের বিরুদ্ধে উইঘুর, তিব্বতি এবং ফালুন গং বন্দীদের অঙ্গ কেটে বিক্রির অভিযোগ তুলেছিল। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের নয়জন বিশেষ প্রতিবেদক এক বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রত্যক্ষদর্শীদের অনুসন্ধান, সাক্ষ্যগ্রহণ এবং চীনের সন্দেহজনকহারে উচ্চমাত্রার অঙ্গদাতার পরিসংখ্যান ঘেটে ভয়ঙ্কর এই অঙ্গ-পাচার বাজারের ওপর নতুন করে আলোকপাত করেন।
বিবৃতিতে বলা হয়, জাতিসংঘের মানবাধিকার রক্ষাকারী বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, তারা চীনের ডিটেনশন ক্যাম্পে ফালুন গঙ অনুসারী, উইঘুর, তিব্বতি, মুসলিম ও খ্রিষ্টানসহ সংখ্যালঘুদের ‘অঙ্গ-অপসারণের’ অভিযোগগুলো নিয়ে ভীষণভাবে শঙ্কিত।
এর আগেও চীনে সংখ্যালঘুদের হত্যা করে তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রি করা হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল৷ এ ঘটনাকে শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ নৃশংসতার সঙ্গেও তুলনা করেছে তারা৷
চীনের জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর কোনো মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে কিনা, তা খতিয়ে দেখতে একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল৷
ওই ট্রাইব্যুনালের কাউন্সেল হামিদ সাবি জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলকে (ইউএনএইচআরসি) জানিয়েছেন, বহু বছর চীনজুড়ে জোর করে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংগ্রহ করা হয়েছিল এবং আজও তা অব্যাহত আছে৷ নিষিদ্ধ ঘোষিত ফালুন গং-এর বন্দি এবং উইঘুর সংখ্যালঘুদের এই লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়, এতে লাখ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷
চীনের সর্বাধিক মুসলিম অধ্যুষিত জিনজিয়াং প্রদেশে মুসলিমদের ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের অধিকার সীমিত হয়ে পড়ছে। মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো ওঠে এসেছে এসব তথ্য।
মুসলিম বিধি-বিধান বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকার সংক্রান্ত অন্যান্য সব বিধানও কৌশলে মুছে ফেলার অপতৎপরতা ব্যাপকহারে চালানো হচ্ছে। মুসলিম পুরুষ ও নারীদের জন্মশাসন ও বন্ধ্যাত্ব করে দেয়া হচ্ছে।
চীন সরকারের জুলুম অত্যাচার থেকে বাঁচার লক্ষ্যে জিনজিয়াংয়ের প্রায় ২৫ লাখ অধিবাসী পার্শ্ববর্তী দেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছে। নানা অজুহাতে উইঘুর মুসলিম নেতৃস্থানীয়দের জেল-জুলুম এমনকি মৃত্যুদণ্ড দিচ্ছে সরকার।
চীন সরকার কর্তৃক এসব অত্যাচার নির্যাতনে এখনও কোনো উইঘুর মুসলিম প্রতিরোধমূলক কিংবা আত্মরক্ষামূলক কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। তারপরও দেশটির সরকার উইঘুর মুসলিমদের সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করে বর্হিবিশ্বের দৃষ্টি অন্যদিকে প্রবাহিত করছে। অথচ দেশীয় কিংবা আন্তর্জাতিক কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা পায়নি তারা।
উইঘুর মুসলিমদের প্রতি এত নির্যাতন সত্ত্বেও দেশের প্রতি তাদের ভালোবাসা আজও অটুট। শত নির্যাতন ও নিপীড়নের মুখেও দেশপ্রেমে ভাটা পড়েনি। তারা চীনকে ভালোবাসে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৫১
আপনার মতামত জানানঃ